পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশেরই বিজয়ের কোনো না কোনো দিন রয়েছে। তারা সেদিন তাদের সংস্কৃতি অনুযায়ী বিজয় উদযাপন করে। আমাদের দেশ বাংলাদেশ। আমাদের বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর। আমাদের বিজয়ের রয়েছে এক মর্মান্তিক কিন্তু গৌরবজনক ইতিহাস। এই বিজয়ের জন্য আমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছি। যুদ্ধজয়ের পর পেয়েছি আলাদা সংবিধান, লাল-সবুজ পতাকা, বাংলাদেশ নামের সীমানা ও মানচিত্র।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৯০ হাজার সদস্য বাংলাদেশ ও ভারতের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এর ফলে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে বিজয় দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে।
এখন কথা হলো, বিজয় উদযাপন সম্পর্কে ইসলাম কী বলে? এদিন আমাদের কী করতে হবে? এর জবাবে বলতে হয়, মানবজীবনে এমন কোনো বিষয় নেই, যার বর্ণনা ইসলাম বা কুরআন-সুন্নায় নেই। বিজয় দিবস সম্পর্কে কুরআনের দুটি সুরা আমাদের সামনে হাজির। একটি সুরা ফাতাহ (বিজয়), আরেকটি সুরা আন-নাসর (মুক্তি ও সাহায্য)। সুরা নাসর-এ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য এবং বিজয় আসবে এবং আপনি মানুষকে দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে দেখবেন, তখন আপনার পালনকর্তার পবিত্রতা বর্ণনা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাকারী।’
এ সুরায় বিজয় দিবসে মুসলমানদের পালনীয় তিনটি কর্মসূচির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে- ১. এই দিনে আল্লাহর পবিত্রতা ও বড়ত্ব বর্ণনা করা। ২. আল্লাহ তায়ালার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা। ৩. যুদ্ধ চলাকালীন যদি ভুলত্রুটি হয়ে থাকে, সেজন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে কায়মনোবাক্যে ক্ষমা চাওয়া।
বিজয় দিবসে এই তিনটিই মুসলমানদের জাতীয় কর্মসূচি। আল্লাহ তায়ালার এই তিনটি নির্দেশনার মধ্যে অনেক তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে আমরা পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেছি। এ সময়ে অনেক জানমালের ক্ষতি হয়েছে। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা আমাদের বিজিত ও স্বাধীন মাতৃভূমি দান করেছেন। এর ফলে আমরা বাংলায় মাতৃভাষায় সব কিছু করতে পারছি। আমাদের কথা বলার অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার ফিরে পেয়েছি- এ এক অপূর্ব পাওয়া।
বিজয় অর্জন আর স্বাধীন হওয়ার চেয়ে বড় আনন্দ কী হতে পারে? এ কারণেই আল্লাহ নির্দেশ দিলেন, তোমরা বিজয় লাভ করেছ, এখন তোমাদের কাজ হচ্ছে, এ বিজয়ের জন্য আল্লাহর দরবারে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে কিংবা তাসবিহ পাঠ করে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। শুধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেই হবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে রক্তারক্তি হয়েছে, ভুলত্রুটি হয়েছে, অন্যের অধিকার নষ্ট হয়েছে, এর জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমাও চাইতে হবে।
মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো, তার মাতৃভূমিকে ভালোবাসা। এটাই রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে ইয়াসরিবের (মদিনার পূর্বনাম) দিকে পাড়ি জমাচ্ছিলেন, তখন তাঁর দুচোখ থেকে অশ্রুর বন্যা বয়ে যাচ্ছিল। তিনি মনে মনে বলেছিলেন, হে মক্কা! আমি তোমাকে ভালোবাসি। কাফেররা নির্যাতন করে যদি আমাকে বের করে না দিত, কখনো আমি তোমাকে ছেড়ে যেতাম না। [ইবনে কাসির ৩/৪০৪]
হাদিসের বর্ণনায় রয়েছে, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনাকে অনেক ভালোবাসতেন। কোনো সফর থেকে ফেরার সময় মদিনার সীমান্তে অবস্থিত উহুদ পাহাড় চোখে পড়লে রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠত। তখন তিনি বলতেন, এই উহুদ পাহাড় আমাদেরকে ভালোবাসে, আমরাও উহুদ পাহাড়কে ভালোবাসি। [বুখারি শরিফ ২/৫৩৯; মুসলিম শরিফ ২/৯৯৩]
যে মক্কা নগরী থেকে প্রিয় রাসুল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতাড়িত হলেন, ১০ বছর পর হাজার হাজার সাহাবায়ে কেরামের বিশাল কাফেলা নিয়ে যখন তিনি বিজয়ী বেশে সেই মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন তিনি যা করেছিলেন তা নিন্মের বর্ণনা থেকে জানা যায়- আল্লামা ইবনুল কাইয়িম জাওযি রহ. তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘যাদুল মাআদে’ উল্লেখ করেন, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি উটের উপর আরোহিত ছিলেন, তাঁর চেহারা ছিল নিম্নগামী (অর্থাৎ আল্লাহর দরবারে বিনয়ের সঙ্গে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন)। প্রথম তিনি উম্মে হানির ঘরে প্রবেশ করেন। সেখানে আট রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। এই নামাজকে বলা হয় বিজয়ের নামাজ। এরপর তিনি হারাম শরিফে এসে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, হে মক্কার কাফের সম্প্রদায়! ১৩ বছর ধরে আমার ওপর, আমার পরিবারের ওপর, আমার সাহাবিদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছ, এর প্রতিবদলায় আজ তোমাদের কি মনে হয়, তোমাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করব? তারা বলল, হ্যাঁ, আমরা কঠিন অপরাধী। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, আপনি আমাদের উদার ভাই, উদার সন্তান, আমাদের সঙ্গে উদারতা, মহানুভবতা প্রদর্শন করবেন। এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, আমি আজ তোমাদের সবার জন্য হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের মতো সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলাম। যাও তোমাদের থেকে কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে না। [সুনানে বাইহাকি ৯/১১৮]
রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথা অনুযায়ী কারো ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। কোনো অপরাধীর বিচার করেননি, বরং সবাইকে সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। ইচ্ছা করলে তিনি অপরাধীদের সঙ্গে যা খুশি তাই করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে সবাইকে ক্ষমা করে মুক্ত-স্বাধীন করে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, যাবতীয় ক্ষমতার মালিক কেবল আল্লাহ রাব্বুল আলামিন।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলেন, (হে নবী) আপনি বলুন, হে রাজাধিরাজ (মহান আল্লাহ), আপনি যাকে ইচ্ছা তাকে সাম্রাজ্য দান করেন, আবার যার কাছ থেকে ইচ্ছা তা কেড়েও নেন, যাকে ইচ্ছা আপনি সম্মানিত করেন, আবার যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন; সব রকমের কল্যাণ তো আপনার হাতেই নিবদ্ধ; নিশ্চয়ই আপনি সব কিছুর ওপর একক ক্ষমতাবান। [সুরা আলে ইমরান: আয়াত ২৬]
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে আমরাও আট রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে পারি। এদিন আরো যে কাজগুলো করা উচিত তা হলো, মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে, স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শহীদ/ গাজীদের অবদান সম্পর্কে আলোচনা সভার আয়োজন করা। তাদের জন্য কুরআনখানি-ফাতেহাখানি ও দোয়া-মুনাজাতের আয়োজন করা। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পঙ্গুত্ব বরণকারী এবং অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করা এবং ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে তাদের ভাতা ও সনদ বাতিল করা। আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করা- তিনি যেন মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাত বরণকারীদের গুনাহ মাফ করে তাদের জান্নাতবাসী করেন, শত্রুরাষ্ট্রের কবল থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেন, এদেশের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি দান করেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় ও স্বাধীনতা চিরদিন অক্ষুণ্ন রাখেন।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম