সাতসতেরো

মো. জাহিদ হাসানের দুটি কবিতা 

আমি নির্বাসনে যাব

চারদিকে জাগ্রত লুটেরা, ভূমি দস্যু, ভেজালকারী তস্করের দল  পিতা গুম হওয়া সন্তানের খবর নিতে পায় না সাহস বল কেউ সহস্র কোটি টাকা পাচার করে, ঠোঁটে তুলছে হাসির ঢেউ  চিকিৎসার অভাবে রোগা ভুখা মরলেও খোঁজ  রাখে না কেউ।

কেউ আঙিনা পেরিয়ে খুলতে গিয়ে আলগোছে কারও শাড়ি  অবুঝ শিশু ও ডানে-বামে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে কত নারী। মর্মাহত হয়ে মাথা ঠুকে মরি বিবেকের দেয়ালের গায় অনাচার দেখে নিজেকে কুচি কুচি করে কাটতে থাকি যন্ত্রণায়।

অভাবের হিংস্র দাঁত গরিবকে অনায়াসে খাচ্ছে ছিঁড়ে  ডাস্টবিনে পড়ে থাকতে দেখি  নবজাতকের ক্ষতবিক্ষত দেহ। চলছে ধর্ষণ গুম হত্যার মহামারি ও বাকরুদ্ধ আহাজারি  আমি হতাশ হয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলি ভাঙতে পারি না ঘোর!

যুগের হালচাল দেখে আমার মনে জমেছে  শত ঘৃণার সর। আমার টগবগে রক্তে হাঁকে দুরন্ত প্রতিবাদের বিশাল ঝড়! মনে হয় দুর্নীতি অনিয়ম অসাম্যের দুয়ারে আঘাত হানি  সাম্যবাদী হয়ে ভেঙে চুরমার করি শত বাঁধার বিন্ধ্যাচল।

অবসরে কোথাও আড্ডা দিতে গিয়েও পাইনা স্বস্তি ছাড়া যন্ত্রণা  প্রতিবাদ না করতে করতে ভুলতে বসেছি প্রতিবাদের মন্ত্র! আমি অনিয়মের শিখর ভেঙ্গে দিতে শহীদ বা গাজী হইতেও রাজী ওদের সাথে পেরে ওঠা দুস্কর ওরা শৃঙ্খলবদ্ধ হায়েনার মতো পাজি 

ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে অনিয়মের সাম্রাজ্য ও গড়তে সাম্যের নীতি  আমার নেই ক্ষমতা অথৈ, তাই মুখ বুঁজে সব অনাচার সই! বিবেকের দহন পাঁজরে উত্তপ্ত মরুর ধূলো হয়ে করে উড়াউড়ি! মানিয়ে নিতে না পারলেও হৃদয়ে ধারণ করি প্রভাতের ভৈরবী!

যুগের হালচাল দেখে আমি অপ্রকৃতস্থ উন্মাদ হয়ে যাই বারবার  জুলুমের যাঁতাকলে পড়েও যেখানে জনতা স্বাভাবিকভাবে হাসে  এমন মৃত্যু উপত্যকা কখনো বসবাসের আবাস হতে পারে না!  অনিয়মের ভীষণ দহনে দগ্ধ আমি নিজেকে বাঁচাবো কিভাবে?  

হয়ত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ইতিহাস পড়তে গিয়ে হঠাৎ যাবে থেমে শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি ও নৈতিকতা পড়ে যাবে ঘেমে!  ওরা গর্ব করে বলবে, ভাগ্যিস জন্মাইনি বিকলাঙ্গদের কালে। 

ক্ষমতা লোভী জল্লাদদের উল্লাসে মেতে ওঠা কসাইখানায় থেকে-  যুগের গড্ডলিকা প্রবাহে নিজেকে আর ভাসাব না গড্ডলের সাথে। আমি সমাজের বিশৃঙ্খলা হতে নিস্তার পেতে নির্বাসনে যাব   পাপ-তাপ অনিয়ম অনাচারের বেড়াজাল ভেঙে চলেই যাব থাকব না আর মানুষরূপী রাক্ষসের বাপ খোক্কশদের সাথে মিশে। 

শোষণ ত্রাসের চরাচর হতে চলে যাব আদিম  যুগের গহীন জঙ্গলে  আদি প্রজন্ম বানরের সাথে স্রোতের প্রবাহে নিজেকে ভাসিয়ে দেব  অন্ধকারে জোনাকীর আলোয় প্লাবিত হয়ে খুঁজে নেব নতুন পথ!  বন্য পাখি, হিংস্র জন্তুদের সাথে যদি খাপ খাইয়ে নিতে না পারি  ফিরে আসব না আর সভ্যতার মোড়কে ঢাকা অসভ্যদের ভীড়ে। আমি মেঘের বাড়িতে ঘর বেঁধে আজন্মকাল নিরবে দেব পাড়ি  জোছনায় স্নান করবো  মেঘের  সাথে আকাশে হবে  ঘোরাঘুরি   আমি নির্বাসনে যেতে চাই করে পর সকল নারী ও নর।

স্মৃতিতে বাংলার ঐতিহ্য

আগের মতো পাতে না কেউ দোস্তালী আর সই! সরল মানুষ কই?   যান্ত্রিক ট্র্যাক্টরের যন্ত্রণায় হারাচ্ছে কৃষকের লাঙ্গল জোয়াল মই। নবান্ন এলেই ঢেঁকির পাড়ে ধুম পড়ত ভানতে নতুন ধান এখন পল্লি বধূরা ধান ভানে না, হারিয়ে গেছে ঢেঁকি ছাঁটা চাল। 

আজ রমণীর হাতে থাকে না কাঁচের চুড়ি, চুলে রেশমী ফিতার সাজ প্রেমিক কে দেয় না প্রেমিকা রঙ্গিন সুতোর রুমাল করে কারুকাজ এখন শিল পাটাতে মরিচ বাটতে গিয়ে, চোখে আর লাগে না ঝাল বন জঙ্গল উজার হয়ে হারিয়ে গেছে হুক্কাহুয়া খেক শিয়ালের পাল। 

নারীরা পহেলা বৈশাখ, ফাল্গুন, বিয়ের অনুষ্ঠান ছাড়া পরে না শাড়ি বেনারসি কাতান জামদানি জর্জেট শাড়িতে সাজায় আলমারী। হারিয়ে গেছে নদীর নাব্যতা, হারিয়ে গেছে ডিঙি নায়ের পাল বাবা-মায়ের কথা অমান্য করলেই  শাসিয়ে তুলত গায়ের ছাল।

ইনজেকশনে মোটা তাজা করা গরুতে আর হয় না জমির হাল বিষাক্ত গরু খেয়ে কালের বিবর্তনে বিলুপ্ত হয়েছে শকুনের পাল ডিজিটাল বিবর্তনে হারিয়েছে রেডিও ক্যাসেট ভিসিআর এর গান হারিয়ে গেছে খড়ম, পিঁড়ি, জাঁতা, শিকা, পালকি আর হুক্কার টান।

বিপন্ন হয়েছে হাডুডু ডাংগুলি গোল্লাছুট ইচিংবিচিং কুতকুত বিলুপ্ত লোকজ ঐতিহ্যের কুলা, ডালা কাঁসা ও পিতলে কারুকাজ হারিয়ে যাচ্ছে মাটির হাঁড়ি, নকশি পাখা, শীতলপাটি, পুতুলের নাচ হারিয়ে গেছে শৈশবের দুরন্তপনা, ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলার সাজ

হারাচ্ছে ভাপা, পুলি, পাটিসাপটা, চিতইসহ বাহারি পিঠার স্বাদ মুখ থুবড়ে পড়েছে, পালা গান বাউলগীতি ও জারী গানের রাত  সংস্কৃতির শেকড় ছিড়ে অপসংস্কৃতিতে আবদ্ধ হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ঘটি বাংলার রূপ বৈচিত্রের সাথে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির মনন রুচি।