বাংলা সাহিত্যের জননন্দিত কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, গীতিকার, চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদের ঢাকার ধানমন্ডিতে অবস্থিত বাড়ির নাম ‘দখিন হাওয়া’। ৩৪৫টি জনপ্রিয় গ্রন্থের প্রণেতা হুমায়ূন আহমেদের এই বাড়িতে একদিন আড্ডা দিতে গিয়েছিলাম, সেটি তাঁর মৃত্যুর কিছু দিন আগে। আমি ও আমার অগ্রজ কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল তাঁর ফ্ল্যাটের কলিংবেল চাপতেই গৃহকর্মী দরজা খুলে দিয়ে বলল, আপনারা বসেন, স্যার আইতাছে। আমরা সোফায় গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পরে হুমায়ূন আহমেদ ভিতরের কক্ষ থেকে বের হয়ে এলেন, আমরা কুশল বিনিময় করে তাঁকে সোফায় বসতে বললাম, তিনি সেখানে না বসে বললেন, তোমরা বসো আমিও বসছি, আমার বসার ব্যবস্থা হচ্ছে। আমরা একটু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলাম, এরইমধ্যে গৃহকর্মী একটি লম্বা শীতলপাটি এনে বিছিয়ে দিলো, লুঙ্গি ও হাওয়াই শার্ট পরা হুমায়ূন ভাই সেই বিছানো পাটিতে গিয়ে বসলেন। আমরা বললাম, হুমায়ূন ভাই আপনি নিচে বসলেন কেন? উত্তরে বললেন, আমি সবসময় শীতলপাটি বিছিয়ে নিচেই বসি, এতে অনেক আরাম লাগে আর বাংলার এই গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী লোক উপাদানটি শত শত বছর ধরে এই অঞ্চলের মানুষকে আরাম দিয়ে আসছে। বিশেষ করে গরম প্রধান এই দেশে গ্রামের মানুষেরা ঘরের মেঝেতে কিংবা চকির ওপরে কিংবা গাছের তলায় এমনকি বাড়ির উঠোনে গৃহকর্তা বা গৃহিণীরা পাটি বিছিয়ে ছেলেমেয়েদের বসতে দেন, শুতে দেন এবং পাড়াপ্রতিবেশি ও আত্মীয়-স্বজনদেরকেও বসতে দেয়া হয়। আমিও এই শীতলপাটিতে বসতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, তোমরা ইচ্ছে করলে এখানে এসে বসতে পারো। আমরা সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পাশে গিয়ে বসলাম। ছোটবেলায় গ্রামে থাকতে বহুবার শীতলপাটিতে বসেছি, শুয়ে থেকেছি কিন্তু ক্ষুদ ঢাকা শহরের ধানমন্ডি এলাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাড়িতে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে শীতলপাটিতে বসে মনে মনে এক অন্যরকম অনুভূতি খেলে গেল। বাহ মন্দ নয় আর জনপ্রিয় এই মেধাবী লেখকের চিন্তার দারুণ প্রশংসাও করলাম। সত্যি তো শীতলপাটি বাংলার প্রাচীন লোকশিল্পে এক নান্দনিক উপাদান।
২. আমি শীতলপাটির ওপর কাজ করতে গিয়েছি টাঙ্গাইলের কালিহাতি ও দেলদুয়ার, সিলেটের বালাগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের রাজনগর, স্বচক্ষে দেখেছি- সুরমা কুশিয়ারা নদী বিধৃত উর্বর শ্রীভূমির পরিত্যক্ত জলাশয়ে জন্ম নেওয়া মুর্তা গাছের বেতি থেকে বিশেষ বুননকৌশলে দক্ষ পাটিয়ালরা এখনও তৈরি করছেন শীতলপাটি। এই শীতলপাটি কবে থেকে তৈরি শুরু হয়েছে তার সঠিক তথ্য আমাদের জানা নেই। কিন্তু আমরা জানি, কারুকার্যশোভিত রুপালি মিহি মসৃণ বেতের শীতলপাটি দেখে মুরদকুলী খাঁ ইস্পাত-দৃঢ় লৌহ শাসক মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে উপহার দিয়েছিলেন। ব্র্রিটিশ মহারানি ভিক্টোরিয়ার অন্দরমহলে একসময় শোভা পায় নজরকাড়া সিলেটের এই শীতলপাটি। ঢাকার নবাব পরিবারের বিয়ের আসরে আসন সাজানো হতো শীতলপাটি দিয়ে। সিলেটের শীতলপাটির নির্মাণশৈলির মুগ্ধতা আর শীতল বাতাসের স্নিগ্ধতা পেয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে নিয়ে ছিলেন। এ সম্পর্কে লেখক পপি চৌধুরী লিখেছেন: ‘উদয়ন: স্থাপত্য-বৈচিত্র বাড়িটির প্রধান আকর্ষণ। এই বাড়িটিও একবারে গড়ে ওঠে নি, নানা সময়ে নানা অংশ ভেঙে গড়ে আজকের রূপ পেয়েছে ‘উদয়ন’। প্রাসাদ-সাদৃশ্য বাড়িটির ভিতরে হলঘর, ছাদটি কাঠের কারুকাজ দিয়ে ঢাকা। চারিদিকে বসবার জায়গা, মাঝখানটা ফাঁকা। সেখানে কবির উপস্থিতিতে হতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মহড়া, সাহিত্যপাঠ, সভা-সমিতি। শীতলপাটি দিয়ে ভিতরের দেওয়ালগুলি ঢাকা। ভিতরের নক্সা কবিগুরুর নিজের করা।’ জানা গেছে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট সফরকালে সিলেটের বেত ও বাঁশের বানানো সামগ্রী দেখে অভিভূত হয়ে কয়েক ফর্দ কিনে নিয়ে শান্তিনিকেতনে ব্যবহার করেছেন।
ত্রিশের দশকের কীর্র্তিমান কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্মৃতির রেখা’ গ্রন্থের আলোচনায় জগন্নাথদেব মন্ডল লিখেছেন: ‘ওঁর লেখায় টের পাওয়া যায়, জীবনে একটি বন্যঝোপের গুরুত্ব, একটি পোকারও ক্ষমতা রয়েছে অস্তমেঘের রং বদলানোর, আমাদের বেঁচে থাকার নকশা আমূল পালটে দেওয়ার। তখন বোঝা যায়, পাশের মানুষটিকে ভালবাসার মতো সৌন্দর্য আর কিছুতেই নেই। তখন মর্ত্যপৃথিবীর ধুলোমাখা জীবন একটু উপরে উঠে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। যাঁর লেখায় এমন শীতলপাটি বিছানো, সেই বিচিত্র আনন্দময় মানুষটিকে সালাম জানাই।’
৩. রাজা-বাদশা, রাজরানিরা বাংলার এই নান্দনিক লোকশিল্প ব্যবহার করেছেন, যা শত সহস্র বছর পেরিয়ে গেলেও এর আবেদন এখনও ফুরিয়ে যায়নি। এখনও যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইডেনসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এগুলো ব্যবহারে যেমন আরামদায়ক তেমনি সাধারণ নারী ও পুরুষের হাতে তৈরি করা শীতলপাটি দেখতেও নান্দনিক, তা নিখুঁত বুননে, নকশায়, রঙে অসম্ভব সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। বলা হয়েছে, আকাশভাঙা জ্যোৎস্নাাভরা রজনীতে, ঘুঘু ডাকা অলস দুপুরে, শ্রাবণের অঝোর ধারায় সিক্ত বর্ষণমুখর দিনে কিংবা সাঁঝ সকালের মিষ্টি আভায় গা ভেজাতে ভেজাতে গাঁয়ের দক্ষ বুননশিল্পীরা মনের মাধুরি মিশিয়ে সৃজন করে এক একটি শীতলপাটি। কারুকাজ ও লোককাজ মিশ্রিত সেই শীতলপাটি হয়ে উঠে অনিন্দ্যসুন্দর দৃষ্টিনন্দন শিল্পের সমাহার। নিখুঁত নিষ্কন্টক আল্পনার ছোঁয়ায় ফুটে ওঠে এক একজন বুনন শিল্পীর শৈল্পিক শিল্পসত্তা। সাংবাদিক শিশির কুমার নাথ বলেছেন, ‘শীতলপাটি শুধু যে একটি ব্যবহার্য সামগ্রি তা নয়, এর সাংস্কৃতিক গুরুত্বও অপরিসীম। গ্রামের নিরক্ষর মহিলা, কিন্তু পাটির জমিনে ফুটিয়ে তুলতে পারেন বাংলা, আরবি, ইংরেজি বর্ণমালা। যে মহিলা কোনো দিন তাজমহল দেখেননি, স্মৃতিসৌধ দেখেন নি তিনিই বেত দিয়ে ছবি আঁকেন সেসব স্থাপনার।’জনশ্রুতি আছে, এরূপ শীতলপাটি এতই মসৃণ হয় যে, তাতে সাপও চলতে পারে না। সিলেট অঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়েসহ নানা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে শীতলপাটির ব্যবহার হয়। এখনও গ্রাম এলাকায় কনে ‘নাইওর’ থেকে ফেরার সময় হাতে করে রঙিন নকশি করা উন্নতমানের পাটি নিয়ে যান।
৪. শীতলপাটি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে রচিত হয়েছে অসাধারণ কিছু ছড়া ও কবিতা। নিচে তুলে ধরা হলো কিছু অসাধারণ কবিতা ও ছড়া: ক. ‘মধুর চেয়েও আছে মধুর/ সে এই আমার দেশের মাটি/আমার দেশের পথের ধুলা/খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি।/ চন্দনেরই গন্ধে ভরা/ শীতল করা ক্লান্তি হরা/ যেখানে তার অঙ্গ রাখি/ সেখানটিতেই শীতলপাটি।’ খ.‘ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি ঘুমের বাড়ি যেয়ো/ বাটা ভরে পান দেবো গাল ভরে খেয়ো।/ শান বাঁধানো ঘাট দেবো বেসম মেখে নেয়ো/ শীতলপাটি পেরে দেবো পরে ঘুম যেয়ে।’ গ.‘কুটুম এলো, কুটুম এলো, ঝেড়ে ধুলোমাটি।/ দাও বিছিয়ে চিকন বেতে তৈরি শীতলপাটি।’ ঘ. ‘আর মাছ বানাইতো কন্যা, লয় ছালি-মাটি।/ ইলিশ বানাতো কন্যা, বিছায় শীতলপাটি।’ ঙ.কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘এই নে, তোকে দিলাম বাড়ি, নতুন খড়ে ছাওয়া/ দিলুম আগরতলার শীতলপাটি।’ ছ.শিশুসাহিত্যিক রফিকুল হক দাদুভাই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যে পূর্বদেশ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় একটি ছড়া লিখেছিলেন, ‘ঘরে ফিরা আইসো বন্ধু/ পাইতা থুইছি পিঁড়া/ জলপান যে করতে দেব/ ইরি ধানের চিঁড়া/ শালি ধানের চিড়া ছিল/ বিন্নি ধানের খই/ কোথায় পাবো শবরীকলা/ গামছা বাঁধা দই!/ জান মেরেছে খান পশুরা/ বর্গী সেজে ফের/ আগুন জ্বে¡লে খাক করেছে/ দেশটা আমাদের। প্রাণের বন্ধু ঘরে আইলা/ বসতে দিমুু কিসে;/ বুকের মধ্যে তোমার বাণী/ রক্তে আছে মিশে। বঙ্গবন্ধু তোমার আসন/ বাংলাদেশের মাটি/ মনের মধ্যে পাতা আছে/ প্রীতির শীতলপাটি।’
শীতলপাটি নিয়ে এরকম আরো অসংখ্য অসাধারণ প্রচলিত লোকছড়া এবং কবিতা রচিত হয়েছে এর ব্যবহার ও সৌন্দর্য বর্ণনা করে। বাংলার নিভৃত গ্রাম, ধূলিধূসর আর শ্যামল মাটি, অবারিত শস্যখেত, কুলকুল বয়ে যাওয়া নদী, খাল-বিল, পালতোলা নৌকা, ফুল-পাখি আর নানা প্রজাতির গাছ-পালা, সুশীতল বৃক্ষছায়া, মায়ের হাসি, তার হাতের পুলিপিঠা, গরু চড়ানো চিলচিল দূরের সবুজ মাঠ, বধূদের হাতে তৈরি নকশিকাঁথা, গরুর গাড়ি, বিলের পানকৌড়ি আর পুঁটি মাছ, ঘরের টিনের চালে টুপটুপ বৃষ্টির ফোঁটা, নববধূর পালকি করে চলে যাওয়া, পুঁথিপাঠ, পুতুলনাচ, যাত্রা, পালাগান, সারিগান, বাউলগান, জারিগান, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, মহুয়া, মলুয়া, ভাওইয়া, প্রবাদ-প্রবচন আর মেঘ করে আসা আকাশ, বৃষ্টিভেজা ছনের-টিনের চাল, চুইয়ে পড়া বৃষ্টিজল, খরখরা রোদের শক্তমাটি, কিশোর-কিশোরীর নদীজলে অবাদ সাঁতার- এই আমাদের প্রাচীন বাংলা, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, প্রিয় বাংলাদেশ। রূপময় বাংলাদেশ। নিসর্গ-প্রকৃতি আর ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যময় লীলাভূমি এই সোনার বাংলাদেশ। আমরা জানি, বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও লোকশিল্প অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময়। হাজার বছরের লোকশিল্পের মধ্যে রয়েছে- জামদানি, নকশিকাঁথা, চামড়াশিল্প, দারুশিল্প, মৃৎশিল্প, বাঁশশিল্প, বেতশিল্প, শীতলপাটিসহ অসংখ্য বর্ণিল কারুশিল্প। আবহমান বাংলার জীবনধারায় শীতলপাটি লোকশিল্পের একটি অন্যতম উপাদান। পৃথিবীর যেকোনো দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে সে দেশের লোকশিল্প। বাংলাদেশ নদীমাতৃক ও উষ্ণমণ্ডলীয় উর্বর সমভূমি হওয়ায় এখানে প্রচুর বাঁশ-বেত, নল-হোগলা, লতা-গুল্মের সবুজ শ্যামলিমায় ঘটেছে সমাবেশ। বাংলার গ্রামীণ শিল্পীরা দেশীয়-সম্পদ ব্যবহার করে লোকজীবনধারায় সুদূর প্রাচীনকাল থেকে তৈরি করে চলেছে নানা ধরনের কারুশিল্প। এইসব কারুশিল্পের মধ্যে শীতলপাটি লোকজীবনে সুষমায় নন্দিত।
লোকজীবনে সুষমায় নন্দিত শীতলপাটি এক ধরনের মসৃণ শৈত্যবোধ ও আরামদায়ক পাটি। ‘মুর্তা’ নামক এক ধরনের ‘নল’ জাতীয় সবুজ গাছ থেকে তৈরি করা হয় শীতলপাটি। অঞ্চলভেদে এই মুর্তা গাছকে বলা হয় পাটিপাতা, পাটিবেত বা পাইতারা। আর পাটিশিল্পীদের বলা হয় পাটিয়াল বা পাইটাল। এ সম্পর্কে ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের লেখক অদ্বৈতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি বলেছেন, “...এই শিল্পের মধ্যে শীতল পাটি সর্বপ্রধান ও বিশেষ বিখ্যাত। মূর্ত্তা নামক এক জাতীয় গুল্মের বেত্র দ্বারা ইহা প্রস্তুত হয়। ইহা শীতল, মসৃণ ও আরামজনক বলিয়া সর্র্বত্র আদৃত। বঙ্গদেশের অন্য কোথায়ও এইরূপ উৎকৃষ্ট পাটি প্রস্তুত হইতে পারে না। পাটির বেত্র রঞ্জিত ক্রমে পাশা, দাবা প্রভৃতি বিবিধ খেলার ছক ইত্যাদি চিত্রিত করা হয়। পাটির মূল্য গুণানুসারে ১০ আনা হইতে ১০ টাকা পর্যন্ত হইতে পারে। বেত্র যত চিকন হয়, মূল্য ততই বর্র্ধিত হয়। পূর্র্বে নবাবের আমলে ২০-২৫ টাকা হইতে ৮০-৯০ টাকা, এমনকি শত দ্বিশত টাকা পর্যন্ত মূল্যের পাটি প্রস্তুত হইত বলিয়াও শুনা যায়। ২০-২১ হাত দীর্ঘ পাটিকে ‘সফ’ বলিয়া থাকে। ইট ও চোঁয়ালিশ পরগণাতেই সর্ব্বোৎকৃষ্ট শীতলপাটি প্রস্তুত হয়। পাটি প্রস্তুতকারকগণ ‘পাটিয়ারা দাস’ নামে খ্যাত। ১৮৭৬-৭৭ খৃষ্টাব্দে শ্রীহট্ট হইতে ৩৯২৭ টাকা মূল্যের পাটি রপ্তানি হইয়াছিল।”
৫. সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ঝালকাঠি, সিরাজগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ, ফেনি জেলায় জলাশয় ধারে নিচু ভূমিতে জন্মে প্রচুর মুর্তা গাছ। মুর্তা গাছের কাণ্ড থেকে ধারালো দা দিয়ে সরু বেতি বের করা হয়। যাকে বলা হয়ে থাকে ‘সলইদ’। এইসব বেতিগুলো বা সলই পাকা ও চকচকে করার জন্য ভাতের ফ্যানের সঙ্গে আমড়া পাতা ও বোয়ালিলতা সংমিশ্রণ করে গরম পানিতে সিদ্ধ করে রোদে শুকানো হয়। তারপর স্বচ্ছ পানিতে ধৌত করে পুনরায় রোদে শুকিয়ে তৈরি করা হয় সাদা শীতলপাটি। আর নকশা তোলার জন্য মাঝের অংশের বেতিগুলোকে গরম পানিতে রং মিশিয়ে সিদ্ধ করে রঙিন করা হয়। অনুরূপভাবে রোদে শুকিয়ে তারপর এই রঙিন বেতি দিয়ে তৈরি করা হয় নকশি শীতলপাটি।
শীতলপাটি বুনন পদ্ধতি সাধারণত দু’ধরনের হয়ে থাকে। প্রথমত জমিতে জো’তুলে তাতে রঙিন বেতি দিয়ে নকশা তোলা হয়। পরে জমিন তৈরি হলে তার চতুর্দিকে মুড়ে দেওয়া হয় অন্য রঙের বেতি। কারুশিল্পী মনের মাধুরি মিশিয়ে হাতের আঙুলের নিপুণ বুননে রঙিন বেতির সাহায্যে ফুটিয়ে তোলে ফুল-পাখি, পালকি, লতাপাতার মতো লোকায়ত বাংলার লোক-ঐতিহ্য। এতে প্রতিটি শীতলপাটি হয়ে ওঠে কারুকার্যমণ্ডিত। প্রতিটি শীতলপাটি হয়ে ওঠে শিল্প-সম্মত। বুননের শৈল্পিকতায় শীতলপাটি সুন্দর সুন্দর নামকরণ করা হয়েছে। যেমন- আসমানতারা, জমিনতারা, গুছিরঙা, কমলকোষ। একটি সাধারণ শীতলপাটি বুনতে একজন কারুশিল্পীর দুইদিন থেকে তিনদিন সময় লাগে। আর নকশি শীতলপাটি বুনতে সময় লাগে পঁচিশ-ত্রিশ দিন বা আরো বেশি।
শীতলপাটি ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে সমাজে সমাদৃত হয়েছে। বাংলাদেশের গ্রাম্য-হাট বাজারে সাধারণ শীতলপাটি বেচা-কেনা হয় তিন শত থেকে পাঁচ শত টাকায়। আর নকশি শীতলপাটি বিক্রি হয় এক হাজার থেকে পনেরো হাজার টাকায়। আবহমানকাল ধরে বাংলাদেশে শীতলপাটির চাহিদা রয়েছে। শীতলপাটি শুধু গ্রামীণ সমাজেই নয়-নগর জীবনেও স্থান পেয়েছে। লোকসংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যে এবং উপহার পণ্য হিসেবেও পেয়েছে জনপ্রিয়তা। লোকায়ত বাংলার গার্হস্থ্য কাজে ব্যবহার ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে শীতলপাটি ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। কারুশিল্পীদের নিপুণ হাতের শৈল্পিক কারুকার্যে শীতলপাটি পেয়েছে বর্ণিলচিত্র। বাংলার লোককথায়, লোকছড়ায়, মেয়েলিগীতে ও কাব্যগাঁথায় মধুর ভাষায় চিত্রিত হয়েছে শীতলপাটি। শীতলপাটির নামচিত্রে প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থ, সেই সাথে অলংকৃত করেছে প্রচ্ছদপট। শীতলপাটি বাংলাদেশের একটি লোক ও কারুশিল্প হিসেবে সুপরিচিত। শীতলপাটির ঐতিহ্য বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক উপাদান ও এ দেশের প্রাকৃতিক উপকরণ, ঐতিহ্যের বুনন শৈল্পিক কৌশল ও সৃজনশীলতায় আবহমান বাংলার নারী-পুরুষের সম্মিলিত অনুভব, চেতনা ও শ্রমের এক শৈল্পিক অনবদ্য সৃষ্টি। শীতলপাটি বাংলাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প।
এ দেশের কারুশিল্পীরা লোকসংস্কৃতিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখে চলেছেন বংশ পরম্পরায়। বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে শীতলপাটির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। সাংবাদিক মোমেন মেহেদি তাঁর এ বিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘মা-বোন আর প্রিয়জনের হাতে গড়া এই শীতলপাটি নির্ঘুম থাকতেই দেয় না। বিশ্বাসের চাকা চলতে চলতে দেখা যাবে শীতলপাটির সুনাম দেশের আনাচেকানাচে সব জায়গায়-সবখানে। এর চাহিদাও ব্যাপক। আর এ চাহিদা অনেকটাই মেটাচ্ছে টাঙ্গাইল, বরিশাল, সিলেট, বাগেরহাটসহ বিভিন্নস্থানের নারী কারিগররা। গাছ-গাছালি ঘেরা এবং ছায়া-সুশীতল গ্রাম-বাংলার প্রায় ৫ হাজার পরিবার শীতলপাটি বুননে এবং বেত চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। পুরুষের পাশাপাশি এইসব এলাকার প্রায় সব মহিলা শীতলপাটি বুননের কাজ করে থাকেন।’
শীতলপাটি বুননের কারিগর আসমা আক্তার জানান, নিজের আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় শীতলপাটি বুননের জন্য মহাজনের কাছ থেকে সুদে টাকা নিতে হয়। এতে লাভ কম হয়। শীতলপাটির আরেকজন কারিগর নূর হাফসা বলেন, ‘একটি পাটি বুনতে যে মুর্তা লাগে বর্তমানে তার বাজার মূল্য ১৪০ টাকা। বুননের খরচ ১২০ টাকা। বেতি তৈরি করার মজুরি ও রঙের খরচ ২২০ টাকা। একটি পাটি বুননে মোট খরচ পড়ে ৪৮০ টাকা। গড়ে একটি পাটি বিক্রি হয় ৫২০ টাকায়। এমতাবস্থায় নিরুপায় হয়ে অনেকেই দিশে হারাচ্ছেন। যেহেতু শীতলপাটি বুননের প্রধান উপকরণ বেত। সেহেতু বেতের চাষ বাড়ানোর জন্য কৃষকদেরকে উৎসাহিত করার প্রতিও জোর দিয়েছেন এই নারী কারিগরেরা। বেত চাষ হলে বেতির দাম কমলে শীতলপাটি টিকে যেতে পারে। তা না হলে এভাবে একসময় শীতলপাটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যা আমাদের কারোই কাম্য নয়। প্রাপ্তির জন্য প্রেরণের জন্য
শীতলপাটির ওপর প্রামাণ্যচিত্র তৈরি ও মাঠ পর্যায়ে শিল্পীদের কাজ ধারণ কাজে ২০১৬ সালে শীতলপাটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এ আবেদন করে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। জাতীয় জাদুঘরের কর্র্মকর্তা ও একজন গবেষক হিসেবে আমি শীতলপাটির ওপর প্রামাণ্যচিত্র তৈরির কাজ করেছি। এজন্য টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার, কালিহাতি এবং রাজনগরের ধুলিজুরা গ্রামে ভ্রমণ ও পরিদর্শন করি এবং স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করি। কাজের এক পর্যায়ে রাজনগরের ধুলিজুরা গ্রামের প্রখ্যাত পাটিশিল্পী হরেন্দ্রকুমার দাশের সঙ্গে এ শিল্প নিয়ে কথা বলি। তিনি বংশ পরম্পরায় দীর্ঘদিন যাবত শীতলপাটি শিল্পের সঙ্গে আছেন। পরিবারের সকলেই এই শিল্পকর্মের সঙ্গে জড়িত। তিনি পাটি বুনন, বিপণন এবং বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, ‘বাপ-দাদার পেশা, ছাড়তে পারি না। এই পেশা আমাদেরকে এখন আর আনন্দ দেয় না, মুর্তা গাছের অভাব, জলাশয় কমে যাচ্ছে, সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে, পাটি তেমন বিক্রি হয় না। পাটির ব্যবহারও কমে গেছে। গ্রামের পাশেই শীতলপাটির একটি হাট বসে, সেখানে বিক্রি করি, বাড়ি থেকেও ক্রেতারা কিনে নিয়ে যায়। এছাড়া বিভিন্ন প্রদর্শনীতেও অংশগ্রহণ করি। কিন্তু প্রদর্র্শনীতে আগত দর্শকরা শুধু দেখে, কিনে কম। তাই এই শিল্পের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি প্রয়োজন। তবে আনন্দের বিষয় হলো সিলেটের ঐতিহ্যবাহী পাটি শিল্পের সঙ্গে জড়িত আছি।’
আশা, অর্জন ও বাঙালিদের ভালো লাগার বিষয় রূপময় বাংলার এই ঐত্যিহ্যবাহী গ্রামীণ লোকশিল্পের অন্যতম উপাদান সিলেট অঞ্চলের শীতলপাটি বয়নশিল্প হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে ৬ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে। পার্র্শ্ববর্তী দেশ ভারতও শীতলপাটি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ছিল। কিন্তু সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর প্রস্তাব পাঠালে, বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের শীতলপাটি বুননের ঐতিহ্যগত হস্তশিল্পকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর নিবর্স্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে গঠিত আন্তর্জাতিক পর্ষদ (অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুরক্ষার জন্য আন্ত সরকারি কমিটি) বাংলাদেশ সরকারের শীতলপাটি বিষয়ক প্রস্তাবটি অনুমোদন করে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাবটি নমিনেশন ফাইল নম্বর ১১১২ হিসেবে চিহ্নিত ছিল। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এই প্রস্তাবনাটি প্রণয়ন করে এবং ইউনেস্কোর নিকট ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে দাখিল করে। ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর ইউনেস্কোর সংশ্লিষ্ট মূল্যায়ন কমিটি বাংলাদেশের প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্য বলে অভিমত ব্যক্ত করে।