বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রেলওয়ে যোগাযোগ শুরুর সাক্ষ্য বহন করছে কুষ্টিয়ার জগতি স্টেশন। এক সময়ের সরব স্টেশনটি এখন অনেকটাই নিরব। কিন্তু বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমবিকাশের ইতিহাসে এটি অপরিহার্য একটি নাম। জেমস ওয়াট বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরি করার আগ পর্যন্ত মানুষ জলপথে যাতায়াত করতো। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের প্রথম সফল বাস্তবায়ন হচ্ছে রেলগাড়ি। সেই বিচারে অধুনাবিশ্বের প্রাচীনতম যানবাহন হচ্ছে ট্রেন। এই বাহনটির সঙ্গে সভ্যতা বিকাশের ইতিহাস জড়িত।
জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে কলকাতার শিয়ালদহ থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য ১৮৬২ সালে জগতি স্টেশনটি চালু করা হয়। তার আগে ১৮৪৪ সালে আর. এম স্টিফেনসন কলকাতার কাছে হাওড়া থেকে পশ্চিম বাংলার কয়লাখনি সমৃদ্ধ রানীগঞ্জ শহর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করার উদ্যোগ নেয়। এ জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি গঠন করা হয়। ওই কোম্পানি ১৮৫৪ সালে হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার রেললাইন চালু করে। পরে ১৮৬২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কলকাতা থেকে রাণাঘাট পর্যন্ত রেলপথ চালু করে। এরপরে ওই রেললাইনকেই বর্ধিত করে ওই বছরের ১৫ নভেম্বর কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত ৫৩.১১ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন শাখা উন্মোচন করা হয়।
সে সময় অবিভক্ত ভারতের নদীয়া জেলার অংশ ছিল কুষ্টিয়া। এই অঞ্চলের ইতিহাসকে অনেকাংশে সমৃদ্ধ করেছে জগতি রেলওয়ে স্টেশন। এর আশেপাশের অবস্থা এখন প্রায় পরিত্যক্ত।শুধুমাত্র দুইটি লোকাল ট্রেন ধরে। তাছাড়া মাঝে মাঝে ভারত থেকে কয়লা এবং পাথরবাহী মালগাড়ি আসলে ওই স্টেশনে অনেক সময় সেগুলো খালাস হয়। তবে স্টেশন পরিচালনা করার জন্য কোনো লোকজন নেই।
আমার অনেক আগে থেকেই জানা ছিল বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রথম রেলস্টেশন জগতি। ঢাকার সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর করতে এই স্টেশনটি দীর্ঘদিন ব্যবহৃত হতো। ১৮৭১ সালের ১জানুয়ারি জগতি থেকে বর্তমান গোয়ালন্দঘাট পর্যন্ত রেললাইন চালু করা হয়। মানুষ কলকাতা থেকে ট্রেনযোগে জগতি স্টেশন হয়ে গোয়ালন্দঘাটে যেতেন। সেখান থেকে স্টিমারে পদ্মানদী পার হয়ে যেতেন ঢাকায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও আধুনিক হয়েছে।
প্রয়োজন কমেছে জগতি স্টেশনের। তবে বিকেল হলেই স্টেশনটি একটি পর্যটন কেন্দ্রে রূপ নেয়! অনেকেই বেড়াতে আসেন। এখানে একটি জলাধারও রয়েছে। এক সময় এই জলাধারের পানি ট্রেনে নানা কাজে ব্যাবহৃত হতো। লাল ইটে গাঁথা জগতি স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়ন্ত বিকেলের আলোয় দেখলাম স্টেশনের জলাধারটি পরিত্যক্ত। ওখানে জন্ম নিয়েছে অনেক গাছ। মানে প্রকৃতি পুনর্দখল দখল করেছে তার জায়গা। প্রকৃতির ধরনই এমন মানুষ তার জায়গা দখল করে নিলে সেও আবার সুযোগ পেলেই নিজেদের জায়গা পুনর্দখল করে। এখানে তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে। অনাদরে দাঁড়িয়ে থাকা জগতি স্টেশন তবু এই ভূখণ্ডের যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমবিকাশের ইতিহাসে একটি অপরিহার্য নাম।