প্রথমবার ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মন্ডার দোকানে গিয়েছিলাম ১৯৮৫ সালে। দোকানটি আর আগের মতো নেই। সে সময় দোকানে বসে কলাপাতায় মন্ডা খেয়েছিলাম। কাঁসার গ্লাসে পানি দেওয়া হয়েছিল।
এবার গিয়ে দেখলাম মন্ডা খাওয়ার কোনো পিরিচ, গ্লাস বা বাটির ব্যবস্থা নেই। বিক্রির জন্য এক কেজি, দুই কেজি এভাবে কাগজের বাক্সে প্যাকেট করে রাখা হয়েছে মন্ডা। দোকানে বসে যারা খেতে চান তাদের জন্য দুই, তিন, চার বা পাঁচটি করে মন্ডা প্যাকেট করে রাখা হয়েছে। যার যেমন প্রয়োজন তিনি তেমন প্যাকেট কিনে নিচ্ছেন। শোনা যায়, একদম শুরুর দিকে মন্ডা বিক্রি হতো পদ্মপাতায়।
গোপাল পালের প্রসিদ্ধ মন্ডার দোকান হিসেবে খ্যাত এই দোকান প্রতিষ্ঠা পায় ১৮২৪সালে। এই মন্ডার উদ্ভাবক গোপাল পাল। তিনিই প্রথম দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। গোপাল পালের পঞ্চম বংশধর শ্রী রামেন্দ্রনাথ পাল বর্তমানে এই দোকানের মালিক। দোকানটি বেশ বড়, পাশেই আরও বড় পরিসরে দোকান বাড়ানোর কাজ চলছে।
বলতে গেলে, একটি জাতির গৌরব করার মতো অনেক কিছুই থাকে। আর তা যদি হয় মৌলিক কিছু তাহলেতো কথাই নেই। এই বিশ্বায়নের যুগে এক সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটছে। প্রতিযোগিতা চলছে নিজেদের মৌলিক সৃষ্টিসম্ভার নিয়ে বিশ্বমঞ্চে দাঁড়াবার। মৌলিকত্বের অনন্য এক নিদর্শন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মন্ডা।
ময়মনসিংহ সদর থেকে ১৬ কিলোমিটার পশ্চিমে মুক্তাগাছা। ১৯৮৫ সালের পর দীর্ঘ বিরতিতে ২০২৩ সালে দ্বিতীয়বার গিয়েছিলাম প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মন্ডার দোকানে। কাঠের চেয়ার আর ছোট ছোট টেবিল সাজিয়ে রাখা। ক্রেতারা এসে চেয়ারে বসেন, প্রয়োজন অনুযায়ী মন্ডা অর্ডার করেন। তারপর কাগজের ঠোঙায় পরিবেশন করা হয় মন্ডা। ‘গোপাল পালের প্রসিদ্ধ মন্ডার দোকান’-এর ব্যবসা প্রায় ২০০ বছর ধরে বংশানুক্রমে চলছে। ‘মন্ডা তৈরির মূল রেসিপিটা জানেন শুধু গোপাল পালের বংশধরেরা। এই মন্ডার গৌরবের সঙ্গে কোনো প্রতিষ্ঠান নয় বরং পারিবারিক ঐতিহ্য জড়িত। কিন্তু মন্ডার খ্যাতি ছড়িয়ে দিতে অবদান রয়েছে মুক্তাগাছার জমিদারদের।
জানা যায়, গোপাল পাল তার উদ্ভাবিত মন্ডা প্রথমে খাওয়ান মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীকে। জমিদার এই মন্ডার স্বাদে মুগ্ধ হন। এরপর এটি জমিদারবাড়ির দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় জায়গা করে নেয়। শুধু তা-ই নয়, জমিদারবাড়িতে কোনো অতিথি এলে মন্ডা দিয়ে আপ্যায়ন করার রেওয়াজ তৈরি হয়ে যায়। জমিদারেরা উপহার হিসেবে বিশিষ্টজনদের কাছে মন্ডা পাঠাতেন। এভাবেই মুক্তাগাছার ছোট্ট গণ্ডি পেরিয়ে মন্ডার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। দোকানে গেলে চোখে পড়বে প্রতিষ্ঠাতা গোপাল পালের কাঠ খোদাই করা ভাস্কর্য। দারুণ শৈল্পিক আবেদন রয়েছে এতে। দোকানে গেলে মন্ডার ঘ্রাণে মন চনমনে হয়। এই মন্ডা মিঠাই শিল্পীরা আমাদের দেশের গৌরব। যদিও দাবি করা হয় গোপাল পাল স্বপ্নে পেয়েছিলেন মন্ডা তৈরির রেসিপি। এই দাবির আক্ষরিক সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও শৈল্পিক সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন নেই।
মন্ডা কিনে খেলাম আর ফিরে আসার সময় বাসার জন্য দুই কেজি কিনে নিয়ে এলাম। মনে মনে প্রশান্তি এই যে, আসল মন্ডা খাওয়া হলো, কেনা হলো। অন্য যেখানে, যেনামেই মন্ডা বিক্রি হোক না কেনো সেই মন্ডা আর যাইহোক মুক্তাগাছার মন্ডা নয়।