পৃথিবীতে প্রতিটি কাজের একটা মৌসুম আছে। মানুষ অন্য সময়ে কাজটি যেভাবে করে মৌসুমে সে কাজটি বিশেষ গুরুত্বের সাথে করে। এটা মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য।
এর বিপরীত করলে লোকটাকে আর যাই বলা হোক বুদ্ধিমান বলা হবে না। রমজানকে আল্লাহ তা’আলা ইবাদতের বিশেষ মৌসুম করেছেন। এজন্যই নবীজী (সা.) রমজানের দুই মাস পূর্ব থেকে সাহাবাদেরকে প্রস্তুত করেছেন এ মাসের জন্য। তিনি কখনও কোনো নির্ধারিত সময় পর্যন্ত হায়াত বৃদ্ধির দোয়া করেননি একমাত্র রমজান ছাড়া। তিনি দোয়া করেছেন এবং আমাদেরকেও এই বলে দোয়া করতে বলেছেন: অর্থাৎ, ‘হে আল্লাহ! আমাদেকে রজব ও শা’বান মাসের বরকত দান করুন এবং রমজান পর্যন্ত হায়াত বৃদ্ধি করে দিন’।
এ মাসের এক ‘কদরের’ রজনীর ইবাদতই হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে উত্তম। নফল আদায় করলে ফরজের সমতুল্য নেকী। আর এক ফরজে ৭০ ফরজের নেকী। বান্দার জন্য এরচেয়ে বড় সুযোগ আর কি হতে পারে! আমরা যদি এর গুরুত্ব বুঝতে পারতাম তাহলে মাহে রমজানের একটি মুহূর্তও ইবাদত ছাড়া নষ্ট করতাম না।
বিখ্যাত সাহাবী হযরত আনাস (রা.) বলেন, রোজা শুরু হওয়ার পর একদা নবীজী (সা.) বলেন, যে মাস তোমাদের নিকট উপস্থিত হয়েছে এতে এক রজনী আছে যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি এ মাসের ফযিলত থেকে বঞ্চিত হলো সে সকল ভালাই থেকে বঞ্চিত হলো। আর এ মাসের কল্যাণ থেকে হতভাগা ছাড়া আর কেউই বঞ্চিত হয় না। (সুনানে ইবনে মাজহ)।
দৈনন্দিন সকল ইবাদতের পাশাপাশি এ মাসের যে সব আমলের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে তাহলো: ১.সিয়াম বা রোজা যথাযথভাবে আদায়ে অধিকতর যত্মবান হওয়া। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি নবীজী (সা.) থেকে শুনেছি তিনি বলেন, আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, বনী আদম তার সকল আমলের প্রতিদান পেয়ে যাবে। তবে রোজা। রোজা আমার জন্য আর এর প্রতিদান আমি নিজেই বা আমি সরাসরি প্রদান করব। (হাদীসে কুদসী, সহীহ বুখারী: ১৯০৪) অন্য এক বর্ণনায় বিশিষ্ট সাহাবী সাহল (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজী (সা.) বলেছেন, জান্নাতের একটি গেটের নাম হলো ‘রাইয়ান’। একমাত্র রোজাদার ছাড়া কেহই এ গেট দিয়ে প্রবেশের অনুমতি পাবে না। সেখানে ঘোষণা করা হবে, রোজাদারগণ কোথায়? অতপর তারা উঠে সে গেট দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদের প্রবেশের পর এ গেট বন্ধ করে দেওয়া হবে। অন্য কেউ আর মর্যাদাপূর্ণ এ গেট দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (সহীহ বুখারী: ১৮৯৬)
২.অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করা। রাসূল (সা.) বিশেষ করে রমজানে অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। কারণ এটা হলো কুরআন নাজিলের মাস। ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রমজানের প্রতি রাতে জিবরাঈল (আ.) নবীজির (সা.) সাথে সাক্ষাৎ করতেন। আর নবী (সা.) তাঁকে কুরআন শোনাতেন। (সহীহ বুখারী: ১৯০২) কিতাবে উল্লেখ আছে: ইমাম আবু হানিফা (রহ.) রমজানে ৬০ বার পবিত্র কুরআন আদ্যপান্ত তিলাওয়াত করতেন। দিনে এক খতম আর রাতে এক খতম পড়তেন।
৩.অধিক দান করা। ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসূল (সা.) ধন-সম্পদ দান করার ব্যাপারে সকলের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। রমজানে যখন জিবরাঈল (আ.) এর সাথে সাক্ষাৎ হতো তখন তিনি আরও বেশি দান করতেন। এ সময় তিনি প্রবাহমান বাতাসের ন্যায় নিরন্তর দান করতে থাকতেন’। (সহীহ বুখারী: ১৯০২)
এছাড়াও আরও যেসব আমলের কথা কুরআন হাদীস এবং পূর্বসূরী ওলামা বুজর্গদের জীবনীতে পাওয়া যায় তা হলো: ৪. অধিক দোয়া করা। ৫. বেশি বেশি ইসতেগফার পড়া ৬. কালেমার জিকির বেশি করা। ৭. বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করা ৮.লাইলাতুল কদর তালাশ করে সে রাতে বিশেষভাবে ইবাদত করা। ৯. সম্ভব হলে শেষের দশকে ইতিকাফ করা। ১০. তাহাজ্জুদের নামাজের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা।
উল্লেখিত এসব আমলের প্রত্যেকটিরই বিশেষ গুরুত্ব ও ফযিলত আছে। কিতাবে চমৎকার এক ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। একদা হাসান বসরী (রহ.) বসে ছিলেন। এক লোক এসে বলল, ‘শায়েখ, আমি অনেক বড় গুনাহগার। আমাকে এ থেকে মুক্তির জন্য কোনো আমল বলে দিন।’ তিনি বললেন, ‘ইসতেগফার করো।’
এরপর এক ব্যক্তি এসে বলল, ‘আমাদের এলাকায় অনেকদিন যাবৎ বৃষ্টি হচ্ছে না, কোনো আমল বাতলে দিন। তিনি বললেন, ‘ইসতেগফার করো।’
আরেকজন এসে বলল, ‘আমি খুবই দরিদ্র, কোনো কাজ-কারবার নেই। অনেক ঋণ হয়ে গেছে। কোনো আমল বলে দিন।’ তিনি বললেন, ‘ইসতেগফার করো।’
আরেক ব্যক্তি এসে বলল, ‘হযরত, দুআ চাই যেন আল্লাহ আমাকে সন্তান দান করেন। তিনি বললেন, ‘ইসতেগফার করো।’
এরপর আরেকজন এসে বলল, ‘আমার একটি বাগান আছে। দুআ চাই যেন ভালো ফল আসে।’ তিনি বললেন, ‘ইসতেগফার করো।’
আরেক লোক এসে বলল, শায়েক, আমার জন্য দুআ করুন যেন ঘরে মিষ্টি পানির ব্যবস্থা হয়। বাড়ির কূপে মিষ্টি পানি মিলে যায়। তিনি বললেন, ‘ইসতেগফার করো।’
তাঁর পাশে থাকা এক ব্যক্তি সব অবলোকন করে অতপর বলল, ‘আপনার কাছে তো আশ্চর্য এক আমল আছে! যেই আসে তাকেই ‘ইসতেগফারের’ আমল দিচ্ছেন!'
তিনি বললেন, দেখো, আল্লাহ তা’আলা কুরআন মাজীদে কি বলছেন! অর্থাৎ-‘অতপর বলছিঃ তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকট ইসতিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। ফলে তিনি তোমাদের উপর বরকতের বৃষ্টিধারা ছেড়ে দিবেন। তোমাদের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন। তোমাদের জন্য শস্য-বাগানের ব্যবস্থা করে দিবেন এবং তোমাদের জন্য নদীনালা প্রবাহিত করবেন’। (সূরা নূহ: ১০-১২)
শুধু এক ইসতেগফারের আমলেই এত সব নেয়ামত লাভ হয়। ইসতেগফার হলো ‘তিরয়াক’ ওষুধ সাদৃশ। আমরা নিয়মিত ইসতেগফার বা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনাসহ মাহে রমজানে বিশেষ আমলগুলো করতে থাকলে আমাদের যাপিত জীবনের মধ্যে আল্লাহ বরকত দান করবেন। দুনিয়া ও আখেরাতের সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবেন। সবচেয়ে বড় বিপদ গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য আমাদের এ আমলগুলো সুরক্ষা প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবে ইনশাআল্লাহ।