হাছন রাজার প্রকৃত নাম দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী। মাত্র ১৫ বছর বয়সে জমিদারিত্ব পেয়েছিলেন। জানা যায়, অন্যান্য জমিদারদের মতোই তিনিও ছিলেন সামন্তপ্রভু। ৫০ বছর বয়স তথা মায়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সম্পদলিপ্সু, কামাতুর ও ভোগবাদী। হাছন রাজা চৌধুরীর জীবন পাল্টে দেয় দুটি ঘটনা—১৮৯৭ সালে আসাম অঞ্চলের ভূমিকম্প এবং তার মায়ের মৃত্যু।
১৯০৪ সালে হাছন রাজার মা হুরমত জাহান বানুর মৃত্যু হয়। তখন হাছন রাজার বয়স ৫০ বছর। ক্ষমতাশালী ও প্রতাপশালী হাছন রাজার অধিপতিত্বে তখন ৫ লাখ একর জমি। তারপরও তার মাকে মাত্র সাড়ে তিন হাত মাটিতে কবর দিতে হলো। সেই ঘটনা তার মানসিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে। এরপর তিনি নিজের উত্তরাধিকারদের জন্য মোট জমির চার আনা পরিমাণ রেখে বারো আনা জমি জনসাধারণের কল্যাণে দিয়ে দেন। এই টালমাটাল সময়ের মধ্যে হাছন রাজা চিশতিয়া তরিকার ফকির মাহমুদ শাহর দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং ক্রমে আবিষ্কার করতে থাকেন আত্মার সম্প্রসারিত রূপ। তার সাক্ষ্য বহন করছে হাছন রাজার গান আর সুনামগঞ্জ।
বিপিএলে সিলেট সিক্সার্স-এর স্পন্সর ছিলাম আমরা (ওয়ালটন গ্রুপ)। দলটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কয়েকটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল সিলেটে। সেই সুবাদে আবুল মাল আবদুল মুহিতের সফরসঙ্গী হয়ে সিলেটে গিয়েছিলাম। সাধারণত, বিপিএল খেলা বিকেলে শুরু হয়ে রাত ৮টার মধ্যে শেষ হয়ে যেত। বাকি সময়টাতে সিলেট ঘুরে দেখার সুযোগ ছিল। মনে হলো, সিলেটের আলী আমজাদের ঘড়ি, এমসি কলেজ, হজরত শাহজালাল (র.) ও হজরত শাহপরান (র.)-এর মাজার—সবই দেখা হয়েছে, কিন্তু সুনামগঞ্জে অবস্থিত হাছন রাজার বাড়িটি দেখা হয়নি। হাছন রাজার বাড়িটি দেখে আসার উদ্যোগ নিলাম। আমার ছোট এক ভাই সিলেট সিটি করপোরেশনের মেডিক্যাল অফিসার, ওকে বললাম। ও একবাক্যে রাজি হয়ে গেল। আমরা ওর গাড়িতেই রওনা দিলাম সুনামগঞ্জের দিকে। সেখানে আমাদের ওয়ালটন প্লাজা আছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, পেশাজীবনের শুরুতে কিছু দিন শিক্ষকতা করেছি। ঘটনাচক্রে ওই প্লাজার ম্যানেজার আমার ছাত্র। সুনামগঞ্জে প্রথমে তার ওখানে গেলাম। একে তো অফিসের ‘স্যার’, তারপর আবার ’ক্লাস টিচার’; সব মিলিয়ে খুব আন্তরিক আতিথেয়তা দেখালো। তিনজনে মিলে প্রথমে সুনামগঞ্জ শহরটা ঘুরে দেখলাম। এরপর সুনামগঞ্জ শহর থেকে আবার একটু পেছন দিকে এসে হাছন রাজার বাড়িতে গেলাম। হাছন রাজার বাড়িতে এখনো একটা গেট আছে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কেবল মনে পড়তে লাগল, হাছন রাজা এই গেট দিয়ে খুব দাপটের সঙ্গে বের হতেন।
দেখলাম, বাড়ির উঠোনে মার্বেল খেলছে কয়েকটি ছেলে। বাড়ির ভেতরে দেখলাম, একটি পুকুর। এর পর চলে গেলাম সংগ্রহশালায়। সেখানে হাছন রাজার বংশানুক্রমিক তালিকা। সেই তালিকায় উল্লেখ আছে উনার পূর্বপুরুষের নাম। উনার পূর্বপুরুষ হিন্দু ছিলেন, পরবর্তীতে মুসলিম হয়েছেন; সেটার ব্যাখ্যা ওখানে উল্লেখ করা আছে। সংগ্রহশালায় হাছন রাজার ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখে মনে হলো, তিনি এসব ব্যবহার করতেন। তার ব্যবহৃত সব বাদ্যযন্ত্র দেখে মনে হলো, এই সব বাদ্যযন্ত্রে তিনি সুর তুলতেন। তার সৃষ্ট অনেক গান এখনও অমর হয়ে আছে। উপলব্ধি হলো, হাছন রাজার জীবনই অন্য সব মানুষের জীবনের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি। কারণ, প্রতিটি মানুষই তার যৌবনকাল পর্যন্ত কোনো নিয়মের মধ্যে আসতে চায় না, দাপুটে চলাচল করে। কিন্তু, যখন আস্তে আস্তে বয়স বাড়তে থাকে, তখন উন্মাদনাটাও কমে আসে। আচরণ পরিশীলিত হয় এবং তার মধ্যে একটা ভাবের উদয় হয়। একজন ব্যক্তি যৌবনে বিভিন্ন রকম ভাবাদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সেসব ভাবাদর্শের মধ্যে যেটা বেশি প্রবল থাকে পরবর্তী জীবন ও কর্মে সেই ভাবাদর্শ বেশি প্রভাব বিস্তার করে। আগের যে মানুষটা, সেই মানুষটাকে আর আমরা খুঁজে পাই না। নতুন একজন মানুষ ওই ভাবাদর্শ থেকে বের হয়।
হাছন রাজার কাহিনী যতদূর শুনেছি, একসময়ের অত্যাচারী জমিদার পরবর্তীতে হয়ে উঠেছেন মরমী কবি। তার আধ্যাত্মিক চিন্তা-ভাবনা এখন গবেষণার বিষয়। সবমিলিয়ে হাছন রজার বাড়ি দেখার পরে মনে হলো, এই পৃথিবীতে স্রষ্টা সবাইকে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন। যেখানে প্রথমার্ধে মানুষ নিজের মতো করে চিন্তা করে। সে ভাবে যে, আমি আমার মতো করে সবকিছু করব। কিন্তু, পরবর্তীতে দেখা যায়, তার জন্য যা নির্ধারিত বা সৃষ্টিকর্তা তার জন্য যে জীবন রেখেছেন, সেই জীবন যাপন করতেই মানুষ বাধ্য থাকে।
হাছন রাজার বাড়ি দেখে সুনামগঞ্জ থেকে সিলেটের দিকে সড়ক পথে রওনা দিলাম। সেখানের কাজ শেষ করে সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশে বিমানে উঠলাম। বিমানটা যখন শূন্যে উঠল, তখন আমার চিন্তায় অনুরণন তুললো হাছন রাজার গান—‘কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার’।