অধ্যাপক, শিশুসাহিত্যিক ও ভাষাসৈনিক ড. হালিমা খাতুন বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভেঙে যে মিছিল বের হয় সেই মিছিলের অন্যতম নারী নেত্রী হালিমা খাতুন।
১৯৫২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমএ প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। ভাষা আন্দোলনের সময় হলের মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে আহত ভাষা সৈনিকদের সহযোগিতার জন্য চাঁদা তুলেছেন তিনি। এছাড়া লিফলেট বিতরণ, পোস্টার লেখার দায়িত্বও পালন করেছেন ওই সময়। ভাষা সংগ্রামের প্রায় সব মিছিল-মিটিংয়েই তিনি অংশগ্রহণ করতেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির স্মৃতি স্মরণ করে এক সাক্ষাৎকারে হালিমা খাতুন বলেন, ‘একুশের প্রস্তুতি চলছিল বেশ কয়দিন ধরে। প্রতিদিনই মেয়েদের স্কুলে বিশেষ করে কামরুন্নেছা, বাংলাবাজার ও মুসলিম গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের সংগঠিত করার কাজে দায়িত্ব পালন করেছিলাম আমি নিজে। স্কুলের ছাত্রীদের বয়স কম, তাই তাদের মিছিলে, সভা-সমিতিতে নিয়ে আসতে তেমন অসুবিধা ছিল না। কিন্তু মুশকিল হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে। আমি ঢাকায় নতুন এসেছি, তাই আমার কথায় বিশেষ করে পুলিশের সামনা-সামনি হতে বিশেষ রাজী হচ্ছিল না কেউই৷ আমি তাই ২০শে ফেব্রুয়ারি রাতে হাতীরপুলে গিয়ে নাদেরা বেগমের (শহীদ মুনীর চৌধুরীর বোন) কাছ হতে একটা চিঠি নিয়ে এলাম। যে চিঠিতে তিনি পরদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে জমা হয়ে মিছিলে যাওয়ার জন্য ছাত্রী বোনদেরকে অনুরোধ করেছিলেন। নাদেরা বেগম নিজের নিরাপত্তার কারণে আসতে পারেননি।’
‘হোস্টেল থেকে গুটিকয়েক ছাত্রী মিছিলে যাওয়ার জন্য আর কামরুন্নেসা, বাংলাবাজার ও মুসলিম গার্লস স্কুল থেকেও প্রায় ৩০-৪০ জন ছাত্রী আমতলায় এসে জড়ো হলো। সেদিন আমতলার মিটিংয়ে অবশ্য একটা সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে না। এ সিদ্ধান্ত আমরা অর্থাৎ ছাত্রীরা মানতে চাচ্ছিলাম না। মানতে চাইনি বলেই আইন অমান্যকারীদের প্রথম মিছিল নিয়ে আমরা বেরিয়ে এসেছিলাম। সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আমরা চারজন প্রথন পুরনো আর্টস বিল্ডিংয়ের দরজায় পুলিশের ব্যারিকেড ঠেলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দিতে দিতে পথে বের হয়ে পড়ি। মেয়েদের দেখে কেন জানি পুলিশ পথ ছেড়ে দেয়। তারপর ছোট ছোট আরো দু'টি মিছিল পুলিশের বেড়া ভেঙ্গে বের হয়ে আসে। মেয়েদের ৩য় ও ৪র্থ মিছিলকে পুলিশ অ্যারেস্ট করে, পুলিশ তাদের ভ্যানে তুলে নিয়ে বহুদূর নিয়ে ছেড়ে দেয়।’
‘সেদিন আমতলা থেকে বের হয়ে আমরা বেশীদূর অগ্রসর হতে পারিনি। ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়ার গ্যাসের গেল আমাদের দিকে ছুটে আসতে থাকে। চোখের জ্বালায় কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবুও এগিয়ে যাচ্ছি। স্বেচ্ছাসেবকরা বালতি করে পানি এনে সামনে ধরলেন। বালতির পানিতে রুমাল আঁচল ভিজিয়ে চোখে ঝাপটা দিতে লাগলাম। শেলের তীব্রতা ক্রমশ বেড়ে চলল। উপায়ান্তর না দেখে অবশেষে হাতড়ে হাতড়ে মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে প্রথমিক চিকিৎসার জন্যে গেলাম। ঐদিকে তখন কিন্তু প্রচণ্ডভাবে গুলি বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। মেডিকেল হোস্টেলের বাঁশের খড়ের উপরে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসে পড়ছে। জরুরি বিভাগে আহতদের ধরাধরি করে নিয়ে আসতে গিয়ে যে আর্তনাদ শুনেছিলাম, আজও যেন তা কানে শুনতে পাই। হাসপাতালের বাড়ী তৈরীর জন্যে প্রচুর ইঁট জমা করা ছিল হাসপাতালের চত্বরে। মারমুখী পুলিশের বিরুদ্ধে ছাত্ররা সেই ইট ছুঁড়তে থাকে। গুলির শব্দ, শ্লোগান, ইটের শব্দ ও আহতদের আর্তনাদে মেডিকেলের মোড় সেদিন এক রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছিল। প্রাথমিক চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হয়ে আমরা হোস্টেলের দিকে গেলাম। তখন কোনো লাশ ছিল না সেখানে, শুধু তরতাজা রক্ত আর মগজ ছড়ানো ছিল পিচঢালা পথে।’
হালিমা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি প্রাথমিক শিক্ষার ওপর পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্দান কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। শিক্ষকতা করেছেন খুলনা করোনেশন স্কুল, আর কে গার্লস কলেজ এবং রাজশাহী গার্লস কলেজে। পরে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে। সেখান থেকে ১৯৯৭ সালে অবসরে যান। শিক্ষার পাশাপাশি তাঁর শিশুসাহিত্যে অনেক অবদান রয়েছে। ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য শিল্পকলা একাডেমি থেকে পেয়েছেন ভাষা সৈনিক সম্মাননা। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, লেখিকা সংঘ পুরস্কারসহ আরো নানা পুরস্কার পেয়েছেন। ভাষাসৈনিক হালিমা খাতুন ২০১৯ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) পান। উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর ২০১৮ সালের ৩ জুলাই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী