ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, নবী কারীম সা. বলেছেন, কোনো ব্যক্তি দীর্ঘপথ ভ্রমণ করে এসে ধুলো ধুসরিত অবস্থায় আকাশের দিকে হাত তুলে বলে, হে আমার প্রতিপালক! হে আমার রব, অথচ তার খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম এবং তার পোশাকও হারাম। সে হারামের মধ্যে লালিত-পালিত। সুতরাং তার দোয়া কবুল হয় কিভাবে?
শুধু দোয়া নয় সকল ইবাদতই কবুল হওয়ার পূর্ব শর্ত হলো: হালাল উপার্জন। ইসলামে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা যারা মাহে রমাযানে গুণাহ মাফ করাতে চাই, জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে চাই তাদেরকে অবশ্যই এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। মাহে রমাযানে এতো ত্যাগ-তীতিক্ষার পরেও যদি কোনো কারণে আমার ইবাদাত কবুল না হয় তবে এরচেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে! মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে আমাদেরকে আদেশ করে বলেছেন: অর্থাৎ-‘হে ঈমানদারগণ তোমরা হালাল বস্তু আহার কর। যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুজি হিসাবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় কর আল্লাহরই, যদি তোমরা তাঁরই বন্দেগি কর। (সূরা বাকারা : ১৭২)
খাদ্য হারাম হয়ে থাকে দুইভাবে। ১. সরাসরি খাদ্যটা হারাম। যেমন: মদ, হারাম প্রাণীর গোশত, হালাল প্রাণীর গোশত কিন্ত সেটা আল্লাহর নামে যবেহ করা হয়নি এমন গোশত ইত্যাদি। ২. উপার্জনটা হারাম হওয়া।
কিতাবে এসেছে, হারাম উপার্জনকারী অবৈধ টাকা দিয়ে হজে গিয়ে যখন বলে, লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক........। তখন সাথে সাথে ফেরেশতা তার মুখের উপর বলে দেয়, দুর্ভাগা! দূর হও। তোর কোনো ‘লাব্বাইক’ নেই। হজে তোর কোনো সৌভাগ্য নেই। তোর হজ তোর মুখের ওপর নিক্ষিপ্ত হোক। (কানযুল উম্মাল)।
ইবনে উমর রা. বলেন: অর্থাৎ-যদি কেউ যদি ১০ দিরহাম দিয়ে কাপড় ক্রয় করে। এর মধ্যে ১ দিরহাম যদি হারাম থাকে তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত সে এই কাপড় পরিহিত থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার ইবাদত কবুল হবে না। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-৫৭৩২)
হারাম উপার্জনকারীর কেবল যে ইবাদত কবুল হয় না কেবল তা নয় বরং সে ইহকাল ও পরোকালে আরও অনেক ক্ষতির সম্মুখিন হবে। যেমন: ১. আল্লাহর রাগ তার ওপর পতীত হয়। রোগ বালাই, বিপদ মুছিবত তার পিছু ছাড়ে না: আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, অর্থাৎ-‘হে ঈমানদারগণ তোমরা হালাল বস্তু আহার কর। যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুজি হিসাবে দান করেছি। সীমলঙ্ঘন করে হারামে প্রবেশ করো না। তাহলে তোমাদের ওপর আমার রাগ ও লা’নত পতীত হবে। আর যার ওপর আমার রাগ পতীত হবে তার সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে।’ (সূরা তহা : ৮১)
২. তার দোয়া কবুল হয় না: বিশিষ্ট সাহাবী আনাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি নবীজী সা. কে বললাম, আপনি আমার জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করেন যেন আল্লাহ তা‘আলা আমার দোয়া কবুল করেন। নবীজি সা. বললেন, হে আনাস! তুমি তোমার উপার্জনকে হালাল করো। কেননা কোনো মানুষ যখন তার মুখের মধ্যে হারাম খাদ্য প্রবেশ করায় তখন থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত তার কোন দোয়া কবুল করা হয় না। (বায়হাকী)
৩. তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত: অর্থাৎ-আবি আইয়াশ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমি নবীজী সা. কে বলতে শুনেছি তিনি বলেন: মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর দেয়া অর্থ সম্পদকে অবৈধভাবে কুক্ষিগত করার জন্য সুযোগ সন্ধানে থাকে। কিয়ামতের দিন তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নাম (বুখারী: ৩১১৮)
৪. হারাম বস্তু দিয়ে গঠিত শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না: হযরত আবু বকর রা. এর একজন চুক্তিবদ্ধ গোলাম ছিল। তার দায়িত্ব ছিল অর্থ উপার্জন করে তা দিয়ে হযরত আবু বকর রা. এর জন্য খাদ্য ক্রয় করা। খলীফা তা গ্রহণ করার পূর্বে খোঁজ নিতেন কিভাবে সে এ অর্থ উপার্জন করেছে? শরীয়া সম্মত হলে হলে তবে গ্রহণ করতেন। অন্যথায় পরিত্যাগ করতেন। একরাতে সে খাদ্য নিয়ে আসলো। আবু বকর রা. সেদিন রোজা রেখেছিলেন। তিনি ভুলবশত জিজ্ঞাসা না করেই খাবার খেয়ে ফেললেন। পরে সন্দেহ হলে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, খাদ্য কিভাবে সংগ্রহ করেছে? সে বলল, আমি জাহিলি যুগে ভাগ্য গণনা করতাম। তবে তখন আমি ভালো গণক ছিলাম না। মানুষকে ধোঁকা দিতাম। আজও তাই করে খাদ্য নিয়ে এসেছি। একথা শুনে হযরত আবু বকর বললেন তোমার জন্য দুঃখ হয়। তুমি আমাকেতো ধ্বংস করে ফেলেছ।
তারপর তিনি তার হাত মুখে ঢুকিয়ে বমি করতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাতে তাঁর বমি হল না। কেউ একজন তাকে বলল পেট ভরে পানি খেয়ে বমি করলে তা বেরিয়ে আসবে। অতঃপর তিনি পানি পান করে বমি করতে লাগলেন। এভাবে বমি করে পেটে যা কিছু ছিল বের করে ফেললেন। কেউ কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এক গ্রাস খাবারের জন্য এতকিছু করার কি প্রয়োজন ছিল? উত্তরে তিনি বললেন যদি প্রাণ বিসর্জন দিয়েও এই খাদ্য বের করতে হতো তা করতে আমি কোনো প্রকার দ্বিধা করতাম না। আমি রাসূল স. কে বলতে শুনেছি যে, যে দেহ হারাম খাদ্যে পুষ্ট তা জাহান্নামের উপযোগী। আমার ভয় হয় হয়তো এ খাদ্য গ্রাস দ্বারা আমার দেহের কিছুটা পুষ্টি সাধিত হবে। ফলে আমাকে জাহান্নামে যেতে হবে। এজন্য হযরত উমর রা. বলেন: অর্থাৎ- হারামের সামান্যতম আশঙ্কায় আমরা ১০ ভাগের ৯ ভাগ হালালও ছেড়ে দেই।
কাজেই মাহে রমাযানে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, বাকি জীবনে একটি পয়সাও হারাম বা অবৈধ উপর্জন করবো না। তাবেই মাহে রমাযানে আমাদের ইবাদত সার্থক হবে। যদি ইতোমধ্যেই আমাদের কারো উপার্জনের মধ্যে হারাম সম্পদ থেকে থাকে তবে একজন হক্কানী আলেমের নিকট থেকে তওবার পদ্ধতি যেনে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্ত জরুরি। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে হালাল উপার্জনে অভ্যস্ত হওয়ার তৌফিক দান করুন, আমীন ইয়ার রব্বাল আলামীন।