সাতসতেরো

দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে যারা রোজাদারদের কষ্ট দেয় তাদের পরিণতি ভয়াবহ 

মানুষকে আল্লাহ তা’আলা জন্মগতভাবেই দুর্বল করে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ভাষ্য হলো: ‘মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে।’ (সূরা নিছা: ২৮) মানুষ জন্ম থেকেই অন্যের উপর নির্ভরশীল। এ নির্ভরশীলতা মৃত্যু পর্যন্ত চলমান থাকে। অন্য প্রাণীরা কিন্তু এমন নয়। জন্মের পর সে নিজেই তার খাবার খুঁজে নেয়। তার স্বাস্থ্য সুরক্ষা অনেকটা নিজেকে করতে হয়। 

মানুষের দুর্বলতা দৈনন্দিন জীবনে প্রতিক্ষণে সে অনুভব করে। ফলে মানুষকে পরস্পর সহযোগিতার মাধ্যমে জীবন পরিচালনা করতে হয়। এক্ষেত্রে উত্তম সেই, যে অন্যের থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা নেবে এবং নিজেকেও অপরের কল্যাণে বিলিয়ে দেবে। সাহাবায়ে কিরাম (রা.) এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে: ‘তাঁরা অভাবগ্রস্ত হওয়ার পরেও অপররের প্রয়োজনিয়তাকে অগ্রাধিকার দেয়। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত তারাই সফলকাম।’ (সূরা হাশর: ০৯)

একবার  রাসূল (সা.)-এর কাছে এক সাহাবি এসে নিজের ক্ষুধার কথা জানালেন। নবীজি (সা.) সাথে সাথে নিজ ঘরে গিয়ে কিছু না পেয়ে ফিরে এসে সাহাবায়ে কেরামকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কি আছো যে আজ রাতে তাকে খাওয়াতে পারবে? তখন এক আনসারী সাহাবি বললেন, আমি খাওয়াব। সাহাবির নিজের ঘরেই ছিল খাবার সঙ্কট। একজন খেতে পারে এতটুকু খাবারই কেবল অবশিষ্ট ছিল। তবুও তিনি লোকটিকে তার বাসায় নিয়ে গেলেন এবং স্ত্রীকে বললেন, এই লোক নবীজি (সা.)-এর মেহমান। আমাদের সাধ্যমতো তাকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। স্ত্রী বলল, ঘরে যা খাবার আছে তা যথেষ্ট পরিমাণ নয়! তাছাড়া বাচ্চারাও ক্ষুধার্ত। স্ত্রীর কথা শুনে সাহাবি বললেন, বাচ্চাদের না খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও। আমি মেহমান নিয়ে খেতে বসলে তুমি বাহানা করে ঘরের বাতি নিভিয়ে দেবে। আমি তার সাথে বসে খাওয়ার ভান করবো। ফলে মেহমান বুঝতে পারবে না যে, আমি খাচ্ছি না। ফলে এ খাবার মেহমান তৃপ্তি সহকারে খেতে পারবে। স্ত্রী তার কথামতই সব করলো। 

এভাবে অন্যকে খাওয়াতে গিয়ে পুরো পরিবার না খেয়ে রাত কাটাল। আল্লাহ তা’আলার কাছে এ কাজটি এতো পছন্দ হয়েছে যে, তাঁদের এ উত্তম কাজের বিনিময়ে তাঁদের প্রশংসা করে সূরা হাশরের উল্লেখিত আয়াত নাজিল করলেন। (তাফসীরে তাবারী) হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ওই ব্যক্তি পরিপূর্ণ মুমিন নয়, যে তৃপ্তি সহকারে আহার করে আর তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম)

হযরত আবু হোরায়রা রা. বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি কোনো মুমিন ব্যক্তির দুনিয়ার অসুবিধা লাঘব করবে আল্লাহ তা’আলা পরকালে তার সমস্যা লাঘব করে দেবেন।… আল্লাহ তা’আলা ঐ বান্দার কল্যাণ করবেন যে তার ভাইয়ের কল্যাণে কাজ করবে। (সহীহ মুসলিম) জাহান্নামীদের মধ্য থেকে সর্বশেষ ব্যক্তিকে জান্নাতে দেয়ার পর জান্নাতিরা পরস্পর আলোচনা করবে কিছুসংখ্যক মানুষ এরা এখনো কেন জাহান্নামে? তখন জাহান্নামীরা তাদের ৪টি বৈশিষ্ট্যের কথা বলবে। কুরআনে আল্লাহ তা’আলা তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করেছেন এভাবে: অর্থাৎ- ‘তোমাদেরকে কি কারণে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়েছে? তারা বলবে, ১. আমরা নামাজ পড়তাম না। ২. আমরা অভাবগ্রস্তদের আহার দিতাম না ৩. আমরা সমালোচকদের সাথে (ইসলামের) বিরোধিতা করতাম এবং ৪. আমরা প্রতিদান দিবস (কেয়ামত দিবস) কে অস্বীকার করতাম আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত। (সূরা মুদ্দাস্সির: ৪১-৪৭)

অপর দিকে যারা মানুষকে আহারের ব্যবস্থা করবে তাদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে: অর্থ: ‘তারা আল্লাহর প্রেমে অসহায় ও বন্দীকে আহার্য দান করে। তারা বলে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমরা তোমাদের আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না। আমরা আমাদের পালনকর্তার তরফ থেকে এক ভীতিপ্রদ ভয়ঙ্কর দিনের ভয় রাখি। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে সেদিনের (কিয়ামতের) অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন এবং তাদের দেবেন সজীবতা ও আনন্দ। তাদের সবরের প্রতিদানে তাদের দেবেন জান্নাত ও রেশমী পোশাক। তারা সেখানে সিংহাসনে হেলান দিয়ে বসবে। সেখানে রৌদ্র ও শৈত্য অনুভব করবে না। জান্নাতের বৃক্ষছায়া তাদের উপর ঝুঁকে থাকবে এবং ফলসমূহ তাদের আয়ত্তাধীন রাখা হবে।’ (সূরা দাহর: ০৮-১৪)

এ সব সুসংবাদের কারণে সাহাবায়ে কেরাম সদা নিজেদের মানব কল্যাণে নিয়োজিত রাখতেন। সুযোগ পেলেই এ সুযোগ লুফে নিতেন। এমন এক ঘটনা: একবার ইবনে আব্বাস (রা.) মসজিদে নববীতে ইতেকাফরত ছিলেন। এমন সময় এক লোক তাঁর কাছে এসে সালাম দিয়ে চুপ করে বসে পড়ল। ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, কী ব্যাপার, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুবই চিন্তিত! জবাবে লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুলের চাচাতো ভাই! নিশ্চয়ই আমি খুব চিন্তিত ও পেরেশান। কেননা, অমুক ব্যক্তির কাছে আমি ঋণী আছি। তারপর সে রাসুল (সা.) এর রওজা শরিফের দিকে ইশারা করে বলল, এই কবর ওয়ালার ইজ্জতের কসম! এই ঋণ আদায় করার সামর্থ্য আমার নেই। ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, আমি কি তাঁর কাছে তোমার জন্য সুপারিশ করব? লোকটি বলল, আপনি যা ভালো মনে করেন। এ কথা শুনে ইবনে আব্বাস (রা.) জুতা পরে মসজিদের বাইরে এলেন। লোকটি বলল, হজরত, আপনি কি ইতেকাফের কথা ভুলে গেছেন?

তিনি বললেন, না ভুলি নাই। তবে খুব বেশি দিনের কথা নয়। আমি এই কবর ওয়ালার কাছ থেকে শুনেছি (এই কথা বলার সময় ইবনে আব্বাসের চক্ষু দিয়ে অশ্রু ঝরছিল), যে ব্যক্তি নিজে অন্য কোনো মুসলমান ভাইয়ের কোনো প্রয়োজনে চলাফেরা করবে এবং তার জন্য চেষ্টা করবে, তা তার জন্য ১০ বছর ইতেকাফ করার চেয়েও উত্তম হবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিন ইতেকাফ করে আল্লাহ তার মধ্যে ও জাহান্নামের মধ্যে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন। যার দূরত্ব আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী দূরত্ব হতেও অধিক। (এক দিনের ইতেকাফের ফজিলতই যখন এরূপ, তখন ১০ বছর ইতেকাফের ফজিলত কী পরিমাণ হবে?) (তাবরানি, বায়হাকি, হাকেম ও তারগিব)

সম্মানিত পাঠক! নবীজি (সা.) তাঁর এক বর্ণনায় বলেছেন, রমজান হলো সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মাস। কাজেই এ মাসে বিশেষভাবে মানুষের প্রতি সদয় হওয়া আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। আমাদের প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মীসহ সবার খোঁজখবর নেয়া, সাধ্যমত তাদের সহযোগিতা করা আমাদের কর্তব্য। যারা নানাভাবে মানুষকে কষ্ট দেয়, বিশেষ করে রোজার মাসেও দ্রব্যমূল্য ইচ্ছাকৃত বাড়িয়ে দিয়ে রোজাদারদের কষ্ট দেয় তাদের পরিণতি যে কত ভয়াবহ হবে, উপরে উল্লেখিত আলোচনা থেকে কিছুটা হলেও বোঝা যায়। বহু রোজাদার আছেন যারা উচ্চ দ্রব্যমূল্যের কারণে সেহরি-ইফতারীতে একটু পছন্দের খাবার জোগাড় করতে পারেন না। তাদের ছোট্ট ছোট্ট সন্তানের আবদার রক্ষা করতে না পেরে তাদের অগোচরে অঝোরে কাঁদেন। এদের বদদোয়া থেকে রক্ষা পাবেন না সিন্ডিকেটকারীরা।

এর বিপরীতে ভালোটা করলে তাদের ব্যাপারে রাসূল (সা.) সুসংবাদ দিয়ে বলেছেন: সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার তুল্য। সৃষ্টিকুলের মধ্যে সেই আল্লাহর নিকট প্রিয়, যে আল্লাহর সৃষ্টির সঙ্গে ভালোটা করবে। (বায়হাকী: ৭৪৪৪) আল্লাহ তা’আলা আমাদের ভালোটা করার তৌফিক দিন, আমীন।