সাতসতেরো

সন্তানদের দায় একাই বইছেন মর্জিনা 

মর্জিনার বয়স ৪০ বছরের কাছাকাছি। তিনি তিন সন্তানের মা। এই সন্তানদের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তাদের বড় করার ভার একাই বইতে হচ্ছে মর্জিনাকে। অর্থ-বিত্তহীন মর্জিনার পক্ষে একা এই দায়িত্ব পালন করা দুঃসাধ্য, কিন্তু তিনি হার মানতে চান না।

মর্জিনার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার জারুয়া গ্রামে। তার বাবার সহায়-সম্পত্তি বলতে ভিটেটুকু। দুই কাঠা জমিতে তার বাবা-মা, দুই ভাই ও তাদের স্ত্রী-সন্তানরা গাদাগাদি করে বসবাস করেন। ভাইয়েরা টুকটাক ব্যবসা আর অন্যের খেতে কাজ করে সংসার চালান। বাবা এখন আর কাজ করতে পারেন না। মর্জিনারা দুই বোন মিলে বাবা-মার পরার কাপড় এবং ওষুধ কেনার টাকা দেন।

পাশের গ্রাম মাটিচাপুরের সামাদ হোসেনের সঙ্গে পারিবারিক পছন্দে মর্জিনার বিয়ে হয়। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য ছিল ১৭-১৮ বছর। সামাদ তখন চট্টগ্রামে বেকারিতে চাকরি করতেন। বিয়ের পর মর্জিনাকে তিনি চট্টগ্রামে নিয়ে যান। সেখানে ছিল তাদের সুখের সংসার।

বিযের পর মর্জিনার কোলজুড়ে একে একে আসে তিন সন্তান। দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েটি সবার ছোট। চট্টগ্রামে ২০ বছর স্বামীর সঙ্গে সংসারে অনেক উত্থান-পতন দেখেছেন মর্জিনা। এক পর্যায়ে সামাদ বেকারি কারখানার চাকরি ছেলে বেকারিপণ্য দোকানে দোকানে সরবরাহের ব্যবসা শুরু করেন। সামাদ তার ব্যবহৃত সিটিসেল কোম্পানির মোবাইল ফোন সেট ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করে একটি বাইসাইকেল এবং কাঠের বাকস কেনেন। প্রথমে বাইসাইকেলে করে দোকানে দোকানে পণ্য দিতেন। ধীরে ধীরে ব্যবসায় উন্নতি হতে থাকে। বেকারি কোম্পানি তাকে একটি  ভ্যানগাড়ি দেয়। আয়ও বাড়ে। তখন সামাদ গ্রামের বাড়িতে বাবা-মায়ের দেখাশোনা, ভাই-বোনদের বিয়ে দেওয়া বা আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতা করতে থাকেন। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে-দুঃখে দিনগুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিল মর্জিনার।

২০১৫ সালে এক রাতে আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে সামাদ মারা যান। সামাদ যখন মারা যান, তখন কোনো অর্থ রেখে যেতে পারেননি। বরং ১০ হাজার টাকা ঋণে ছিলেন। সামাদের মৃত্যুর বছরখানেক আগে তার টিবি রোগ ধরা পড়ে। অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এর পর চিকিৎসার করাতে ২-৩ লাখ টাকা ঋণ হয়ে যায়। কয়েক মাসের চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে যান। তখন আবার ব্যবসা করে সেই ঋণ পরিশোধ করে সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে শুরু করেছিলেন। সেই সময় তার মৃত্যু হয়।

যখন স্বামী মারা যান, তখন মর্জিনার হাতে মাত্র ৩০০ টাকা ছিল। ঋণ ছিল ১০ হাজার টাকা। সন্তানরা ছোট। বড় ছেলের বয়স ১০-১১ বছর, আর সবার ছোট মেয়ের ৩-৪ বছর। দিশেহারা হয়ে পড়েন মর্জিনা। গ্রামের বাড়ি থেকে ২০ হাজার টাকা জোগাড় করে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া দিয়ে স্বামীর লাশ গ্রামে নিয়ে দাফন করেন। এর পর ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে তিনি চট্টগ্রামে ফিরে যান। কিন্তু, তিনি বুঝতে পারছিলেন না, কী করবেন?

মর্জিনা প্রথমে বাসায় কিছু আসবাবপত্র বিক্রি করে ঋণ শোধ করেন। এর পর সন্তানদের নিয়ে খেয়ে-না খেয়ে দিন কাটতে থাকে। স্বামী আয় করে সংসার সামলেছেন। স্বামী-সন্তান, সংসারের বাইরে তিনি কিছু জানতেন না তিনি। বাইরের জগত তার কাছে অজানা। জানেন না, কীভাবে আয় করতে হয়? দুশ্চিন্তায় তিনি মাঝে মাঝে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। এমনও দিন গেছে, না খেয়ে সন্তানদের নিয়ে ঘরের দরজা আটকে বসে থেকেছেন। প্রতিবেশীরা খোঁজ নিয়ে যৎসামান্য খাবার দিয়েছেন, তা সন্তানদের মুখে তুলে দিয়েছেন।

এভাবে চট্টগ্রামে ৬-৭ মাস ছিলেন মর্জিনা। এর পর সন্তানদের গ্রামের বাড়িতে রেখে দূর-সম্পর্কের বোনের ঢাকার বাসায় চলে আসেন। এর পর এক মাস এক ঘরে বোনের সংসারে ছিলেন তিনি। এই এক মাসে অন্যের বাড়িতে কাজ করে চট্টগ্রামে গিয়ে বাসা ভাড়া শোধ করে বাকি আসবাবপত্র নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। এর পর শুরু হয় তার আরেক সংগ্রাম।

ঢাকায় বোনের সহযোগিতায় একটি রুম ভাড়া নেন। সন্তানদের গ্রাম থেকে নিয়ে আসেন। তিনি অন্যের বাসায় কাজ করে মাসে ৩-৪ হাজার টাকা আয় করতেন। তা দিয়ে সন্তানদের নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটতে থাকে।

মর্জিনার এভাবে ঢাকায় কেটে গেছে ৮ বছর। মর্জিনা নিজে লেখাপড়া শিখতে পারেননি। একসময় স্বপ্ন দেখতেন, সন্তানদের লেখাপড়া শেখাবেন। স্বামীর মৃত্যুতে তা আর হয়নি। সন্তানেরা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। বড় ছেলে দোকানে কাজ করে কিছু আয় করছিল। কিন্তু বছরখানেক হলো বিয়ে করে বউ নিয়ে আলাদা থাকছে। ছোট ছেলে হোটেলে কাজ নিয়েছে। কিন্তু, এখনও বেতন পায় না। মেয়েটা একটা বাসায় থাকে। মর্জিনা অন্যের বাসায় কাজ করে ১০ হাজার টাকা আয় করেন। বাসা ভাড়া দিতে হয় ৪ হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়ে মা-ছেলের অভাব-অনটনে দিন কেটে যায়।

মর্জিনা এখন খুব একা। কথা বলার মতো পাশে কেউ নেই। তিনি জানেন না আগামীর দিনগুলো কীভাবে কাটবে। তিনি বুঝে গেছেন, হয়ত আর কয়েক বছরের মধ্যে ছোট ছেলেটা বিয়ে করে তার সংসারে চলে যাবে। মেয়েরও বয়স হচ্ছে, তাকেও বিয়ে দিতে হবে। তার পর তার কী হবে?

মর্জিনা জানান, তার বয়স বাড়ছে। আগের মতো কাজ করতে পারেন না। শরীর-মন সায় দেয় না। ইদানিং শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। রোগ-ব্যাধি বাড়ছে। ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারেন না। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়ে গ্রামে ফিরে যাবেন। কিন্তু, সেখানে থাকার ঘরও নেই। খাবেন কী, তাও জানেন না তিনি।