সংবাদটি তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি। উত্তরের ঐতিহ্যবাহী বাহাদুরাবাদ ঘাট নিয়ে সেই সংবাদের অর্ধেকটা লিখেছিলেন মাত্র। সরেজমিনে মাঠ ঘুরে আসার পর সংবাদের বাকি অংশ সম্পন্ন করার কথা ছিল। কিন্তু ওটাই যে সরেজমিনে মাঠে যাওয়ার শেষ যাত্রা ছিল, তা কে জানত! বাংলাদেশের গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ একুশে পদকপ্রাপ্ত চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের জীবনের শেষ সংবাদের গল্পটা এমনই।
আজ ২৯ ডিসেম্বর, যেদিন চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অনেক দূরে। ১৯৯৫ সালের এই দিনে যমুনা নদীতে ফেরীর ছাদ থেকে পড়ে প্রাণ হারান তিনি।
আমরা সবাই জানি, মোনাজাতউদ্দিনের জীবনে শেষ সংবাদ সংগ্রহের সরেজমিন এলাকা গাইবান্ধার বাহাদুরাবাদ ঘাট। সারাজীবন যে মানুষটা সরেজমিন সংবাদ সংগ্রহ করে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন, সেই মানুষটার জীবন নিভে গিয়েছিল সরেজমিন সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে। মোনাজাতউদ্দিনের সাংবাদিকতা জীবনের অনেক কাহিনি আমরা তাঁর লেখা জানতে পারলেও শেষ সংবাদের গল্পটা আমরা অনেকেই জানিনা। কেননা, এ গল্পটা লিখে যাওয়ার সুযোগ পাননি মোনাজাতউদ্দিন। গাইবান্ধায় শুনছিলাম সেই গল্পটা। গাইবান্ধা জেলা শহরের সংবাদপত্র এজেন্সির মালিক আবদুর রহমান। অনেক বছর ধরে সংবাদপত্রের ব্যবসা করেন। প্রিয় মোনাজাতউদ্দিন গাইবান্ধা শহরে গেলে রহমান ভাইয়ের দোকানে পা পড়ত না, এমন ঘটনা ঘটেনি কখনোই। এমনকি ওই দোকানে বসে বহু সংবাদও লিখেছেন মোনাজাতউদ্দিন। শেষবার মৃত্যুর আগের দিন (২৮ ডিসেম্বর ১৯৯৫) সন্ধ্যায় মোনাজাতউদ্দিন গাইবান্ধা শহরে গিয়েছিলেন। সেবার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাহাদুরাবাদ ঘাট সরেজমিন পর্যবেক্ষণ এবং রিপোর্ট করা।
মাত্র অল্প কিছুদিন আগে মোনাজাতউদ্দিন দৈনিক সংবাদ ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায়। গাইবান্ধা শহরে পৌঁছে মোনাজাতউদ্দিন গিয়েছিলেন আবদুর রহমানের পত্রিকার দোকানে। গোটা সাংবাদিকতা জীবনে ধূমপানের সাথে ‘সখ্যতা’ গড়লেও জীবনের শেষ সময়ে মোনাজাতউদ্দিন সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলেন, তবে সিগারেট ছাড়ার পর পানের অভ্যেস গড়ে উঠেছিল। বিষয়গুলো আবদুর রহমান সেই আগে থেকেই জানতেন। দোকানে পৌঁছা মাত্র তিনি দোকানের একজনকে দিয়ে একটি পান আনিয়ে মোনাজাত ভাইয়ের দিকে এগিয়ে দিলেন।
আবদুর রহমানের হাতে মোড়ানো পান দেখে মোনাজাতউদ্দিন ক্ষেপে গিয়ে বললেন—‘আমি আপনাকে পান আনাতে বলেছি? আর কখনো এমনটা করবেন না। আমি আপনার পান খাবো না।’ মোনাজাতউদ্দিন সেই পান ফিরিয়ে দিলেন এবং নিজের পকেটের টাকা বের করে আরেকটি পান আনালেন। সেইদিন (মৃত্যুর আগের দিন) ওই টেবিলেই সাদা কাগজে একটি সংবাদ লিখছিলেন মোনাজাতউদ্দিন। কাগজের অর্ধেক অংশ অবধি লিখে থেমে গেলেন। অর্ধেক লেখা সাদা কাগজটি মুড়িয়ে নিজ হাতে দোকানের সেলফের ফাঁকে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন মোনাজাতউদ্দিন।
তিনি লেখার সময়ে এমন কৌশলে সংবাদ লিখতেন, যাতে কেউ না দেখতে পারে। ওইদিন ওই লেখাটিও সেই কৌশলে লিখেছিলেন। সংবাদটির বিষয় কি ছিল, তা স্পষ্ট নয়। তবে ধারণা করা হয়—যেহেতু পরের দিন (যেদিন মৃত্যু ঘটেছে) সচক্ষে ঘটনাস্থলে দেখতে যাবেন, সেহেতু সংবাদটির বিষয় বাহাদুরাবাদ ফেরি সংক্রান্তই হবে। হয়তো আগের রাতে সংবাদের শুরুর অংশটি লিখে কাজটা খানিক এগিয়ে রেখেছিলেন। আবদুর রহমানকে বলে গিয়েছিলেন, এটার দিকে খেয়াল রেখো। কেউ যেন এটা দেখে না। আমি মাঠ থেকে ফিরে সংবাদটি লেখা শেষ করব।
পরের দিন মাঠ-সরেজমিন, তথ্য সংগ্রহ এবং ফিরে এসে অসমাপ্ত সংবাদটি সমাপ্ত করে বগুড়া থেকে ঢাকায় ফ্যাক্স করার পরিকল্পনা ছিল। মোনাজাতউদ্দিনের কথা অনুযায়ী, সব ব্যবস্থা করেছিলেন আবদুর রহমান। মোনাজাতউদ্দিন রাতে পত্রিকার দোকান থেকে যাওয়ার সময় আবদুর রহমানকে বলে গিয়েছিলেন—জামাল হোসেনকে খবর দিতে হবে, যিনি রংপুর গিয়ে সংবাদটি ফ্যাক্স করবেন। সংবাদপত্র জগতে জামাল হোসেন চেনা মুখ। বিশেষত, মোনাজাতউদ্দিনের সংবাদ বাহক হিসাবে বেশ পরিচিত। সেই এনালগ যুগে গাইবান্ধা থেকে সংবাদ প্রেরণে মোনাজাতউদ্দিনকে সাহায্য করতেন জামাল।
মোনাজাতউদ্দিনের লেখা সংবাদগুলো রংপুর গিয়ে ফ্যাক্স করাতেন জামাল। জীবনের ‘শেষবারের মত’ গাইবান্ধা গিয়েও মোনাজাতউদ্দিনের সেই পরিকল্পনাই ছিল। মাঠ থেকে ফিরে যাতে দ্রুত সংবাদটি সম্পন্ন করে যথাসময়ে রংপুর থেকে ফ্যাক্স ধরাতে পারেন—সেজন্য আগেই সংবাদের অর্ধেকটা কাজ সম্পন্ন করে রেখে গিয়েছিলেন আগের রাতে। মোনাজাতউদ্দিন এমনই ছিলেন। যেকোনো সংবাদের পরিকল্পনার দিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন তিনি।
মোনাজাতউদ্দিনের কথামত জামালকে খবর দিয়ে রেখেছিলেন আবদুর রহমান। সে সময় এনালগ যুগে কাউকে খবর দেওয়া খুব কঠিন কাজ ছিল। তবুও আগের অন্য সময়ের মতো সেদিনও মোনাজাতউদ্দিনের কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন আবদুর রহমান। সাংবাদিক না হয়েও পুরোদস্তুর ‘মোনাজাতউদ্দিন ভক্ত’ একজন মানুষ। সব ঠিকঠাক। জামাল আসবে যথা সময়ে, আবদুর রহমান জুম্মার নামাজ পড়ে আগেভাবেই দোকানে আসবেন। কিন্তু কে জানত—বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট সরেজমিনের পর আর কখনোই ফিরবেন না প্রিয় মোনাজাতউদ্দিন! আমাদের সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে যমুনায় ডুব দিলেন তিনি। আমাদের সকলকে কাঁদিয়ে মোনাজাতউদ্দিন চির বিদায় নিলেন। আবদুর রহমানের পত্রিকার দোকানের সেলফের ফাঁকে লুকিয়ে রাখা সেই অসমাপ্ত সংবাদটি আর সমাপ্ত হয়নি। মোনাজাতউদ্দিনের সেই সংবাদটি ফ্যাক্স করার জন্য আর রংপুর যেতে হয়নি জামালকে। এমনকি আর কখনোই সংবাদ ফ্যাক্স করার কাজে জামালকে ডাকবেন না মোনাজাতউদ্দিন।
মোনাজাত উদ্দিনের প্রয়ানের দিনটি ছিল শুক্রবার (২৯ ডিসেম্বর ১৯৯৫)। সেদিন গাইবান্ধা পত্রিকা এজেন্সির মালিক আবদুর রহমান জুম্মার নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। নামাজ পড়ে দ্রুত দোকানে আসার প্রস্তুতি ছিল তার। কেননা মোনাজাতউদ্দিন মাঠ থেকে ফিরে সংবাদের বাকি অংশ লিখবেন। এরপরে সে সংবাদ যাবে বগুড়া, সেখান থেকে ফ্যাক্সে ঢাকা। আবদুর রহমান তখনো জুম্মার নামাজ পড়তে যাননি। এর মধ্যেই তার কাছে দুঃসংবাদটি আসে। তিনি গাইবান্ধার এক সাংবাদিকের (বর্তমানে ঢাকায় কর্মরত) কাছ থেকে মোনাজাতউদ্দিনের দুর্ঘটনার সংবাদটি পান। কিন্তু এমন খবর কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না আবদুর রহমান। বিশ্বাস হওয়ার কথাও নয়। ওই সাংবাদিক জোর দিয়ে তাকে আবারো বলছিলেন—ঘটনা সত্য, আপনি বিটিভির সংবাদ দেখেন। সে সময় তথ্যপ্রযুক্তির এতটা প্রসার ছিল না। অহরহ টিভি সংবাদ দেখার সুযোগও ছিল না। সোশ্যাল মিডিয়ার দাপট ছিল না। আবদুর রহমান বিটিভির সামনে গিয়ে উৎকণ্ঠার দৃষ্টিতে দাঁড়ান এবং স্ক্রলে একটি লাইন দেখে আর বিশ্বাস না করে পারেননি।
ইতিমধ্যে সংবাদটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। পত্রিকা এজেন্সির মালিক আবদুর রহমানও অন্যান্যদের সাথে ছুটে যান বাহাদুরাবাদ ঘাটে। গাইবান্ধা, রংপুর, বগুড়াসহ বিভিন্ন স্থান থেকে সাংবাদিক এবং বিভিন্ন স্তরের মানুষেরা ছুটে যান ঘটনাস্থলে। তারা গিয়ে দেখতে পান ফেরির ওপরে মোনাজাতউদ্দিনের নিথর দেহ। ঘটনার আকস্মিকতায় আবদুর রহমান ভুলে গিয়েছিলেন ঘটনার আগের রাতে মোনাজাতউদ্দিনের লেখা সেই অসমাপ্ত সংবাদটির কথা। যখন মনে পড়ে, তখন থেকে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু সেই অসমাপ্ত সংবাদ লেখা কাগজটি আর খুঁজে পাননি।
চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের ছবি সংগ্রহের গল্পটাও এই গাইবান্ধা শহরেরই। গত বছর ২০২২ সালের নভেম্বরে গাইবান্ধা শহরে গিয়ে মোনাজাতউদ্দিনের একটি ছবির সন্ধান করেছিলাম। ছবি সংগ্রহের সুবাদেই পত্রিকা এজেন্সির মালিক আবদুর রহমানের খোঁজ মিলে। ২০০৩ সালে আমি যখন ভোরের কাগজের জুনিয়র রিপোর্টার, তখন গাইবান্ধা শহরের এই পত্রিকার দোকানটিতে সুন্দর করে বাঁধানো ছিল মোনাজাতউদ্দিনের একটি ছবি। অফিসের অ্যাসাইনমেন্টে মঙ্গা কাভার করতে উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলাম। গাইবান্ধা শহরে হাঁটছিলাম। একটি সংবাদপত্র স্টলে ঢুকলাম। সংবাদপত্র নাড়াচাড়া করতে গিয়ে হঠাৎ চোখ আটকে গেল একটি ফ্রেমে বাঁধানো ছবিতে। ছবির মানুষটি যেন উৎস্যুক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন। হালকা গোলাপী রঙের শার্ট। মনে হয় এইমাত্র চোখ থেকে চশমা খুলে হাতে নিয়েছেন। ছবিটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। বাইরে থেকে বার বার ঘুরে আসছি, আবার ছবিটির দিকে তাকাচ্ছি। তখন এনালগ যুগ। ছবিটি আমার খুব প্রয়োজন হলেও কিছু করার ছিল না।
সেদিন আমি কাউকে বোঝাতে পারিনি এটি আমার প্রিয় মানুষের ছবি এবং এই ছবিটি আমার খুব প্রয়োজন। আরো অনেক আগে থেকে, সাংবাদিকতা জীবনের শুরু থেকে, এই মানুষটিকে আমি অনুসরণ করি। পথ থেকে পথে, কানসোনার মুখ, নিজস্ব রিপোর্ট, লক্ষ্মীটারী—আরো কতগুলো বই লিখেছেন তিনি। উত্তরের ১৬টি জেলা ঘুরে খবর লিখেছেন এই মানুষটি। দৈনিক সংবাদের প্রথম পাতায়, শেষ পাতায়, ভেতরের পাতায়, কত রিপোর্ট পড়েছি তার! একমাত্র লেখার মাধ্যমেই এই মানুষটি আমার অতি নিকটের। জীবদ্দশায় কোনদিন তাঁর সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। সে কারণেই হয়ত গাইবান্ধা শহরে দেখা সেই সুন্দর ছবিটা আমাকে একটা আকর্ষণ করেছিল।
সেই এনালগ যুগে গাইবান্ধা শহরের পত্রিকার দোকান থেকে তখন প্রিয় মোনাজাতউদ্দিনের ছবিটি আমি সংগ্রহ করতে পারিনি। ফিরে এসেছিলাম মনোকষ্ট নিয়ে। এর মাঝে পেরিয়ে গেছে অনেক বছর। ছবিটির কথা প্রায়ই মনে পড়ত। কোন কাজেই পুনরায় গাইবান্ধা যাওয়া হচ্ছিল না। গত নভেম্বরে (২০২২) একটি অ্যাসাইনমেন্টে গাইবান্ধা গিয়ে আবার সেই প্রিয় ছবিটির সন্ধান শুরু করি। আবদুর রহমান এবং তার পত্রিকার দোকান, এসব আমার জানা ছিল না। ২০০৩ সালে আমি একটি পত্রিকার দোকানে মোনাজাতউদ্দিনের ছবিটি দেখেছি, এটুকুই। কিন্তু দোকানের নাম, মালিকের নাম, এসব কিছুই আমার জানা ছিল না। এমনটি পত্রিকার দোকানটির লোকেশনও এত বছরে ভুলে গিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল, পত্রিকার দোকানটি গাইবান্ধার প্রথম আলো প্রতিনিধি শাহাবুল শাহিন তোতা’র। শহরে খোঁজ নিয়ে শাহাবুল শাহিন তোতা’র অফিসের ঠিকানা বের করলাম এবং তাকেই ঘটনাটি খুলে বললাম—মোনাজাতউদ্দিনের সেই ছবিটি আমার চাই। সেখানে কয়েকজন তরুণ আমার কথা শুনছিলেন।
অবশ্য মোনাজাত ভাইয়ের নাম শুনে তারা অবাক হলেন এবং ছবি সন্ধান করার খবর শুনেও তারা কিছুটা আশ্চর্য্য মনে হল। শাহাবুল শাহিন তোতা আমাকে রহমান ভাইয়ের সন্ধান দিলেন। পত্রিকার দোকানের ঠিকানা এবং মোবাইল নাম্বার দিলেন। সেখান থেকে উঠে আসার আগেই উৎস্যুক ওই তরুণেরা গভীর আগ্রহ নিয়ে মোনাজাতউদ্দিনের পরিচয় জানতে চাইলেন শাহাবুল শাহিন তোতা’র কাছে। তিনি ব্যাখ্যা দিলেন। উঠে আসতে আসতে ভাবি, মোনাজাতউদ্দিনের মতো এতবড় একজন গুণী সাংবাদিককে আমরা পরের প্রজন্মের কাছে পৌঁছাতে পারছি না। সাংবাদিকতায় তাঁর আদর্শ ধরে রাখতে পারছি না।
সন্ধান পেয়ে আমি আর দেরি করিনি। রিকশা নিয়ে সোজা গাইবান্ধা জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে পত্রিকার দোকানেই দেখা করি আবদুর রহমান-এর সাথে। তিনি তো দস্তুরমত অবাক। এতদিন পরে একটি ছবির খোঁজে তার কাছে! মোবাইলেই ছবির বিষয়ে আলাপ হয়েছিল। কিন্তু সাক্ষাতে আমি আবারো ব্যাখ্যা করি ছবির প্রসঙ্গ। দোকানের মাঝ বরাবর টানিয়ে রাখা মোনাজাতউদ্দিনের সেই ছবিটি। বাঁধানো ছবিটি নামিয়ে আমার হাতে দিলেন আবদুর রহমান। ধুলো জমে বাঁধানো ফ্রেম ঝাপসা হয়ে গেছে। ভেতরে মূল ছবিটি লেমিনেশন করা ছিল; কিন্তু তারপরও রং ঝলসে গেছে। ছবির ফ্রেমের উপরে কম্পিউটার টাইপে লেখা—‘গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন’। আমি অনেক্ষণ চেয়ে থাকি ছবিটির দিকে অপলক দৃষ্টিতে। আর ভাবি, বেঁচে থাকতে এই প্রিয় মানুষটির সাথে কত কথাই না বলতাম। তাঁকে জানাতাম, আমি দক্ষিণবঙ্গের একজন, আপনার খুব ভক্ত অনুসারী। তাঁকে জানাতাম, স্কুলে অধ্যায়নকালে দৈনিক সংবাদ পুরানো সংখ্যা সংগ্রহ করে আপনার লেখা সংবাদ কেটে খাতায় লাগিয়ে রাখতাম। সংবাদগুলো বার বার পড়তাম। জানাতাম আপনি আমার অধ্যাবসায়, আপনি আমার চর্চা, আপনি আমার আদর্শ।
আমি যখন দেখেছিলাম অনেক বছর আগে, তখন ছবিতে প্রিয় মোনাজাতউদ্দিন একটি হালকা গোলাপী রংয়ের শার্ট পড়েছিলেন। কিন্তু সে রং অনেক আগেই ঝাপসা হয়ে গেছে। সাংবাদিকের বাইরেও বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে মোনাজাত ভাইয়ের ভক্ত আছেন। তাদের মধ্যে একজন রহমান ভাই। যদিও রহমান ভাই কাগজেরই লোক। যৌবনের সংবাদের কথা তার এখনো মনে পড়ে। সংবাদে প্রকাশিত ক্ষুরধার লেখনি থেকেই মোনাজাত ভাইয়ের ভক্ত রহমান ভাই। এক সময় তার পত্রিকার দোকানে মোনাজাত ভাইয়ের একটি ছবি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। এই ছবিটি সংগ্রহ করেছিলেন বগুড়ার ঠান্ডু ভাইয়ের কাছ থেকে।
প্রিয় মোনাজাতউদ্দিনের প্রসঙ্গ উঠতেই দীর্ঘ আলাপ আবদুর রহমানের সাথে। আমাদের আলাপ শেষ হতে চাইছিল না। রহমান ভাইয়ের কাছ থেকে শেষ দিনের গল্পটাই শুনছিলাম অধীর আগ্রহ নিয়ে। আমার ব্যস্ততা, ফিরতে হবে ঢাকায়। আবদুর রহমান বাঁধানো ছবিটির ধুলো সরিয়ে আমার হাতে দিলেন। প্রিয় মোনাজাতউদ্দিনের প্রত্যাশিত সেই ছবিটি হাতে পেয়ে আমি যেন থমকে গিয়েছিলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য। অপলক দৃষ্টিতে তাকাই ছবিটির দিকে, আর মনে মনে কল্পনা করি সেই দিনটির কথা, যেদিন মোনাজাতউদ্দিন আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আমাদের সমৃদ্ধ হওয়ার জন্য প্রিয় মোনাজাতউদ্দিনকে দরকার ছিল আরও বহু বছর, অভিভাবকের আসনে। দুর্ভাগ্য, সেই সৌভাগ্য আমাদের হয়নি।
আবদুর রহমান আমাকে বলছিলেন, দেখুন, ছবিটি আবার কিভাবে রিফ্রেশ করা যায়। আপনি এক কপি নেন, আমাকেও এক কপি দেন। আবদুর রহমান ভাইও যেন ছবিটি রিফ্রেশ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার সময় এবং সুযোগ হচ্ছিলন না। আমাকে পেয়ে তার সেই কাজটিই যেন হল। আমি ছবিটি নিয়ে সোজা হাঁটা দেই গাইবান্ধা শহরের এক স্টুডিওতে। এত পুরানো ছবি- কি করা যাবে! এই কাজটি করতে প্রথমে সায় পেলাম না স্টুডিও মালিকের। পরে মোনাজাতউদ্দিনের নাম-পরিচয় এবং আমার নাম-পরিচয় জেনে স্টুডিও মালিক খানিক বেশিই সময় দিলেন ছবিটি রিফ্রেশ করতে। আমি ভেবেছিলাম, ডিজিটাল যুগে গাইবান্ধা শহরেই ছবিটি আবার ঝকঝকে করতে পারবো। কিন্তু স্টুডিও মালিক অনেক চেস্টা করেও পারলেন না কিছুই করতে। অবশেষে আমি মোনাজাতউদ্দিনের ছবিটি ঢাকায় নিয়ে আসি। ছবিটি তাজা করতে পেরে নিজের কাছেই ভালো লাগছে। আমি ছবির একটি কপি লেমিনেটিং গাইবান্ধায় আবদুর রহমান কুরিয়ার করি। আবদুর রহমান ভাই এবার বড় ফ্রেমে মোনাজাতউদ্দিনের ছবিটি বাঁধাই করে রেখেছেন। মোনাজাত ভাই, আপনি শান্তিতে ঘুমান, আমরা জেগে আছি প্রান্তিকে।
লেখক: ১৯৯৮ সালে চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক