সাতসতেরো

সার্ধশত জন্মবর্ষে বিজ্ঞানী-চিকিৎসক উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী 

ছোটবেলা থেকে কালাজ্বরের একমাত্র ওষুধ ‘ব্রহ্মচারী ইঞ্জেকশন’র নাম শুনে আসছি। এই ওষুধের আবিষ্কর্তা ইউ. এন ব্রহ্মচারীর (উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী) নামও শুনেছি। তিনি তাঁর সময়ে অগ্রগণ্য চিকিৎসাবিদ ও বিজ্ঞানী। 

জানা যায়, রায় বাহাদুর স্যার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, এফআরএসএম, এফআরএস-এর ১৯২২ সালে আবিষ্কৃত ইউরিয়া স্টিবামাইন ভারতের বঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা, অসমসহ অন্যান্য রাজ্যে এবং চীন, গ্রিস, ফ্রান্স, ইটালিসহ এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বহু দেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা করেছে। এই ওষুধ আবিষ্কারের মাত্র ১০ দিন আগে উপেন্দ্রকিশোর রায় মারণব্যাধি কালাজ্বরে প্রাণ হারান। 

১৯২৯ সালে দুবার এবং ১৯৪২ সালে পাঁচবার শারীরতত্ত্ব ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রদানের জন্য ব্রহ্মচারীর নাম সুপারিশ করা হয়েছিল। এই মাপের প্রাতঃস্মরণীয় মানুষটি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রায় অচেনা।  

ভারতের বর্ধমান জেলার সারডাঙ্গা গ্রামে ১৮৭৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর উপেন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন। বাবা নীলমণি ব্রহ্মচারী ভারতীয় পূর্ব রেলওয়ের চিকিৎসক ছিলেন। মার নাম সৌরভ সুন্দরী দেবী। তিনি ১৮৯৩ সালে পূর্ব রেলওয়ের জামালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে স্কুল শিক্ষা সম্পন্ন করে হুগলী মহসিন কলেজ থেকে গণিতশাস্ত্র এবং রসায়নে স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৯৪ সালে রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ১৯০০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবি পাশ করেন। মেডিসিন ও সার্জারিতে রেকর্ডসংখ্যক নম্বর পাওয়ার জন্য তাঁকে গুডইভ ও ম্যাক্লিয়ড পুরস্কার প্রদান করা হয়। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমডি ও পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন যথাক্রমে ১৯০২ ও ১৯০৪ সালে। 

তাঁর নাক্ষত্রিক শিক্ষাজীবন বিস্ময়কর। চিকিৎসাবিদ্যা ও রসায়নে অগাধ পাণ্ডিত্যের মেলবন্ধন ভিন্ন দিক থেকে তাঁকে কালাজ্বরের ওষুধ গবেষণায় প্রভূত সাহায্য করেছে। ব্রহ্মচারী ১৮৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে রাজ্য মেডিক্যাল সার্ভিসে যোগদান করেন। অল্প সময়ের জন্য চিকিৎসক স্যার জেরাল্ড বোমফোর্ডের ওয়ার্ডে হাউস ফিজিসিয়ান হিসাবেও কর্মরত ছিলেন। বোমফোর্ড তরুণ বিজ্ঞানীর গবেষণার ঝোঁক ও কর্তব্যনিষ্ঠা দেখে মুগ্ধ হন। তিনি ১৯০১ সালে উপেন্দ্রনাথকে ঢাকা মেডিক্যাল স্কুলের শারীরতত্ত্ব ও মেটিরিয়া মেডিকার শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেন। এখানে তিনি চার বছর কর্মরত ছিলেন। ১৯০৫ সালে তাঁকে কলকাতায় ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে  (বর্তমান নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল) বদলি করা হলে তিনি মেডিসিনের প্রথম চিকিৎসক রূপে যোগদান করেন।

তাঁর কর্মজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ২০টি বছর তিনি ক্যাম্পবেলেই কাটান। উল্লেখ্য যে, ব্রহ্মচারী ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে. কে চ্যাটার্জি ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসের অধীন না হয়েও কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে নিযুক্তি পেয়েছিলেন। তিনি ১৯২৭ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজের (বর্তমান আর. জি. কর মেজিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল) ট্রপিক্যাল বা উষ্ণমণ্ডলীয় রোগসমূহের বিভাগে প্রফেসরের পদে যোগদান করেন। 

১৯০৫ সালে ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে যোগদানের পর পরবর্তী দুই যুগ তিনি বিরামহীন গবেষণায় নিজেকে নিবেদিত করেন। গবেষণার বিষয়বস্তু মারণব্যাধি কালাজ্বর। এই রোগে মানুষের যকৃত, প্লীহা ও হাড়ের মজ্জা ক্ষতিগ্রস্ত হতো। এই রোগ প্রথমে মুখমণ্ডলে গুটির মতো দেখা যেতো। রোগী দুর্বল হয়ে যেতো ও দেহের ওজন কমতে থাকতো। পরে জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ ধরা পড়তো। দেহের ত্বকের বর্ণ কালো হয়ে যেতো এবং চিকিৎসায় বিলম্ব ঘটলে অধিকাংশ রোগী মারা যেতো।

ব্রিটিশ চিকিৎসকেরা ১৮৭০ সালে রোগটি শনাক্ত করেন এবং একে প্রতিরোধ করার ব্যর্থ চেষ্টা চালান। এ সময় ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গানদীর অববাহিকায় লক্ষ লক্ষ লোক মারা যায়। ১৯০৩ সালে উইলিয়াম লেইশম্যান ও চার্লস ডোনোভ্যান কোলকাতা ও মাদ্রাজের (বর্তমান চেন্নাই) সেনাদের রক্তে ময়নাতদন্ত করে এই রোগসৃজক পরজীবীর সন্ধান পান। ম্যালেরিয়ার উৎস আবিষ্কারক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী স্যার রোনাল্ড রস পরজীবীর নাম রাখেন লেইশম্যানিয়া ডোনোভ্যানি। এই পরজীবীর বাহক হলো স্যান্ড ফ্লাই। এটি মশার আকারের এক চতুর্থাংশ। দেহের রঙ লাল, বাদামি বা ধূসর। এর উৎসস্থল খুঁজে বের করা কষ্টসাধ্য। সাধারণত অরণ্যাঞ্চলের উষ্ণ আবহাওয়ায় এরা জন্মায়। স্যান্ড ফ্লাই  মানুষের দেহ থেকে পরজীবীটাকে সংগ্রহ করে এবং তা আবার মানুষের দেহে সঞ্চালন করে। লেইশম্যানিয়া ডনোম্যানি মূলত লোহিত রক্ত কণিকাকে ভেঙ্গে নানা অপকান্ড করে।

শরীরে কালাজ্বরের লক্ষণ এভাবে প্রকাশ পেত

ব্রহ্মচারীর এই রোগের প্রতিশেধক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক ছিল। ব্রহ্মচারীর জন্য একটি ছোট কক্ষ বরাদ্দ হয়েছিল। কক্ষে জল সরবরাহ, বুনসেন বার্নার ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা ছিল না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নতুন  প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজে গবেষকের জন্য একটি বড় পরিসরের কক্ষ বরাদ্দ করেছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী পালিত প্রফেসর সি. ভি. রামন বাধা দেন এবং কক্ষটি অন্য এক প্রফেসরের এক্স-রে স্পেক্টোগ্রাফি বসানোর জন্য বরাদ্দ করেন। অগত্যা গবেষককে অন্ধকার ছোট কুটুরিতে বসেই গবেষণা করতে হয়।

ব্রহ্মচারী ১৯২০ সালে একটি নূতন যৌগ উদ্ভাবন করেন। এটি প্রয়োগ  করে মৃত্যুর হার শতকরা ১০ ভাগে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়। উল্লেখ্য, তখনো পেনিসিলিন আবিষ্কৃত হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরজীবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো অন্য কোনো অস্ত্রও ছিল না। এটি আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে তা পৃথিবীময় ব্যবহৃত হতে থাকে। গবেষক এক পত্রে জানান, “ আমি  শিয়ালদহের কলকাতা ক্যাম্পবেল হাসপাতালের আমার স্মরণীয় সেই রাতটিকে মনে রাখি, যে রাতে আমার কঠিন পরিশ্রমের ফল আমার প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলতে দেখি। কিন্তু আমি তখনো একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার যে আমার হাতে রয়েছে তার গুরুত্ব টের পাইনি। ছোট এই উপাদান লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য যে জীবনদায়ী হবে ভাবতে পারিনি। যে কক্ষে এর আবিষ্কার সেই কক্ষটিকেও আমি কোনোদিন ভুলবো না। এই কক্ষে আমি গ্যাস পয়েন্ট ও জলের ট্যাপ ছাড়া মাসের পর মাস রাতে কেরোসিনের ল্যাম্পের আলোয় গবেষণা চালিয়েছি। আমার কাছে এই কক্ষ চিরকাল তীর্থক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হবে।’

লন্ডনের ক্যামব্রিজ নিউজ প্রফেসর অশোকা জাহ্নবী প্রসাদ সম্বন্ধে লিখেছিলেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর অবদান ম্যালেরিয়ার পরজীবী আবিষ্কারক রোনাল্ড রস থেকে অনেক বেশি উল্লেখযোগ্য। কালাজ্বর ছাড়াও তিনি ম্যালেরিয়া, ডায়াবেটিস,কুষ্ঠরোগ, গোদরোগ, সিফিলিস, ও ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়েও গবেষণা করেন। তিনিই প্রথম ঢাকা ও কলকাতায় মেয়াদী জ্বর শনাক্ত করেন। স্ত্রী এনোফিলিস মশা এই রোগের পরজীবী বহন করে। কালাজ্বর বিষয়ে তাঁর লেখা গ্রন্থের নাম ‘এ ট্রিটিস অন কালাজ্বর’।

১৯২৭ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পূর্বে তিনি বাসগৃহের এক অংশে ‘ব্রহ্মচারী রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর আবিষ্কৃত ওষুধের ফর্মুলা পারিবারিক গণ্ডির বাইরে প্রকাশ করেননি। প্যাটেন্টও নেননি। কারণ, ওষুধ ব্যবসায়ীরা জনগণ থেকে অধিক অর্থ শোষণ করবেন। তিনি কেবল বাগথেট কোম্পানির মাধ্যমে দেশ-বিদেশে ওষুধ সরবরাহ করতেন। প্যাটেন্ট না নিলেও বাজারি সংস্থাগুলো একই নামে ওষুধ বিক্রি শুরু করলে তাঁকে আইনের আশ্রয় নিতে হয়। তিনি বিভিন্ন হাসপাতালে ওষুধ দান করে, রেডক্রস সোসাইটির মাধ্যমে তার বিবরণ বাংলার গভর্নরের কাছে পাঠাতেন। তাঁর অর্জিত বিশাল অংকের অর্থ তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস, ফিজিওলজিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়া, কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, কোলকাতা ব্লাডব্যাংকে অনুদান হিসাবে নিয়মিত পাঠাতেন। 

উপেন্দ্রনাথ ১৯২৮-২৯ সালে দুই বছরের জন্য এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৩০ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলের সভাপতির ভাষণে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘ভারত, প্রাচীন সভ্যতার দেশ। ক্রমে সে তার লুপ্ত গৌরব উদ্ধার করে সমৃদ্ধ হচ্ছে। সে ফেলে আসা দিনের মতো আবার আনন্দে মেতে ওঠছে। বহু শতাব্দী ধরে যে সকল ব্যাধি অনারোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছিল এবং ভারতে বহু জীবন ধ্বংসের কারণ হয়েছিল, এখন সে সব রোগের ভয়াবহতা হ্রাস পেয়েছে।’

প্রতিকূল পরিস্থিতিতে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী যে কর্মনিষ্ঠা ও শ্রমের সাহায্যে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, চীন, গ্রিস, ফ্রান্সকে এই মারাত্মক ব্যাধিমুক্ত করে দিয়েছিলেন, পৃথিবী কিন্তু তাঁর প্রতি সুবিচার করেনি। যেমন সুবিচার পাননি, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ও বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাঁরা তবু লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি ও আমেরিকান একাডেমি অব সায়েন্স এন্ড আর্টস-এর স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রহ্মচারী বৃটিশ সাম্রাজ্যের ট্রপিক্যাল ডিজিজের সর্বময় কর্তা লিওনার্ড রজার্সের নেতৃত্বে ভারতীয় কতিপয় বিজ্ঞানীর চক্রান্তের শিকার হয়ে উপরিলিখিত সম্মান থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলেন।

বিজ্ঞানীর অন্যতম নেশা ছিল বই কেনা। তিনি একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার গড়ে তুলেছিলেন। এ ছাড়া নানা ফ্যাশনের গাড়ির প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল। লাউডন স্ট্রীটের বাড়িতে নানা জাতের ফার্ন, অর্কিড ও ক্যকটাসের বাগান গড়ে করেছিলেন। জীবনের শেষ ষোল বছর ডায়াবেটিসে ভুগেন। ১৯৪৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রায় ৫০ বছরের সুখী দাম্পত্য জীবনের সঙ্গী ননীবালা ও তিন পুত্র সন্তানকে রেখে তিনি প্রয়াত হন।