সচরাচর যে বইগুলো বাংলার ইতিহাস বলে স্কুল-কলেজে পড়ানো হয়, সেখানে দেখা যায়, ১২০৩ বা ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি ১৭ বা ১৮ জন অশ্বারোহী নিয়ে বাংলার রাজধানী নবদ্বীপে আসেন। তার আগমনের খবর পেয়ে নবদ্বীপের রাজা বৃদ্ধ লক্ষ্মণ সেন রাজ্য ও রাজধানী ত্যাগ করে অন্তঃপুর থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে যান।
কিন্তু মজার বিষয় হলো এই কাহিনি বাংলার ইতিহাসের পুরাতন কোনো বইয়ে দেখতে পাওয়া যায় না। এমনকি পুরনো দিনের সাহিত্যেও দেখা যায় না। কিন্তু এটি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গল্প-কবিতায় ভালোভাবে স্থান করে নিয়েছে। রাজা লক্ষ্মণ সেন রাজ্য ও রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন ‘বঙ্গে তুর্কী আক্রমণ’ গ্রন্থে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। তিনি লিখেছেন: ‘মাত্র ১৭ জন সৈন্য নিয়ে এরকম বড় একটি জনপদ দখলে নেয়া যায় না, তাতে তারা যত বড় বীর পালোয়ানই হোন না কেনো।’
তাহলে এই ঘটনা কীভাবে আধুনিক গল্প-কবিতায় স্থান পেল? পুরনো জনশ্রুতি থেকে এই কাহিনি গ্রহণ করা হয়েছে বলা যায়। এ ছাড়া এই ঘটনা কীভাবে ইতিহাসের অংশ হলো, এ প্রশ্নের একটি সহজ উত্তর দিয়েছেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। তিনি তাঁর বইয়ে বলেন, যারা বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে একটু জ্ঞান রাখেন তারা নিশ্চয়ই জানবেন, আধুনিক কালে বাংলাতে যখন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় তখন প্রথমে এই গল্প বিদ্যালয়ের কিশোররা চর্চা করত। পরে সেখানে শিক্ষিত সমাজ এবং ধীরে ধীরে জনসাধারণের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছে।
যারা প্রাচীন ও গ্রীক ইতিহাস পড়ে বাংলার ইতিহাসকে সাহিত্যের অংশ বানিয়ে ফেলেছেন তারা মনে করতে পারেন, নবদ্বীপে আক্রমণ হলে বৃদ্ধ রাজা লক্ষ্মণ সেনের মন্ত্রীদের পরামর্শে তিনি রাজপ্রাসাদ রেখে পালিয়ে যান।
এই ঘটনা শুধু মিনহাজ উদ্দীন লিখিত ‘তবকাৎ-ই-নাসেরী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। মিনহাজের বর্ণনার উপর ভর করেই আমাদের দেশে প্রচলিত আছে যে, ১৮ জন অশ্বারোহী সেনা নিয়ে বখতিয়ার খলজি বাংলায় মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠার সূচনা করেন। মিনহাজ পরিষ্কার বলেছেন যে, বখতিয়ার বাংলা আক্রমণের সময় এত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে অগ্রসর হন যে, মাত্র ১৮ জন আরোহী তার সঙ্গে তাল রেখে চলতে পেরেছিল এবং তিনি যখন নদিয়া পৌঁছান, তখন অন্যান্য সৈন্যরা পেছনে ছিল এবং মূল বাহিনী এসে পড়লে নদিয়া বখতিয়ারের হস্তগত হয়।
যদিও তবকাৎ-ই-নাসেরীতে আসন্ন প্রতিরোধে রাজা লক্ষ্মণ সেন কর্তৃক গৃহীত কোনো ব্যবস্থার কথা বলা হয়নি। অন্যদিকে মিনহাজ বখতিয়ারের নদিয়া বিজয়ের প্রায় ৩৮ বছর পর এ তথ্য সংগ্রহ করেন। তাই এমন কাহিনির নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অবশ্য ইসামির ‘ফুতুহুস সালাতিন’ গ্রন্থেও বখতিয়ারের নদিয়া বিজয়ের অনুরূপ কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় বলছেন, মিনহাজ উদ্দীন এই ঘটনা জনৈক বৃদ্ধ মুসলমান সৈনিকের মুখে থেকে শুনে লিখেছেন। কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেননি। পরবর্তী লেখকগণ প্রমাণ ছাড়াই এই লেখার পুনরাবৃত্তি করেছেন। তবে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় সে সময়ের ইতিহাস, প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, এটি সর্বাংশে সত্য নয়।
সুখময় মুখোপাধ্যায় আরেকটি যুক্তি দিয়েছেন বখতিয়ারের নদীয়া বিজয় নিয়ে। সেটি হচ্ছে, রাজা লক্ষ্মণ সেন বখতিয়ারের আক্রমণকালে বঙ্গদেশের নদিয়ায় অবস্থান করছিলেন। উল্লেখ্য যে, মিনহাজ উদ্দীন ‘নদিয়া’কে রাজধানী বলেছেন। কিন্তু সেন যুগের তাম্রশাসনসমূহ থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, সেনদের রাজধানী ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুর। এ ক্ষেত্রে রাজা লক্ষ্মণ সেন যে স্থানে অবস্থান করেন, সেই নদিয়া সাময়িক রাজধানী বা দ্বিতীয় রাজধানী হতে পারে।
নদিয়া ছিল ভাগীরথী নদীতীরের পবিত্র তীর্থস্থান। এমনও হতে পারে যে, বৃদ্ধ বয়সে রাজা লক্ষ্মণ সেন স্বপরিষদ পবিত্র তীর্থস্থান নদিয়ায় পুণ্যলাভের উদ্দেশ্যে অবস্থান করছিলেন। কেউ কেউ বলেন, সুন্দরবনের খাঁড়ি অঞ্চলের বিদ্রোহী বৌদ্ধ নরপতি ডুম্মন পালের বিদ্রোহ দমনের জন্য রাজা লক্ষ্মণ নদিয়ায় যান এবং সেখানে শিবির স্থাপন করেন। ডুম্মন পালকে দমন করা সম্ভব হয় কিনা তা জানা যায় না। তবে নদিয়ায় লক্ষ্মণ সেনকে বেশ কিছুকাল অবস্থান করতে হয়। অর্থাৎ রাজনৈতিক কারণে অবস্থান করতে হয় বলে অনুমান করা যায়। সেই জন্যই হয়তো লক্ষ্মণ সেন নদিয়াকে দ্বিতীয় রাজধানী রূপে গড়ে তুলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত লক্ষ্মণ সেনের নদিয়ায় থাকা অবস্থায় বখতিয়ার নদিয়ার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন।
শিল্পীর তুলিতে বখতিয়ার খলজির যুদ্ধজয়। ছবি: ইউকিপিডিয়া
গবেষক এ কে এম যাকারিয়া বলেছেন, সুদক্ষ যোদ্ধা রাজা লক্ষ্মণ সেন আসন্ন মুসলমান আক্রমণ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন। এমনকি ব্রাহ্মণদের দেওয়া পলায়ন করার উপদেশ উপেক্ষা করেও তিনি নদিয়ায় অবস্থান করছিলেন। সুতরাং তিনি কি তার সাম্রাজ্য সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেননি? এ প্রসঙ্গে যুক্তি প্রদর্শন করা যায়। পশ্চিম দিক থেকে বাংলায় প্রবেশের স্বাভাবিক পথ ছিল রাজমহলের নিকটবর্তী তেলিয়াগড় গিরিপথ। তেলিয়াগড়ের দক্ষিণে বাংলার পশ্চিম সীমান্তব্যাপী অঞ্চল ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। মিনহাজ উদ্দীন এই জঙ্গলাকীর্ণ এলাকাকেই ঝাড়খণ্ড নামে অভিহিত করেছেন। তেলিয়াগড়ের উত্তর পশ্চিমে ছিল খরস্রোতা নদী, প্রবেশের জন্য অযোগ্য। সুতরাং বাংলার রাজার পথে তেলিয়াগড় গিরিপথ সংরক্ষণ করাই স্বাভাবিক এবং লক্ষ্মণ সেন হয়তো তা দুর্ভেদ্য করেছিলেন। কিন্তু বখতিয়ার দুর্গম অরণ্য অঞ্চলের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে সেন রাজার প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা সম্পূর্ণ বানচাল করে দেন।
তবে অরণ্যের পথে বিশাল অশ্ববাহিনী পরিচালনা করা সহজ নয়। তাই বখতিয়ার তার বাহিনীকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে ভাগ করেন। ১৮ সৈন্যের প্রথম দলের অগ্রভাগে ছিলেন বখতিয়ার নিজেই। বখতিয়ার যখন নদিয়ার প্রাসাদে বিনা বাধায় নীরবে প্রবেশ করলেন তখন রাজা লক্ষ্মণ সেনের পক্ষে ভাবা খুবই স্বাভাবিক যে, তেলিয়াগড়ের দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ভেদ করেই মুসলমানগণ নদিয়ায় এসেছে অর্থাৎ তেলিয়াগড় শত্রুদের কব্জায় চলে গেছে এবং তার সেনাবাহিনী পরাজিত হয়েছে। সুতরাং পলায়ন করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ঝাড়খণ্ড অরণ্যাঞ্চলের ভিতর দিয়ে কোনো আক্রমণকারী বাহিনী আসতে পারে, তা হয়তো কল্পনাতীত ছিল।
এই ব্যাখ্যা মেনে নিলে স্বীকার করতে হয় যে, বখতিয়ার সেন রাজার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এড়িয়ে দুর্গম অরণ্যাঞ্চল দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে নদিয়ায় উপস্থিত হয়ে লক্ষ্মণ সেনকে হতবাক করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এবং হঠাৎ আক্রমণে লক্ষ্মণ সেন ঘটনা সম্পূর্ণ অনুধাবন না করে দূরপ্রান্তে পলায়ন করলেন। এভাবে লক্ষ্মণ সেনের পলায়ন ও অতি সহজে বখতিয়ারের নদিয়া জয় আমাদের নিকট স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু ঐতিহাসিকদের এ সমস্ত ব্যাখ্যা ছাড়াও বলতে হয় যে, লক্ষ্মণ সেনের গুপ্তচর বাহিনী মোটেই দক্ষ ছিল না। তিনি শত্রুর গতিবিধির খোঁজখবর রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিংবা তার গুপ্তচর বাহিনী তাকে সঠিক খবর সঠিক সময়ে দিতে পারেনি।
আরেকটি বিষয়ে বুদ্ধ প্রকাশ তার ‘অ্যাসপেক্টস্ অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি অ্যান্ড সিভিলাইজেশন’ গ্রন্থে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। তিনি লিখেছেন, সাধারণভাবে বখতিয়ারের নদিয়া ও লখনৌতি বিজয় ‘বঙ্গবিজয়’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু নদিয়া তো বঙ্গ নয়। তাই ইতিহাসের বাস্তবতা দিয়ে বিচার করলে বলা যায়, বখতিয়ার কোনোকালেই বঙ্গ জয় করেননি। তাহলে এমন একটি সিদ্ধান্ত দীর্ঘদিন ধরে ইতিহাস গ্রন্থের পাতায় লেখা হলো কেন?
হয়তো এ কারণে যে বখতিয়ার খলজি অধিকৃত অঞ্চল পরবর্তী সময়ে গঠিত বাংলা নামের দেশটির অন্তর্গত ছিল। কিন্তু পরে ঘটে যাওয়া ঘটনা দিয়ে কি আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা মূল্যায়ন করা যায় বা যুক্ত করা যায়? পরবর্তীকালে গঠিত বাংলার কতটুকু অঞ্চল বখতিয়ারের অধিকারে এসেছিল? ইতিহাসের সূত্র থেকে জানা যায়, বখতিয়ার প্রথম অধিকার করেছিলেন লক্ষ্মণ সেনের ‘ধর্মীয় রাজধানী’ নবদ্বীপ বা নদীয়া। এর অবস্থান বাংলার পশ্চিম সীমানায়। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি নদিয়া দখল করেন। পরের বছর গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র লক্ষ্মণাবতী বা লখনৌতি অধিকার করে সেখানে রাজধানী স্থাপন করেন। এর অবস্থান পরবর্তী সময়ের স্বাধীন সুলতানি বাংলার উত্তর সীমানায়। এরপর তিনি রাজধানী পরিবর্তন করে চলে আসেন আজকের দিনাজপুরের কাছাকাছি দেবীকোট বা দেবকোটে। তাই সময়ের বিবেচনায় বখতিয়ারের বিজয় স্বাধীন সুলতানি যুগের সার্বভৌম বাংলার একটি অংশ নয় বলে তাকে ‘বঙ্গবিজেতা’ বলা যায় না।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি নদীয়া তথা বাংলার একটি অংশ দখল করেছিলেন। সেসময় লক্ষ্মণ সেন নদীয়া থেকে বিক্রমপুর চলে যান এবং তিনি ও তার বংশধরেরা বিক্রমপুরে (পূর্ব বাংলা) আরও কয়েক দশক শাসনকার্য পরিচালনা করেন।
বি.দ্র,.: হাসান নিজামির ‘তাজ-উল-মাসির’-এ বখতিয়ারের বিহার জয়ের তারিখ বলা হয়েছে ১২০৩-এর মার্চ। তবে মিনহাজ পরিষ্কারভাবে বলেছেন, পরের বছর অর্থাৎ বিহার জয়ের পরের বছর বখতিয়ার নদিয়া জয় করেন। সুতরাং এই হিসাব অনুসারে ১২০৪ সালকে নদিয়া অভিযানের তারিখ বলে ধরা যায়। এ ছাড়া লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি হলায়ুধ মিশ্রর নামে প্রচারিত ‘শেখ শুভদোয়া’ গ্রন্থে ১২০৪ সালের কথা উল্লেখ আছে। এ ছাড়া রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুখময় মুখোপাধ্যায় এবং আর এম ইটন বলেছেন ১২০৪ সাল।
তথসূত্র: মিনহাজ-ই-সিরাজী-‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’ ফখরউদ্দিন ইসামি-‘ফুতুহুস সালাতিন’ গ্রন্থ (ফারসি) সুখময় মুখােপাধ্যায়-‘বাংলায় মুসলমান অধিকারের আদিপর্ব’ বুদ্ধ প্রকাশ-‘অ্যাসপেক্টস্ অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি অ্যান্ড সিভিলাইজেশন’ এ কে এম যাকারিয়া, ‘মুহম্মদ বখতিয়ার্স কঙ্কুয়েস্ট অফ নুদিয়া’-জার্নাল অফ দ্য বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম