তৈরী পোশাক খাতের প্রধান বাজার, বিশেষ করে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। এসব উন্নত দেশের ভোক্তারা ভোগ্যপণ্যের ব্যয় কমিয়েছেন। কমছে পোশাকের চাহিদা। তাই, পোশাকের অর্ডার কমিয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে, অফ প্রাইস বা ডিসকাউন্টেড পণ্যের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ছে। ফলে, রপ্তানি আয় কমবে।
শনিবার (১৮ মার্চ) বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান পোশাক শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন এসব কথা বলেন। রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমএ ভবনে এ সংবাদ সম্মেলন হয়। এতে সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট নাসির উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।
ফারুক হাসান বলেন, প্রধানত দুটি কারণে রপ্তানি অর্ডার ক্রমাগত কমছে। প্রথমত, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে আমাদের উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। যার প্রভাব পোশাকের মূল্যের ওপর পড়েছে। ফলে, মূল্যভিত্তিক রপ্তানি বাড়লেও পরিমাণের দিক (অর্ডারের) থেকে প্রবৃদ্ধি হয়নি। বরং আগের বছর তুলনায় পোশাক পণ্য রপ্তানি আয় কমছে। আগামী মাস থেকে রপ্তানি আয় কমে যাবে।
বিজিএমইএ’র সভাপতি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের শিল্পের মূল্য সংযোজিত পণ্যে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ হয়েছে। আমাদের বেশকিছু কারখানা অপেক্ষাকৃত উচ্চ মূল্যে পণ্য রপ্তানি করছে। ফলে, পোশাকের ইউনিট প্রাইস বেড়েছে। সুতরাং আমাদের যে হারে মূল্যভিত্তিক প্রবৃত্তি হয়েছে, সে অনুপাতে পরিমাণভিত্তিক প্রবৃদ্ধি হয়নি।
তিনি বলেন, করোনার ক্ষত সেরে উঠতে না উঠতেই আমরা একটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। সাম্প্রতিক সময়ে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যার প্রভাব পড়েছে আমাদের অর্থনীতি ও শিল্পে। আবার আমরা দেখছি যে, ক্রেতারা তাদের সোর্সিং কৌশল পরিবর্তন করছেন। একসঙ্গে বড় অর্ডার না দিয়ে ছোট ছোট স্লটে অর্ডার দিচ্ছেন। ফলে, কারখানা পর্যায়ে আমাদের উৎপাদন পরিকল্পনা বিপর্যস্ত হচ্ছে।
অপরদিকে, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য নীতিতে যে পরিবর্তনগুলো আসছে, সে বিষয়গুলোতে আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। নতুবা আমাদের বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়তে হবে। বিশেষ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ মানবাধিকার ও ডিউ ডিলিজেন্স প্রটোকল গ্রহণ করছে, যেগুলো প্রতিপালন করতে আমাদের সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আমরা সরকারের সাথে একান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা নেশন ব্র্যান্ডিংয়ের পাশাপাশি অ্যাপারেল ডিপ্লোমেসি উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছি, যা আপনারা দেখছেন। বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পথটি মসৃণ করতে ট্রানজিশন পিরিয়ড বাড়িয়ে ৬ বছর করার জন্য আমরা সরকারের মাধ্যমে সকল প্রেফারেন্স গিভিং দেশগুলোকে অনুরোধ করছি।
লিখিত বক্তব্যে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, গেলো বছরগুলোতে আমরা যে মডেল ফলো করে শিল্পকে এগিয়ে নিয়েছি, তার ওপর ভিত্তি করে আগামী দিনে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করা কঠিন হবে। আমাদের বেশ কিছু বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সামনের দিনগুলোতে আমাদের প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়াতে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। বিশেষভাবে নন-কটন খাতে আমাদের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিগত চার দশকে আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি ৪৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছালেও আমাদের পণ্যের ম্যাটেরিয়াল ডাইভারসিফিকেশন হয়নি বললেই চলে।
বর্তমানে বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্যের ৫২ শতাংশ পণ্য নন-কটনের, সেখানে আমাদের রপ্তানির মাত্র ২৬ শতাংশ নন-কটন। বর্তমান বিশ্বে ভোক্তাদের ক্রমাগত জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পোশাকের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নন-কটন পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। সুতরাং এই খাতে আমাদের বিপুল সম্ভবনা আছে। আমরা যদি নন-কটনে আমাদের শেয়ার বাড়াতে পারি, তাহলে আমাদের রপ্তানি বাড়বে, নতুন বিনিয়োগ আসবে, কর্মসংস্থান বাড়বে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট সেবা খাতে ব্যাপক সুযোগ তৈরি হবে, সর্বোপরি সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বাড়বে।
প্রধানমন্ত্রী পণ্য বহুমুখীকরণের ওপর জোর দিতে বলেছেন। আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর সহায়তায় বিগত বছরগুলোতে আমরা যেভাবে বাজার বহুমুখী করতে সক্ষম হয়েছি, সেই একইভাবে যদি আমরা সরকারের নীতিগত সহায়তা পাই, তবে পণ্য বহুমুখীকরণেও বিশেষ করে নন-কটন খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সফল হবো।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, সার্কুলার ফ্যাশন আজ সাসটেইনেবল ফ্যাশন এজেন্ডার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা ইতোমধ্যে অপচয় কমিয়ে আনা ও সম্পদের পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য কারখানাগুলোর সাথে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের কারখানাগুলো নতুন নতুন টেকনোলজি ব্যবহার ও প্রসেস আপগ্রেডেশনের মাধ্যমে তাদের অপচয় কমিয়ে আনছে। এখন আমরা পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়েস্ট বা ঝুট কাপড় পুনরায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি। বর্তমানে প্রতিবছর টেক্সটাইল ও পোশাক খাত থেকে প্রায় ৫ লাখ টনের মতো ঝুট তৈরি হয়। এর একটি অংশ আমরা প্রায় রপ্তানি করে থাকি, যার মাধ্যমে বছরে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার আয় হয়। আমরা যদি এই ঝুটগুলোকে রিসাইকেল করতে পারি, তবে তা দিয়ে আমরা প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পণ্য উৎপাদন করতে পারব, যা আমাদের দেশজ সম্পদে প্রবৃদ্ধি আনবে। এই বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা সরকারের সাথে আলোচনা করছি, যেন রিসাইকেলিং শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল প্রক্রিয়া, পণ্য ও সেবাকে শুল্ক ও ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হয়। ফলে, বিনিয়োগকারীরা এই খাতে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেন।
ইতোমধ্যে বেশকিছু রিসাইক্লিং কারখানা গড়ে উঠেছে এবং আরও বেশ কিছু কারখানা গড়ে ওঠা পাইপলাইনে আছে। আমরা মনে করি, ব্যাপক সম্ভাবনার এই রিসাইক্লিং শিল্পকে যদি আমরা ডেভলপ করতে পারি, তবে এ খাত থেকে অতিরিক্ত রপ্তানি আয় অর্জনের পাশাপাশি বিনিয়োগ আসবে, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে এবং সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজস্ব আয় বাড়বে।
শুধু তাই নয়, অনুকূল নীতি সহায়তা পেলে আমরা পোস্ট কনজ্যুমার ওয়েস্ট বা ব্যবহৃত পোশাক আমদানি করে সেগুলোকে আপ-সাইক্লিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন লাইফস্টাইল পণ্য বা ফ্যাশনেবল পণ্য তৈরি করে তা রপ্তানি করতে পারব। এর মাধ্যমে পোশাক খাতের পাশাপাশি একটি নতুন শিল্প গড়ে উঠবে, যা আমাদের শিল্প খাত বহুমুখীকরণে এক ধাপ এগিয়ে নেবে।