চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে ইতিহাসবিদরা জাতিস্মর বলে থাকেন। এতে আমার কোনো দ্বিমত নেই। তবে ব্যক্তিগত অভিমত আছে। আমার কাছে এই শিল্পী বাঙালি জাতির ভবিষৎ স্বপ্নদ্রষ্টা। যে স্বপ্নে মানুষের কাঙ্ক্ষিত অবয়ব আছে, ফসল ও বৃক্ষ আছে। কিন্তু দারিদ্রতা নেই।
আমরা দেশকে এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ বা স্মার্ট বাংলাদেশ বলছি। এই স্বপ্নটা সুলতান অনেক আগেই দেখেছেন। তার প্রমাণ হচ্ছে সুলতানের চিত্রকর্মগুলো বা শিল্পকর্মগুলো।
বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের ইতিহাসে শুধু নয় গল্প, সিনেমা, নাটকে সাধারণত উপস্থাপন করা হয় দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা, জীর্ণশীর্ণ, আর কৃশকায় মানুষের চেহারা। সুলতান কিন্তু দুর্বল কোনো মানুষের প্রতিকৃতি আঁকেননি। তিনি মানুষের পেশীবহুল হাত, শক্ত সামর্থ্যবান শরীর এঁকেছেন।
তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন শক্তিশালী মানুষ ছাড়া শক্তিশালী দেশ গঠন করা সম্ভব নয়। যে লক্ষ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। যে শক্তির বলে বাংলাদেশ বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। বাঙালির সেই ভেতরগত শক্তি সুলতানের শিল্পে মূর্ত রূপ পেয়েছে।
ভারতচন্দ্র রায়গুণাকারের কবিতার কথা ধরে যদি বলি ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ সুলতানও একই স্বপ্নে বিভোর থেকেছেন। তার রং, তুলিতে আঁকা হয়েছে মায়ের পাশে থাকা সবল শিশুদের চিত্র।
আমরা শিল্পে দারিদ্রতা উপস্থাপন করতে করতে বিশ্ব দরবারে সহজে উপেক্ষিত, দরিদ্র কিংবা তলাবিহীন ঝুড়ির এক অবয়ব হয়ে উঠি । আমাদের দারিদ্রতা, অসহায়ত্বকে সুলতান পুঁজি করেননি। তিনি উল্টো স্রোতে ভেসেছেন। এদেশের মানুষের ভেতরের শক্তিকে বাইরে প্রকাশ করেছেন। এই সুলতানকে আর তার স্বপ্নকে ধারণ করার জন্য যথেষ্ট শক্তি প্রয়োজন। সুলতানের বাড়িটি আর তার ‘শিশু স্বর্গ’ নৌকাটি শিল্পীর স্বপ্নের মূর্ত-বিমূর্ত প্রতীক হয়ে আছে।
শিল্পীর বাড়িটা একেবারে চিত্রা নদী ঘেঁষে। নদীতে ভাসানোর জন্য সুলতান তৈরি করেছিলেন সুন্দরী কাঠের নৌকা। ৬০ ফুট দৈর্ঘ্য, ১৫ ফুট প্রস্থের এই দ্বিতল নৌকায় রয়েছে শোবার ঘর, খাবার ঘর, ছবি আঁকার ঘর, গোসলের ঘর। শিল্পীর স্বপ্ন ছিলো শিশুরা এই নৌকায় ভেসে ভেসে ছবি আঁকবে, সুন্দরবনে যাবে অরণ্যের ছবি আঁকবে। ইচ্ছা ছিল নৌকাটি নির্মাণ শেষ হলে তিনি নৌকায় চড়ে ভারতে যাবেন। সেখানে চিত্রকর্মের প্রদর্শনী করবেন।
এখন হলুদ রঙের নৌকাটি পড়ে আছে ডাঙায়। বরং নদীর একটা ঘাট সুলতানের নৌকা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চিত্রা নদীতে পানির গভীরতা কম। তাতে সুলতানের নৌকা ভাসানো সম্ভব নয়!
যেমনটা সামাজিক এবং মানসিক জায়গা থেকে আমরা সুলতানের স্বপ্নের মতো হয়ে উঠতে পারছি না। চিত্রায় যদি সুলতানের নৌকা ভাসাতে হয় তাহলে নদীটার যত্ন করা দরকার। এটা খনন করা দরকার। দখলদারিত্ব মুক্ত করা দরকার। তবেই নদীতে ভাসবে নৌকা।
আমাদের যে জাতীয় জীবন সেখানে সুলতানের স্বপ্ন পুরোপুরি ধারণ করার মতো ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরাও যেন ওই চিত্রা নদীর মতোই। সুলতানের স্বপ্ন ধারন করার জন্য চিত্রা নদীর বুকে ঢেউ আসুক।
সম্প্রতি গোপালগঞ্জ গিয়েছিলাম। এবারের ভ্রমণ যেন সার্থক হলো। গোপালগঞ্জ ঢোকার মুখে একটি জায়গার নাম ভাটিয়াপাড়া মোড়। তার থেকে একটু দূরেই মধুমতি নদী। মধুমতি নদীতে আগে নৌকা চলতো এখন সেতু তৈরি হয়েছে। তার ফলে নড়াইলের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হয়েছে। ভাটিয়াপাড়া মোড়ে দুপুরে খাচ্ছিলাম। আগে থেকেই ইচ্ছা ছিল যেহেতু এতদূরে আসছি, এস এম সুলতানের বাড়ি আর তার কবর দেখে যাবো।
নড়াইল একটি রাস্তা নির্ভর ছোট শহর। ইদানিং কিছু ফ্লাইওভার হয়েছে, বাইপাস হয়েছে-পরিধি বাড়ছে। শহরটা শুরু হয়েছে প্রশাসনিক ভবন দিয়ে। নড়াইল শহরের পাশ দিয়ে চিত্রা নদীটি বয়ে গেছে। এই শহরটি শেষ হয়েছে এস এম সুলতানের বাড়ি দিয়ে। বাড়িটিতে শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে একটি সংগ্রহশালা ও লাইব্রেরি হয়েছে। এগুলো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি দ্বারা পরিচালিত হয়। বিকালের পর আর বাড়িটিতে ঢোকা যায় না। বিকেল-বিকেলে পৌঁছেছিলাম। একেবারে বন্ধ করার সময় হয়ে এসেছিল। আগে থেকে বলে রাখার কারণে সহজে ঢুকতে পারলাম। তারপরে গ্যালারি দেখলাম, তার কবর দেখলাম। নৌকাটি দেখলাম ঘাটে বাঁধা।
ফিরে আসার সময় মনে হলো সুলতানের নৌকার মতো, তার স্বপ্নের পাশে আমরাও যেন চিত্রা নদী। নিজেদের সমৃদ্ধ অতীত উদ্ধার করা এখন সময়ের দাবি।
এস এম সুলতান স্বপ্ন দেখেছিলেন শক্তিশালী মানুষের দেশ হবে বাংলাদেশ। সেই লক্ষ্যে আমরা যদি আমাদের সমষ্টিগত শক্তি জাগিয়ে তুলতে পারি তবে সেই হবে এস এম সুলতানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো।