ক'দিন ধরে মনটা ভালো না। শরীরে রাজকীয় অসুখ বাসা বেঁধেছে। আমার ফুসফুসে ক্যানসার। নয় মাস ধরে কেমোথেরাপি নিচ্ছি। আমার নাতি ক্লাস সেভেনে পড়ে। সে শওকত ওসমানের ‘তোলপাড়’ গল্পটি পড়ছে এবং পড়তে পড়তেই আমাকে হঠাৎ করে প্রশ্ন করল- ‘দাদা, একাত্তরে তুমি কী করেছিলে?’ নতির প্রশ্ন শুনে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই। চলে যাই ফ্ল্যাশব্যাক একাত্তরে।
তখন আমার বয়স তেরো। ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমার স্কুল বিন্দুবাসিনী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, টাঙ্গাইল। একাত্তর সালের উত্তাল সেই দিনগুলোর কথা মনে পরলে আজও গা শিউরে ওঠে। আমাদের পাশের বাসায় কয়েকজন কাবুলিওয়ালা থাকতেন। যারা সুদে টাকা ধার দিতেন। মার্চ মাসের মাঝামাঝি তারা দেশ ছেড়ে চলে যান। যাওয়ার সময় তাদের সাইকেলগুলো রেখে যান। তাদের ফেলে যাওয়া সাইকেল নিয়ে আমি আর বাবলু মামা পুরো টাঙ্গাইল শহর টইটই করে ঘুরতাম। পঁচিশে মার্চ বিকেলে যখন আমরা ‘শামসুল হক তোরণ’র কাছে যাই, তখন বাঙালি কিছু আর্মি সেখানে পাহারায় ছিল- তারা আমাদের আটকে দেয়। একটু পর জিপ নিয়ে সেখানে একজন অফিসার আসেন এবং এসেই আমাদেরকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘তোমরা কোথায় যাচ্ছো? তাড়াতাড়ি বাসায় যাও। যে কোনো সময় পাকিস্তানি আর্মি চলে আসতে পারে।’
তার কথা শুনে এবং ধমক খেয় অগত্যা আমরা বাসায় ফিরে আসি। বাসায় এসে দেখি, মা গাট্টি বোচকা বাঁধছেন এবং আমাকে তাড়া দিয়ে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি কর। তোর নানা বাড়ি যাবো আমরা।’ টাঙ্গাইল শহর ছেড়ে চার কিলোমিটার উত্তরে নানা বাড়ি চলে গেলাম। গিয়ে দেখি আমাদের মতো অনেকেই সেখানে রয়েছেন।
মার্চ মাসের ২৭ তারিখ প্রচণ্ড গোলাগুলি। বিপদের আশঙ্কায় নানা বাড়ি থাকতে না পেরে, আরো উত্তরে ‘আইসোরা’ গ্রামে চলে যাই আমরা। সেখানে দুইদিন থেকে আরও উত্তরের ‘গোলোরা’ গ্রামে চলে গেলাম। যেখানে ছিলাম, সেটা ছিল তৎকালীন ঢাকা কলেজের (১৯৭০ সালের) ভিপি নূরু ভাইয়ের বাসা। সেখানে সপ্তাহ দুই থাকার পর আমরা আবার টাঙ্গাইল ফিরে যাই। টাঙ্গাইলে একদিন থেকে পরদিন দাদার বাড়ি মির্জাপুরের ‘বানিয়ারা’ গ্রামে চলে গেলাম। সেখানে আমরা তিন মাসের মতো ছিলাম। তারপর আবার টাঙ্গাইল সদরে চলে যাই।
আমার কিশোর মন তখন কেবলি ছটফট করছিল যুদ্ধ দেখার জন্য। কীভাবে যুদ্ধ দেখবো, কীভাবে যুদ্ধে যাবো- সারা দিন এটাই ভাবতাম। একদিন আমার বন্ধু বেলালকে বললাম, ‘যাবি যুদ্ধ দেখতে?’ বেলাল বললো, ‘হ্যাঁ যাবো।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে তাহলে রেডি থাকিস।’
পরদিন ভোরবেলা বাবার পকেট থেকে পাঁচশ সত্তর টাকা চুরি করে বেলালসহ দুই বন্ধু রওয়ানা দিলাম ঢাকার দিকে। ঢাকায় গিয়ে অনেক ঘুরলাম। যুদ্ধ আর দেখি না। অবশেষে কমলাপুর রেল স্টেশনে গেলাম। সেখান থেকে জামালপুরের ট্রেনে চেপে বসলাম। পরদিন জামালপুর পৌঁছে, টিনের একটা দোতলা হোটেলে রুম নিলাম। দুইদিন থেকে আবার ঢাকার দিকে রওনা দিলাম। ঢাকা গিয়ে, অনেক ঘোরাঘুরি করে, সদরঘাট গিয়ে পৌঁছলাম। বিশাল বড় এক লঞ্চে উঠে বসলাম। পরে জানতে পারলাম ওটার নাম ‘স্টিমার রকেট’ এবং সেটা বরিশাল যাবে।
আমরা দুই বন্ধু রওয়ানা দিলাম বরিশালের দিকে। স্টিমারে আমাদের সমবয়সী একটি ছেলের সঙ্গে পরিচয় হলো। সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। ওর বাবা আমাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলেন, আমরা ঘর পালানো। ভদ্রলোক আমাদের খুব খাতির যত্ন করলেন এবং বরিশাল তার বাসায় নিয়ে গেলেন।
প্রথম দিন তার বাসায় থাকার পরের দিন, আমি আর বেলাল হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চ ঘাট চলে যাই। সেখানে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন রকম লঞ্চ নৌকা দেখি। হঠাৎই জেটিতে বাঁধা একটি বোট থেকে আমাকে একটা লোক হাত ইশারায় ডাক দেয়। তাকে দেখে বুঝতে পারলাম, সেটা আর্মিদের বোট। আস্তে আস্তে বোটে গেলাম। ভদ্রলোক একটি কাঁঠাল দেখিয়ে আমাকে ভাঙতে বললেন। আমি কাঁঠালটা ভেঙে কয়েকটি রোয়া বের করলাম। একটা বোলের উপর যত্ন করে রাখলাম। সে অফিসার সেখান থেকে আমাকেও কয়েকটি খেতে দিলেন। তার সব কথাবার্তা ছিল উর্দুতে। আমিও বাংলা উর্দু মিলিয়ে জবাব দিচ্ছিলাম। পরে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় করলেন।
এরপর আমরা ফিরে যাই যে বাসায় উঠেছিলাম, সেখানে। যাওয়ার পর দেখি ভদ্রলোক একা একা তাস খেলছেন। আমাদের দেখে বলেন, ‘ভাতিজারা আসো, একসঙ্গে তাস খেলি।’ বলেই তিনি তাস বাটা আরম্ভ করলেন। বললেন, ‘চলো টাকা দিয়ে খেলি।’ বেশ কিছুক্ষণ খেলার পর বুঝতে পারলাম, তিনি প্ল্যান করে আমাদেরকে ঠকাচ্ছেন। তাই আর না খেলে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা আবারও লঞ্চঘাটে চলে যাই এবং লঞ্চে করে ঢাকার দিকে রওনা দেই।
ঢাকায় এসে উদভ্রান্তের মতো ঘুরতে থাকি। ঘুরতে ঘুরতে একদিন আবারও কমলাপুর থেকে ট্রেনে চেপে জামালপুর চলে যাই। সেখানে গিয়ে হোটেলে উঠি। রাতে খেয়ে সিনেমা দেখতে যাই। সিনেমা দেখে হোটেলে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন সকালে উঠে দেখি, আমার পাশে আমার বন্ধু বেলাল নাই। ম্যানেজারকে বেলালের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘তোমার বন্ধু তো চলে গেছে।’
আমি জানতাম বেলালের বাড়ি জামালপুর, কিন্তু কোথায় তা জানা ছিল না। ওর জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম, আমার টাকা প্রায় শেষ হওয়ার কারণেই হয়তো বন্ধু আমাকে ছেড়ে চলে গেল! যাই হোক, অগত্যা সেইদিনই আবার ঢাকার ট্রেনে চড়ে ঢাকায় ফিরে যাই। রাস্তায় উদভ্রান্তের মতো হাঁটতে থাকি। কোথায় যাবো, কি করবো, কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না।
গুলিস্তান থেকে একটি বাসে উঠে পড়ি। বাসটি কোথায় যাবে কিচ্ছু জানি না। কিছুক্ষণ পর বাসটি ছেড়ে দিল। যেতে যেতে একটি ফেরি পার হলাম। তারপর আবার রওয়ানা দিলাম। আবার আরেকটি ফেরি। এটা বেশ বড় নদী। নদী পার হওয়ার পর চেক পোস্টে আমাদের বাসকে থামানো হয়। দুজন পাকিস্তানি আর্মি আমাদের বাসে ওঠে। আমাকেসহ আরো পাঁচজনকে বাস থেকে নামায় তারা। নদীর পাড় দিয়ে কিছু দূর হেঁটে একটি ক্যাম্পের কাছে নিয়ে যায় আমাদের। তাবু থেকে অল্প বয়সের এক ক্যাপ্টেন বের হয়ে আসেন। আমাদের ৬ জনকে দেখেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তোমরা বাসে ওঠো।’
আমি ভয়ে ভয়ে গিয়ে বাসে উঠলাম। ওঠার পর সবাই বলাবলি করছিল- ‘ওই পাঁচজনকে এখনই মেরে ফেলবে!’ বাসের কন্টাক্টর বলল, ‘মেরে নদীতে ভাসিয়ে দেবে।’ যাক আল্লাহর রহমতে একটু পর ওদেরকেও ছেড়ে দিল। বাস চলতে চলতে এক গঞ্জে এসে থামলো। আমি বাস থেকে নেমে পড়লাম। নেমেই বমি করলাম। শরীরটা প্রচন্ড খারাপ লাগছিলো। তাই, হাত ইশারায় বাসটিকে চলে যেতে বললাম। পাশে একটা চায়ের দোকান। সেখানে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। তারপর দোকানের বেঞ্চে বসে হঠাৎই অঝোরে কাঁদতে লাগলাম।
আমার কান্না দেখে দোকানদারের মায়া হয়। তিনি জানতে চাইলেন, ‘খোকা তুমি কাঁদছো কেন?’ আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা, ভারত যাবো। যুদ্ধ দেখবো, ট্রেনিং করে যুদ্ধ করবো। তাই মিথ্যে করে বললাম, ‘আমার বাবা-মা ভাই সবাইকে আর্মিরা মেরে ফেলেছে। আমি ভারত যাব। কিভাবে যাব, জানি না। তাই কাঁদছি।’ পাশেই বুড়ো একজন চা দিয়ে বিস্কুট খাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, ‘আমি কালকে আলগি বাজার যাব। সেখান থেকে গয়না নৌকা ভারতে যায়। তুমি ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে যেতে পারো।’ দোকানদারও তার কথায় সুর মিলিয়ে বললেন, ‘হা খোকা, তুমি ওনার সঙ্গে যেতে পারো।’ রাতে তার সঙ্গে ছোট্ট নৌকায় থেকে পরদিন রওনা দিলাম আলগি বাজারের উদ্দেশ্য।
সারাদিন শেষে বিকেলে নৌকাটি আলগি বাজারে গিয়ে ভিড়লো। বুড়ো আমাকে নিয়ে বাজারের কমান্ডারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং আমার বিস্তারিত তাকে জানালেন। কমান্ডার একটি সিমেন্টের বেঞ্চ দেখিয়ে বললেন, ‘তুমি এখানে থাকো। সকালে তোমাকে ডাক দিয়ে দেব।’ তিনি রাতে খাওয়ার জন্য আমাকে কিছু চিড়া এবং গুড় দিলেন। চিড়া গুড় খেয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোরে কমান্ডারের ধাক্কার চোটে ঘুম ভেঙে গেল। কমান্ডার আমাকে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি ওঠো, নৌকা ছেড়ে দিচ্ছে!’
দৌড়ে গিয়ে নৌকায় উঠি। সেখানে অনেক মানুষ। পা রাখার জায়গা নাই। গুলুইয়ে কোনমতে বসার জায়গা পেলাম কিন্তু পা মেলতে পারলাম না। কমান্ডার মাঝিকে বললেন, ‘মাঝি এ আমার লোক, এর কাছ থেকে টাকা নিও না।’ বিকেল তিনটার দিকে এক গ্রামে এসে নৌকা থামে। সবাই নেমে, যার যার মতো খাবারের আয়োজন করতে থাকে। আমি চুপচাপ বসে আছি। নৌকায় থাকা একজন মহিলা মাঝিকে বলল, ‘ছেলেটি চুপচাপ বসে আছে যে!’ তখন মাঝি আমার সম্পর্কে যা জানে, সব ওই মহিলাকে বলেন। শুনে মহিলার দয়া হয়। আমাকে ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খাওয়ায় এবং বলেন, আমি যেনো মনোবল না হারাই।
সন্ধ্যার আগে নৌকা আবার রওনা দিলো। রাত আটটার দিকে মাঝি বললেন, ‘যার যার সাদা শাট আছে, খুলে ফেলেন। সামনে সিএনবি ব্রিজ। ব্রিজের উপরে পাকিস্তানি আর্মিরা পাহারা দেয়। কাজেই বাচ্চারা যেন চিৎকার না করে। কেউ যেন বিড়ি সিগারেট না ধরায়।’ নৌকার মধ্যে মহিলা, বাচ্চাকাচ্চা, বুড়োসহ অনেকে ছিলেন। সবাই শরণার্থী। কোনো চেকিং ছাড়াই আমাদের নৌকা খুবই দ্রুত ব্রিজের নিচ দিয়ে পার হয়ে গেলো। সারারাত যেয়ে পরদিন ভোরবেলা, এক জঙ্গলের ভিতরে আমাদের সবাইকে নামিয়ে দিল। এখানেই আমাদের যাত্রা শেষ।
নৌকা থেকে নেমে উপরে উঠে দেখি, পাকা সড়ক এবং সড়কের মধ্যে তিন চার জন লোক বসে গামছা বিছিয়ে টাকার লেনদেন করছে। আমার কাছে পাকিস্তানি টাকা যা ছিল, তার বিনিময়ে ভারতীয় ২৭ টাকা পেলাম। সেখান থেকে ৫০ পয়সা দিয়ে জিপে করে আগরতলা শহরে যাই। তারপর শহরটা ঘুরতে থাকি। এক জায়গায় বিশাল এক জমিদার বাড়ি দেখি। যার সামনে বিশাল দিঘী। আমি অনেকক্ষণ সেই দিঘীর পাড়ে বসে থাকি। দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পর যখন পেটে খিদে লাগে, তখন হাঁটা দেই। হাঁটতে হাঁটতে একটি সিনেমা হলের পাশে যাই। তার পাশে টিনের একটা হোটেল। সেখানে ভাত খেতে বসি। ভাত খাওয়ার পর হোটেলের মেসিয়ার এসে বলে, ‘জয় বাংলা থেকে এসেছো?’ আমি জবাব না দিয়ে মাথা নাড়লাম। পাশেই এক ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি জানতে চাইলেন, ‘খোকা তোমার বাড়ি কোথায়?’ আমি বললাম, ‘ঢাকা।’ তখন তিনি জানালেন, তার বাড়ি যশোর। তিনি একজন গরুর ডাক্তার। নাম কমল ঘোষ। আমি কোথায় যাবো জানতে চাইলেন। ভদ্রলোকের বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশেরর মতো। আর আমার তেরো। আমি বললাম, ‘কোথায় যাবো তার কোনো ঠিক নেই।’ তখন তিনি বললেন, ‘আমি আসাম যাবো। তুমি ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে যেতে পারো।’ আমি তাকে বললাম, ‘আমি যাব।’
ওই দিনই বিকালে ট্রাকে চেপে বসলাম আমরাসহ আরো অনেক প্যাসেঞ্জার। ট্রাক চলা আরম্ভ করলো। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় ভয় করছিল। 'আঠারো মোড়া' নামের এক জায়গায় খুবই ভয় পেয়েছিলাম। যাই হোক, ‘পানিসাগর’ নামের এক জায়গায় এসে ট্রাক থামলো। এখানে আপাতত আমাদের যাত্রা শেষ। পরদিন আবার ট্রাকে চেপে 'মোহনপুর' নামক জায়গায় যাই। সেখান থেকে ট্রেনে যেতে হবে। ট্রেনের টিকিট কেটে বসে পড়লাম। ট্রেন ছেড়ে দিল। বিকাল বেলাটা 'পাথালকান্দি' নামক এক জায়গায় এসে ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। স্টেশনের উল্টোপাশে একটি টিনের দোতলা হোটেল। নিচে রেস্টুরেন্ট, উপরে থাকার রুম। নিচে খেয়ে, দুজনে সিনেমা দেখতে ঢুকলাম। মনে আছে, সেখানে সেদিন কবরীর ‘জয়বাংলা’ সিনেমাটা দেখেছিলাম।
সিনেমা দেখে আসার পরে শোয়ার আয়োজন করছি। নিচে হোটেলের খাতায় নাম লিখেছি কমল ঘোষ এবং তার ভাই হিসেবে আমার নাম সুবল ঘোষ। একটু তন্দ্রা মত এসেছে, অমনি দরজায় খটখট আওয়াজ। ভয়ে ভয়ে কে? কে? বলতেই, বাইরে থেকে কেউ ভারি গলায় বললো, ‘দরজা খুলুন, আমরা পুলিশের লোক।’ দরজা খুললাম। তারা জানতে চাইলেন, আমরা জয়বাংলা থেকে গিয়েছি কি না? আমরা হ্যাঁ বললাম। তখন পুলিশের একজন বললেন, ‘জয় বাংলা থেকে যারা আসে, তাদেরকে থানায় রিপোর্ট করতে হয়, চলেন থানায়।’ তাদেরকে বললাম ‘সকালবেলা গেলে হয় না?’ তারা বললেন, ‘না, এখনই যেতে হবে। নইলে আমাদের চাকরি থাকবে না।’
অগত্যা ওই রাতেই আমাদের থানায় যেতে হলো। সেখানে গিয়ে দেখি দেড় ফুট চওড়া হাফপ্যান্ট পরা, বগলে ডান্ডা, রসগোল্লার মত চোখ, ফরসা এক দারোগা চেয়ারে বসে আছেন। আমাদের দেখে অন্য পুলিশদের বললেন, ‘স্যার এখন ঘুমিয়ে আছেন। সকালবেলা আসবেন। কাজেই এদেরকে লকাপে ঢুকাও।’ আমি বললাম, ‘আমরা চোর না বাটপার! আমাদের লকাপে ঢুকাবেন কেন?’ চেয়ে দেখলাম, এক কোণায় বিশাল এক টেবিল। সেখানে এক কনস্টেবল মশারি টাঙিয়ে শোয়ার আয়োজন করছে। আমি লাফ দিয়ে তার পায়ের কাছে গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। বুড়া কনস্টেবলের মায়া হলো, তাই কিছু বললেন না। ডা. কমলদা সারারাত বেঞ্চে বসে মশার কামড় খেলেন।
সকাল বেলা ওসি সাহেব আসলেন। এসে বললেন, ‘তোমরা জয় বাংলার লোক? তোমরা কি করো?’ কমলদা জানালেন, তিনি গরুর ডাক্তার। এই এলাকায় প্রতিবছর আসেন এবং গরুর ডাক্তারি করেন। আমি তার ছোট ভাই। ওসি সাহেব দুজনকে দুটো কার্ড দিয়ে দূরে একটা হলুদ বিল্ডিং দেখিয়ে বললেন, ‘ওই বিল্ডিংয়ে যাও দুজন।’ তারপর আমাদের সঙ্গে সেন্ট্রি দিয়ে দিলেন। হাঁটতে হাঁটতে আমরা হলুদ বিল্ডিং এ গেলাম। দেখলাম, সেখানে প্রচুর শরণার্থী বসে আছেন। সামনে এক ভদ্রলোক টেবিল পেতে বসে আছেন। সেন্ট্রি আমাদেরকে ওনার কাছে নিয়ে গেলেন। উনি আমাদের কার্ড নিয়ে আবার দুটো লাল কার্ড দিলেন এবং পাঁচ কেজি চাল, দুই কেজি ডাল, আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।
একটু পর একটা ট্রাক আসলো। সবাইকে ট্রাকে উঠতে বলা হলো। হুড়মুড় করে সবাই ট্রাকে উঠলো। আমিও উঠলাম। ট্রাক ছেড়ে দিল। আশেপাশে কোথাও ডা. কমলদাকে আর খুঁজে পেলাম না। তিনি যে কখন, কোথায় চলে গেছেন টের পাইনি। যাই হোক, ট্রাক চলতে আরম্ভ করলো। যেতে যেতে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে অনেক দূর যেয়ে এক টিলার উপর দাঁড়ালো এবং সবাইকে নামতে বললো। নেমে দেখলাম, সারি সারি ঘর, সবই চা বাগানের কুলিদের ঘর। ওখানে তখন শরণার্থীরা থাকে।
আমি কি করবো, ভেবে পাচ্ছিলাম না। হাতের মধ্যে চাল, ডাল। নিচে তাকিয়ে দেখি ভাঙ্গাচোরা একটা প্রাইমারি স্কুল। সেখানে কিছু লোক রান্না করছে। আস্তে আস্তে তাদের কাছে গেলাম। বুঝতে পারলাম এরা ভারতীয় কোন সিকিউরিটি গার্ড। তাদেরকে আমার রেশনটি দিয়ে বললাম, ‘আমার কোন চালচুলা নেই, আমি একা। আপনারা যখন পাক করছেন, আমাকে এক বেলা খেতে দিয়েন। আমার রেশনটা রাখেন।’ তারা খুব খুশি হলো। আবার আস্তে আস্তে উপরে উঠে এলাম। দেখি রেডক্রসের একটি তাবু। ভিতরে ঢুকে চুপচাপ একটা বেঞ্চে বসলাম। ইয়ং এক ডাক্তার রোগী দেখছেন। পাশেই ৬ ফুট লম্বা ইংরেজদের মত ফর্সা এক ভদ্রলোক ওষুধ দিচ্ছেন। তিনি কম্পাউন্ডার। ডাক্তার আর আগত রোগীদের কথা শুনতে লাগলাম। কথার মধ্যে আঞ্চলিকতার টান শুনে বুঝতে পারলাম ডাক্তারের বাড়ি আমার এলাকার কোথাও। এক পর্যায়ে থাকতে না পেরে, ডাক্তারকে বলে বসলাম, ‘স্যার আপনার বাড়ি কি টাঙ্গাইল?’ ডাক্তার অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘তোমাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখছি। এই ক্যাম্পে যারা আছে তাদের সঙ্গে তোমার কোন মিল নেই। তোমার ঘটনা কি?' তখন তাকে হোটেল থেকে থানা, থানা থেকে এখানে আসা পর্যন্ত সমস্ত কিছু খুলে বললাম। ডাক্তারের বাড়ি টাঙ্গাইল পাকুটিয়া। আমি বললাম, ‘বছর দুই আগে আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়তাম। স্কাউটে জাম্বুরীতে পাকুটিয়া গিয়েছি। ওখানে একটি আশ্রম আছে এবং স্কুলের দুই তিন দিন আমরা সেখানে ছিলাম।’
আমার ফুফার নাম আমজাদ হোসেন, স্থানীয় ডাক্তার। তিনি অবাক হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘আমজাদ স্যার না থাকলে আমি ডাক্তার হতে পারতাম না। উনার অনুপ্রেরণায় আজ আমি ডাক্তার। আমি রোগী দেখে যখন যাবো, তুমি আমার সঙ্গে যাবে।’ দুপুর বেলা ডাক্তারের সঙ্গে খেলাম। বিকেলে ডাক্তারের গাড়িতে ফিরে গেলাম শহরে এবং আল্লাহর কী মর্জি, থানার পাশেই ডাকবাংলায় ডাক্তারের রুমটা বেশ বড়। দুপাশে দুটো খাট। একটি খাট দেখিয়ে বললেন, ‘আজ থেকে তুমি এখানে ঘুমোবে।’
ডাকবাংলার সামনে বিরাট লবি। লবিতে টেবিল। চারপাশে চেয়ার। একপাশে একটি ইজি চেয়ার। রাত্রে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং এসডিও সাহেব এসে আড্ডা বসাতেন। বেশ জম্পেস আড্ডা। ডাক্তার সাহেব আমাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সবাই দেখে অবাক, আমি একা একা কিভাবে অল্প বয়সে যুদ্ধে এসেছি! যাই হোক, পরদিন ডাক্তারের সঙ্গে আবার ক্যাম্পে গেলাম। আমার নতুন চাকরি, রোগী আসলে তাদের নাম লেখা।
এইভাবে প্রায় তিন মাস কেটে গেল কিন্তু আমার মন ছটফট করছে কিভাবে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করবো? ডাক্তারকে বললাম, ‘আমি যুদ্ধে যাব।’ ডাক্তার বললেন, ‘এটাও তো একরকম যুদ্ধ। তুমি যা করছ, তা যুদ্ধেরই শামিল।’ আমি বললাম, ‘না, আমি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করবো।’ অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডাক্তার আমাকে যেতে দিলেন। আমি ক্যাম্পে গেলাম নাম লেখাতে। কিন্তু বয়স কম বলে আমাকে নিতে রাজি হলো না। আমি অনেক কান্নাকাটি করলাম। ক্যাপ্টেনের মন গলাতে পারলাম না। পাশেই ছিল রিক্রুটিং অফিসার। আওয়ামী লীগ নেতা আমির আলী। তিনি বললেন, ‘জানুয়ারি থেকে নতুন করে রিক্রুট করা হবে, তখন তোমাকে নিব। আপাতত তুমি ক্যাম্পে জয়েন করো।’
কী আর করা! যেহেতু স্কাউট ছিলাম, তাই সবাইকে লেফট রাইট, লেফট রাইট শিখাতে শুরু করলাম। এই করতে করতে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে এসে গেল। দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো। আমার আর অস্ত্র ধরা হলো না। আমির আলী আমাকে পুত্রের মত স্নেহ করতেন। উনার সঙ্গে গ্রামের বাড়ি গোলাপগঞ্জ থানার ভাদেশ্বর গ্রামে চলে এলাম। তিনি আমাকে ভাদেশ্বর হাই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে চাইলেন কিন্তু আমার মন মানছিল না।
মার্চের দিকে তাকে বললাম, আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। তিনি নিজে আমাকে নিয়ে টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। টাঙ্গাইল এসে আমার মার হাতে আমাকে দিয়ে গেলেন। আমাকে ফিরে পেয়ে মায়ের কি কান্না! সবাই ভেবেছিল- আমি মারা গেছি। আমি যে বেঁচে আছি, এটা একটি আশ্চর্য ঘটনা ছিল সবার কাছে। যাই হোক, আমির আলী সাহেব মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
আমাদের এলাকার স্বীকৃত যে রাজাকার হিসেবে সবাই চিনতো তার হাতে তখন মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট! এটা দেখে সার্টিফিকেটের প্রতি আমার একটা ঘেন্না ধরে গেলো। সার্টিফিকেট দিতে চাইলেও আমি নিলাম না। এভাবেই কেটে যায় জীবনের অনেকগুলো দিন, মাস, বছর। আমার একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের অধ্যায় এখানেই শেষ।
২০০৫ এ এসে হঠাৎ করে একটি ম্যাগাজিনে ডাক্তার মতিউর রহমানের একটি ফিচার পেলাম এবং পড়ে জানতে পারলাম, উনি ল্যাবএইডে রোগী দেখেন। ক্যাম্পের সেই ডাক্তার, আমার জেলার মানুষ। তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। চেম্বারে ঢোকার আগে, তার অ্যাসিস্ট্যান্টকে বললাম, ‘আমি রোগী না। উনার সঙ্গে একটু ব্যক্তিগত কথা আছে।’ তিনি বললেন, ‘ভেতরে যান, স্যার এখন একাই আছেন।’
ভিতরে ঢুকে দেখি, ডাক্তার সাহেব এক মনে কী যেনো লিখছেন। আমি তার উল্টোপাশে চেয়ারে বসলাম। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে আপনার?’ আমি বললাম, ‘আমাকে চিনতে পেরেছেন?’ তিনি চিনতে পারেননি। আমি চশমা খুলে বললাম, ‘ভালো করে দেখুন। চিনতে পারেন কিনা ‘ তিনি তখনও চিনতে পারলেন না। আমি তখন বললাম, ‘আজ থেকে ৩৪-৩৫ বছর আগে ভারতের পাথালকান্দি সাব ডিভিশনের ডাকবাংলার কথা মনে আছে?’
এবার ডাক্তার মতিউর রহমান লাফ দিয়ে উঠলেন। তারপর ‘হাবিব’ বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কান্না শুরু করলেন। বললেন, ‘এতদিন কোথায় ছিলা তুমি? সে সময়ের সাহসী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা তুমি। কেমন আছো?’ আমি বললাম, ‘ভালো আছি।’ এরপর তিনি আমার পুরো খবর নিলেন। আমি তখন এলিফ্যান্ট রোডে থাকি। তাকে আমার বাসায় নিয়ে যেতে চাই। তিনি যেতে রাজি হলেন। তবে অন্য কোনো সময়।
সপ্তাহখানেক পরে আবার গেলাম। তিনি এবার আমার সঙ্গে আমার দোকান পর্যন্ত এলেন। এরপর হঠাৎ বললেন, ‘চিনে গেলাম। পরে একসময় আসবো। আজকে আমার মতিঝিলে মিটিং আছে।’ এরপর আমারও বিভিন্ন ব্যস্ততায় বেশ অনেকদিন ধরে তার ওখানে যাওয়া হচ্ছিল না। ইলেকশন প্রায় কাছাকাছি। একদিন তার চেম্বারে আবার গেলাম। গিয়ে বললাম, ‘মতি ভাই, আপনার নির্বাচনীয় এলাকা থেকে যিনি দাঁড়ান লোক ভালো কিন্তু জিততে পারেন না। এবার আপনি দাঁড়ান। কারণ আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড আছে।’ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘তোর মুখে ফুল চন্দন পড়ুক।’
কিছুদিন পর পেপারে তার নাম দেখতে পেলাম এবং দেখতে না দেখতেই তিনি নৌকার নমিনেশন পেলেন এবং ভালোভাবেই পাশ করে এলেন। আমিও বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। পরে আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলাম না। হঠাৎ একদিন শুনি, ডা. মতিউর রহমান ওরফে মতি ভাই মারা গেছেন। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কিছুতেই মনটাকে বুঝাতে পারছিলাম না। মতি ভাই আর আমাদের মাঝে নেই! তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘হাবিব আমি তোর সব কাগজপত্র ঠিক করে দেবো।’ কিন্তু তা আর হলো না। সবই কপাল!
যেভাবে হোক, এখনও বেঁচে আছি। কত দিন আর বাঁচবো জানি না। যেহেতু কঠিন রোগে ভুগছি। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। জীবনের শেষ সময়ে এসে একটা ব্যাপারে খটকা গেলো না। আজ পর্যন্ত জানতে পারলাম না, আমি কি একাত্তরের একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা! এই আফসোসটা নিয়েই হয়তো মরে যাবো। আমাকে পৃথিবীর ছেড়ে সহসাই চলে যেতে হচ্ছে। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন।
অনুলিখন: মেসবাহ য়াযাদ