বাড়িটির নাম উত্তর তরফ। প্রাচীন এক রেইনট্রি বাড়িটিকে ছায়া দিয়ে ঢেকে রাখে। কবে, কখন বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে জানা যায় না। তবে এতটুকু জানা যায়, জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা হলেন ফতেহদাদ খান গজনভি লোহানি। এই জমিদারদের পূর্ব পুরুষ আফগানিস্তানের গজনী থেকে আসার কারণে তাদের নামের শেষে গজনভি লোহানি খেতাবটি ব্যবহার করতেন। বাড়িটিতে এখনও গজনভীদের বংশধরেরাই বসবাস করছেন। বলছি টাঙ্গাইল জেলার অন্তর্ভুক্ত দেলদুয়ার উপজেলায় অবস্থিত ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ির কথা। নানা কারণে বাড়িটি ঐতিহাসিক মূল্য বহন করছে।
এ বাড়িতে অনেক পর্যটক আসেন। তবে বাড়ির ভেতরে ঢোকা বেশ কষ্টকর। চাইলেই বাড়িটিতে ঢোকা যায় না। এক দুপুরে বাড়িটিতে গেলাম। এই বাড়ির পরিচর্যাকারীদের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন তথ্য পেলাম এবং বাড়িতে ঢুকতে পারলাম। বাড়িটি মোঘল আমলের স্থাপত্যশৈলী বহন করছে। এ বাড়ির ভেতরে রয়েছে পারিবারিক কবরস্থান। মসজিদ, আর মূল বাসভবন। বাড়িতে ঢোকার মূল গেটটা ভেঙে পড়েছে। শুধু দুইটা পিলার দাঁড়িয়ে আছে।
রেইনট্রি গাছটা শতবর্ষী হবে। গাছের কোরলে-কোরলে বাসা বেঁধেছে টিয়া পাখি। আমারতো মনে হলো কয়েকশো টিয়া পাখির বাসা আছে গাছটিতে। খালি চোখে না দেখলে এই সৌন্দর্য বর্ণনা করে বোঝানো সম্ভব না। আর পাখির কূজন শোনার জন্য ওই প্রাচীন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে থাকলে যে সুর কানে বাজে- সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি দেয়। এই প্রাচীন গাছটি বাড়ির মূল ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
শুরুতেই বলছিলাম, চাইলেই এ বাড়িটিতে ঢোকা যায় না। তার কারণ, এক সময় চাইলেই যে কেউ বাড়িতে ঢুকতে পারতো। কিন্তু বাড়িটি নিড়িবিলি হওয়ায়- ওখানে বখাটেদের এক ধরণের আড্ডা হতো। টিকটকাররাও ভিড় জমাতো, বিভিন্ন ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি করতো তারা। এর ফলে বাড়িটিতে এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে বাড়িটি সিসি ক্যামেরার আওতায় আছে। বাড়ির ভেতরে থাকা মসজিদটিও তালাবদ্ধ থাকে। শুধুমাত্র নামাজের সময় খুলে দেওয়া হয়।
জানা যায়, এ জমিদার বাড়ির জমিদারদের মধ্যে দুজন ছিলেন খুবই আলোচিত স্বনামধন্য জমিদার। তারা দানবীর, উচ্চশিক্ষিত ও ব্যবসায়ী। তারা হলেন স্যার আবদুল করিম গজনভি এবং স্যার আবদুল হালিম গজনভি। আব্দুল হাকিম খান গজনভি ও করিমুননেসা খানম চৌধুরানীর সন্তান ছিলেন তারা দুইজন। করিমুননেসা ছিলেন বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত ও কবি বেগম রোকেয়ার বোন। এই বংশের অন্যন্যরা নাকি ঢাকায় থাকেন, আবার অনেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলে গেছেন। তাদের কেউ কেউ এখনও এই বাড়িতে বেড়াতে আসেন।
দেলদুয়ার আগে একটি ইউনিয়ন ছিল। মেজর জেনারেল আতিকের উদ্যোগে এটি উপজেলায় রূপান্তর হয়। মেজর জেনারেল আতিক ছিলেন এই গজনভি জমিদার বাড়ির জামাতা।
১৮৮৫ সালে দেলদুয়ার জমিদার এস্টেটে নায়েব বা ম্যানেজার পদে নিযুক্ত হন প্রথম বাঙালি মুসলিম ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেন। জানা যায়, তিনি এ বাড়িতে বসেই তিনি লিখেছিলেন- জমিদার দর্পণ।
সব মিলিয়ে মুসলিম জমিদারদের স্মৃতিবাহী এ বাড়িটি নিরব, সুন্দর আর মুসলিম আভিজাত্যের এক অনন্য প্রতীক।