সাতসতেরো

তাজমহলের নির্মাণ শ্রমিকদের হাত কেটেছিলেন শাহজাহান?

কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন: ‘মোমতাজ! মোমতাজ! তোমার তাজমহল কত সম্রাট হল ধূলি স্মৃতির গোরস্থানে, পৃথিবী ভুলিতে নারে প্রেমিক শাহজাহানে।’

প্রেমিক শাহজাহানকে কেউ হয়তো ভুলবে না। তবে তাজমহলের কথা উঠলেই কথা শেষে একটি বঙ্কিম প্রশ্ন আমাদের সামনে আসে। আর তা হলো, সত্যিই কি শাহজাহান তাজমহল নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ২০ হাজার শ্রমিকের হাত কেটেছিলেন? 

অনেকে এর পেছনে যুক্তি দেখিয়ে বলেন, আর যেনো কোনো ব্যক্তি এমন স্থাপত্য নির্মাণ করতে না পারেন- সেজন্য এ ব্যবস্থা! আর এ ধরনের দাবি কিন্তু নেহাত নতুন নয়। ২০০৪ সালে বিষয়টি নিয়ে পালে হাওয়া দেন শীর্ষস্থানীয় ব্রিটিশ গণমাধ্যম ‘দ্যা গার্ডিয়ান’। তাজমহলের ৩৫০তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে এলিজাবেথ গাইকি তার ‘দ্যা তাজমহল’ শীর্ষক নিবন্ধে লেখেন: এটি (তাজমহল) নির্মাণে অন্তত ২০ হাজার মানুষের ২২ বছর সময় লেগেছিল। যে কারিগররা তাজমহল নির্মাণে কাজ করেছিলেন, নির্মাণকাজ শেষে তাদের হাত কেটে নেওয়া হয় যেন তারা পরে কখনো অনুরূপ কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করতে না পারেন। 

২০১০ সালে, যুক্তরাজ্যভিত্তিক আরেক গণমাধ্যম ‘ওয়্যারডে’ একই ধরনের তথ্য প্রকাশ করে। যদিও তাদের সেই দাবির সপক্ষে তারা কোনো ইতিহাস গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেননি। 

ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাদশাহ শাহজাহানের তৃতীয় স্ত্রী মমতাজ বেগমের সঙ্গে সম্রাটের বিবাহিত জীবন ছিল ১৯ বছরের। মাত্র ১৯ বছরের বিবাহিত জীবনে মমতাজ ১৪টি সন্তান প্রসব করেন। তিনি ছিলেন শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল। শারীরিক ধকল সহ্য করতে না পেরে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে প্রাণ হারান মমতাজ। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিতে ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে তাজমহল তৈরি শুরু করেন মুঘল সম্রাট শাহজাহান। তাজমহল বানানোর কাজ শেষ হয় ১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে। যদিও এরপর ছোটখাটো কাজ সম্পন্ন করতে আরও দুই বছর সময় লাগে। এটি তৈরি করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা।

অনেকে বলেন, স্ত্রীর প্রতি সম্রাটের ভালোবাসার নিদর্শন এই মহল। আবার কেউ দাবি করেন, স্ত্রীর মৃত্যুর পর অনুশোচনার জেরে এই মহল নির্মাণ করেন সম্রাট। এসব নিয়ে নানা মুনির নানা মত। শ্বেত পাথরের তৈরি এই স্মৃতি সৌধের আনাচ কানাচে লুকিয়ে রয়েছে নানা তথ্য, নানা রহস্য, নানা অজানা ইতিহাসের কথা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে সামনে আসে সেই প্রশ্ন- তাজমহলের ২০ হাজার শ্রমিকের হাত (মতান্তরে হাতের আঙুল) কি সত্যিই কেটে নিয়েছিলেন শাহজাহান? 

রাঁচি ইউনিভার্সিটির ‘জার্নাল অব হিস্টোরিকাল রিসার্চ’-এর অংশ

গুগল বুকসে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে রাঁচি ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগ থেকে প্রকাশিত ‘জার্নাল অব হিস্টোরিকাল রিসার্চ’-এ এই কাহিনিকে আখ্যায়িত করা হয়েছে একটি শহুরে কিংবদন্তী হিসেবে। তিনটি প্রশ্ন করে এই গুঞ্জনকে মিথ্যা প্রমাণ করা যায়। তাজমহলের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, প্রথমত অত শ্রমিকের হাত কেটে ফেলা হলো, অথচ তাদের কারও কাটা হাতের কঙ্কালজাতীয় কোনো রকম প্রমাণ মিলল না? দ্বিতীয়ত, ঐ সময়ে ভারত ভ্রমণে আসা কোনো পর্যটকের বিবরণ কিংবা সমসাময়িক কোনো বই কোথাও এমন কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই।

তৃতীয়ত, শাহজাহানের শাসনামল ছিল ‘নির্মাণের স্বর্ণযুগ’। এমন নয় যে, তাজমহল ছাড়া আর কোনো স্মরণীয় স্থাপত্যকীর্তি শাহজাহানের আমলে নির্মিত হয়নি। সে সময় আগ্রায় তাজমহল ছাড়াও রয়েছে মতি মসজিদ, দিল্লিতে নির্মাণ হয়েছে জামা মসজিদ ও লালকেল্লা। তাজমহল নির্মাণ শেষে শাহজাহানের শ্রমিকরা তার জন্য দিল্লিতে শাহজাহানাবাদ নামে একদমই নতুন একটি সাম্রাজ্যিক শহরও নির্মাণ করেন। যদি তাজমহল নির্মাণকাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের তিনি এ কাজে নিযুক্ত না করেন, সেক্ষেত্রে পুনরায় সম্রাটের পক্ষে আবারও এত কম সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ রাজমিস্ত্রি ও কারিগরের দল খুঁজে বের করা ছিল অসম্ভবের কাছাকাছি।

ইতিহাসবিদ এস ইরফান হাবিব বলেছেন, এই শহুরে পৌরাণিক কাহিনি ১৯৬০ এর দশকে শুরু হয়েছে এবং আমি এটি মানুষের মুখে মুখে শুনেছি। শাহজাহান তাজমহল নির্মাণশ্রমিকদের হাত কেটে দিয়েছিলেন; এই ঘটনাটি নিছক মিথ। তবে তিনি বলছেন, এই গুজবের পিছনেও কারণ রয়েছে। শাহজাহান তাজমহলের শ্রমিক ও শিল্পীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তারা যেন অন্য কোনো সম্রাট-বাদশাহর হয়ে কাজ না করেন। সোজা কথায়, এটা ছিল একটা চুক্তির মতো। অর্থাৎ ‘হাত কেটে নেয়া’ কথাটি আসলে একটা রূপক। 

তিনি আরো বলেন, এই কাহিনি বাস্তবে বিদ্যমান তথ্য-প্রমাণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এমনকি আজও তাজ গঞ্জ নামে একটি বিশাল বসতির অস্তিত্ব রয়েছে। সম্রাট শাহজাহান এই বসতিটি গড়ে তুলেছিলেন তাজমহল নির্মাণে অংশ নেওয়া হাজারো রাজমিস্ত্রি, কারিগর ও অন্যান্য শ্রমিকদের জন্য, যারা তার রাজ্যের দূর-দূরান্তের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে সমবেত হয়েছিলেন। ওই শ্রমিকদের বংশধররা আজও সেখানে বাস করেন, এবং তাদের দাদা-পরদাদাদের শিখিয়ে যাওয়া কাজ করেন। এ মিথটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, কেননা এই তথ্যটিই তো উদঘাটিত হয়েছে যে, তাজমহলের প্রধান স্থপতি ওস্তাদ আহমদ লাহৌরিকে পরে মোঘল সম্রাট শাহজাহানের আরো অনেক অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

তাজগঞ্জ এর বর্তমান অবস্থা

এ ছাড়া ২০১৭ সালেই পাকিস্তানের শীর্ষ দৈনিক ডন ছাপে ‘ভিউ ফ্রম অ্যাব্রোড: ডিড শাহজাহান চপ অফ ৪০,০০০ হ্যান্ডস’ শিরোনামের একটি নিবন্ধ। সেটির মূল বিষয়বস্তু ছিল তাজমহল শ্রমিকদের হাত কাটার উপকথার উপর ভিত্তি করে নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক রাজীব জোসেফের নাটক ‘গার্ডস অ্যাট দ্যা তাজ’। এই লেখায়ও ঘটনাটিকে কিংবদন্তী আখ্যা দেওয়া হলেও, লেখক ইরফান হুসাইন হাত কাটার বিষয়টিকে ক্ষমতা ব্যবহারের প্রতীকী রূপ বলে ইঙ্গিত করেছেন। তিনি লিখেছেন ‘গার্ডস অ্যাট দ্যা তাজ’, সপ্তদশ শতকের একটি কিংবদন্তীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও, এখানে খুবই সমসাময়িক একটি ভাবনার নিরীক্ষণ ঘটে। আমাদের চারপাশে আজ শক্তিশালী, বর্বর নেতাদের জয়যাত্রা চলছে। তারা হয়তো হাত কেটে নেবে না, কিন্তু তারা দৃশ্যত অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার চর্চা করে। সম্ভবত তাদের উচিত শাহজাহানের নিয়তি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। 

সম্রাটকে তার পুত্র কারারুদ্ধ করেছিলেন তাজমহলেরই নিকটবর্তী একটি টাওয়ারে, যেখান থেকে তিনি নিজ চোখে দেখতে পেতেন তার জাঁকালো নির্মাণ। বলাবাহুল্য, সর্বশেষ দুই হাইপোথিসিস সম্পর্কেও শতভাগ নিঃসন্দেহ হওয়া সম্ভব নয়। তবু এ কথাও অনস্বীকার্য যে এসব হাইপোথিসিস সত্য বলে মেনে নিলে অনেক বিভ্রান্তি দূর হয়ে যায়। আপাতত এটুকু বিভ্রান্তি থেকেই আজ বেরিয়ে আসা যায় সত্যিকার অর্থে শাহজাহান কখনো তাজমহলের নির্মাণশ্রমিকদের হাত কেটে নেননি।