সাতসতেরো

নকশিকাঁথা: ঐতিহ্যের অবগাহন

নকশিকাঁথা হলো সাধারণ কাঁথার উপর নানা ধরনের নকশা করে বানানো বিশেষ প্রকারের কাঁথা। নকশিকাঁথা বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটা অংশ, লোকশিল্পের একটা অংশ। সাধারণত পুরাতন কাপড়ের পাড় থেকে সুতা তুলে অথবা তাঁতীদের থেকে নীল, লাল, হলুদ প্রভৃতি সুতা কিনে এনে কাপড় সেলাই করা হয়। ঘরের মেঝেতে পা ফেলে পায়ের আঙুলের সঙ্গে কাপড়ের পাড় আটকিয়ে সুতা খোলা হয়। এই সুতা পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য রেখে দেয়া হয়। সাধারণ কাঁথা সেলাইয়ের পর এর উপর বিভিন্ন নঁকশা ফুটিয়ে তোলা হয় যার মধ্যে থাকে ফুল, লতা, পাতা ইত্যাদি। দেশের বিভিন্ন স্থানে  নকশিকাঁথা তৈরি হয়, তবে ময়মনসিংহ, রাজশাহী, ফরিদপুর ও যশোর নকশি কাঁথার জন্য বিখ্যাত। 

অন্যান্য লোকশিল্পের মতো কাঁথার উপর দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস, আবহাওয়া, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক প্রভাব আছে। সম্ভবত প্রথমদিকে কাঁথা ছিল জোড়া তালি দেওয়া কাপড়। পরবর্তীতে এটি থেকেই নকশি কাঁথার আবির্ভাব। পাঁচশো বছর আগে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত ‘শ্রী শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত’ বইয়ে কাঁথার বিষয়ে জানা যায়। কাঁথা সংস্কৃত ‘কন্থা’ শব্দজাত; অর্থ জীর্ণ এবং ছিন্ন বস্ত্র। অতি প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি এদেশের সাধু-সন্ত, যোগী-সন্ন্যাসী, আউল-বাউল, পীর-ফকিরদের পরিধেয় বলতে প্রধানতই এই ছিন্ন কন্থা। কন্থা বা কাঁথা ত্যাগ, বৈরাগ্য, নম্রতা এবং নিরাশক্তির প্রতীক। সাধারণের দৈনন্দিন ব্যবহারের অথবা শিশুশয্যা হিসেবে ব্যবহৃত কাঁথা আক্ষরিক অর্থেই কাঁথা বা কন্থা, কিন্তু বঙ্গ রমণীর ঐকান্তিক ধৈর্য্য, নিষ্ঠা আর নৈপুণ্যে নিত্য প্রয়োজনের কাঁথাই যখন প্রয়োজনের প্রাত্যহিকতাকে ছাপিয়ে শিল্পলোকে উত্তীর্ণ হয় তখন তাকেই বলে নকশীকাঁথা। তবে, উভয় ক্ষেত্রে উপকরণ মূলত একই, পুরনো পরিত্যক্ত বস্ত্র এবং ছিন্ন শাড়ির পাড়ের সুতা।  নকশিকাঁথা বাংলাদেশের লোকজীবনের লোকসংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। এই বিবেচনায় এর প্রাচীনত্ব সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ও তথ্যের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। নকশিকাঁথা সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে ময়মনসিংহ গীতিকায়। ময়মনসিংহ গীতিকার অন্যতম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর ‘রামায়ণ কাব্যতে’ নকশি কাঁথার বিবরণ পাওয়া যায়।  ‘সীতার গুণের কথা কি কহিব আর ....। কন্থায় আকিল কন্যা চান সুরুয পাহাড়ায় আরও যে আকিল কন্যা হাসা আর হাসি। চাইরো পাড়ে আঁকে কন্যা পুষ্প রাশি রাশি ॥’ 

সাধারণত কাঁথা দুই প্রকার। যেমন: (১) লেপকাঁথা ও (২) সুজনিকাঁথা। লোকজীবনে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কাঁথার প্রচলন আছে। ব্যবহারের দিক থেকে নানা প্রকার আঞ্চলিক নাম পাওয়া যায়। কবি জসীমউদ্দীন একটি প্রবন্ধে ব্যবহারিক উদ্দেশ্যসহ সাত প্রকার কাঁথার নাম বলেছেন। ক. পান-সুপারি রাখার ‘খিচা’  খ. তসবি বা জপের মালার ‘থলিয়া’  গ. ফকিরের ভিক্ষার ‘ঝুলি’  ঘ. বালিসের ‘বেটন’  ঙ. সারিন্দা-দোতারা রাখার ‘আবরণী’  চ. কোরান শরিফ রাখার ‘ঝোলা’  ছ. গায়ে দেওয়ার ‘কাঁথা’।  

গুরুসদয় দত্ত ব্যবহার ভেদে সাত প্রকার কথার বর্ণনা দিয়েছেন। যথা- আরশিলতা, ওয়ার, দুর্জনি, বেটন, লেপকাঁথা ও সুজনিকাঁথা।  দীনেশচন্দ্র সেন ‘কাঁথা’, ‘গোলাপ’ ও ‘বটুয়া’- এ তিন শ্রেণির নাম উল্লেখ করেছেন। বাংলা একাডেমি লোকশিল্প সংগ্রহে নিম্নলিখিত দশ রকমের কাঁথা আছে, যথা- নকশিকাঁথা, সুজনিকাঁথা, লেপকাঁথা, নকশি আসন, জায়নামাজ, দস্তরখানা, গাটরি, বোচকা বা গুইল, বালিশের ছাপা এবং বস্তানি। 

উপরের তালিকার কোনো কোনো কাঁথার উদ্দেশ্য একই, কেবল বিভিন্ন নামে উল্লিখিত হয়েছে, যেমন- খিচা, বটুয়া, বুগইল, আরশিলতা, দুর্জনি প্রায় একই শ্রেণির কাঁথার ভিন্ন ভিন্ন নাম। কোনোটির তিন কোণা ভাঁজ করে থলে করা হয়, কোনোটি ভাঁজ করা হয় না। কথাগুলোতে পান সুপারি, তসবি-মালা, সোনা-দানা, টাকা-পয়সা রাখা হয়। বালিশের খোল, ছাপা, গোলাপ প্রভৃতি সমার্থবাচক শব্দ। কাঁথার ব্যবহারিক বিভিন্নতা সত্ত্বেও আকারের বিভিন্নতা লক্ষ করে নিম্নের বিভাগগুলো স্মরণযোগ্য :  ক. কথা ও সুজনি- শয্যাবরণী  খ. লেপকাঁথা- গাত্রাবরণী  গ. ছাপা ও কোল- বালিশের আবরণী  ঘ. জায়নামাজ ও আসন- নামাজ ও পূজার জন্য  ঙ. দস্তরখানা- খাওয়ার সময় ব্যবহৃত আস্তরণ  চ. আরশিলতা, বটুয়া ও বুগইল- আয়না-চিরুনি, পান-সুপারি রাখার জন্য ব্যবহৃত  ছ. গাটরি ও বস্তানি- বই ও তৈজসপত্র রাখার জন্য ব্যবহৃত  

কাঁথার প্রচলন দুই বাংলা জুড়েই আছে। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, যশোর, খুলনাসহ সারা বাংলার গ্রাম-গঞ্জেই ছিটিয়ে আছে কাঁথা বানানোর সংস্কৃতি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহারেও দেখা যায় বৈচিত্র্যপূর্ণ কাঁথার সমাহার। বিহারের ‘সুজনী’ কাঁথার আছে আন্তর্জাতিক মহলে ‘ভৌগোলিক স্বীকৃতি’। যদিও একই নামে এবং প্রায় একই ধরনের কাঁথা বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলেও প্রচলিত আছে। 

নকশিকাঁথা ছাড়াও গ্রাম-গঞ্জে সাধারণ সেলাই করা কাঁথা দেখা যায়। সেখানে নকশার বাহাদুরি নেই, প্রয়োজনটাই মুখ্য সেখানে। সেলাইয়ের পর সেলাই করে সেখানে পুরাতন কাপড়গুলো একত্র করে কাঁথা বানানো হয়। কাঁথার চারদিক ঘিরে মজবুত সেলাই দেওয়া হয় যাতে সহজে ছিঁড়ে না যায়। শীত নিবারণের জন্য সেলাই করা কাঁথা বেশ পুরু আর মোটা হয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় তৈরিকৃত কাঁথা বেশ মোটা হয়। শীত নিবারণের জন্য আমাদের দেশীয় লেপ কিংবা কম্বলের পাশাপাশি কাঁথার আলাদা সমাদর আছে।

তবে সময়ের সঙ্গে নকশি কাঁথার জমিনে যে নিপুণ কারুকার্য করা হয় সেটির একটি সাংস্কৃতিক আবেদন তৈরি হয়েছে, ফলে এর অর্থমূল্য বেড়েছে। এই আবেদন থেকেই নকশিকাঁথাকে কুটির শিল্প হিসেবে দাঁড় করানোর প্রবল সম্ভাবনা জেগে উঠেছে। নকশী কাঁথার পেশাদার কারিগর বলতে এক সময়ে কাউকে পাওয়া যেত না, কারণ এই শিল্পটি নিতান্তই শখের বশে আর প্রয়োজনের খাতিরে দাঁড়িয়েছিল। এর ফলে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কাঁথাও হারিয়ে যেতে বসেছিল। যুগ যুগ ধরে চলে আসা নকশি কাঁথার মহামূল্যবান নকশাও ঝুঁকিতে ছিল। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এই নকশি কাঁথার বুননকে কুটির শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে নানা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

নকশি কাঁথার নকশা শুধু কাঁথার জমিনে সুঁইয়ের ফোঁড়ে ফুটিয়ে তোলা নকশাই নয়, একেকটি নকশি কাঁথার জমিনে লুকিয়ে থাকে গল্প, কখনো ভালোবাসার, কখনো দুঃখের। বাংলার পথে প্রান্তরে হারিয়ে যাওয়া গল্পকে বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে একেকটি নকশিকাঁথা। মূলতঃ ‘পুরানো কাপড় কয়েক ভাঁজ (কখনো তিন, চার বা ছয় ভাঁজ) করে চার ধার সেলাই করে আটকানো হয়। পুরানো শাড়ির পাড় থেকে নেয়া রঙ্গীন সুতা দিয়ে কাঁথার কেন্দ্রীয় মোটিফের কাজ হয়। পরবর্তীতে চার কোণায় সমধরনের নকশা বা মোটিফ বসানো হলে খালি অংশে ছোট মোটিফ বা জ্যামিতিক নকশা দিয়ে ভরাট করা হয়। সবশেষে সাদা অংশগুলোতে সাদা সুতা দিয়ে জমিনের অংশ সেলাই করা হয়।’

এই রীতিতে সাধারণত কাঁথা তৈরি হয়ে থাকে। পুরনো নকশি কাঁথা তৈরিতে সাধারণত পুরনো শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি ব্যবহার করা হয়েছে। পুরনো নকশি কাঁথার উপকরণ দেখলে তারই প্রমাণ মেলে। পুরনো শাড়ির পাড় থেকে তোলা সাদা ও রঙিন সুতা পুরনো নকশি কাঁথায় ব্যবহৃত হত। কখনো কখনো কিছু নতুন সুতাও ব্যবহৃত হয়। পুরানো কাঁথাগুলোতে (একশ বছরের) সাদা, কালো, নীল, লাল এই চার রঙের সুতা অধিক মাত্রায় ব্যবহৃত হয়েছে।  উপকরণ ও আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যে কাঁথা সুচি শিল্পভুক্ত সন্দেহ নেই, কিন্তু ফর্ম, মোটিফ চিত্রকল্পসহ অন্যতর বৈশিষ্ট্যে কাঁথা আল্পনা-গোত্রীয়। আল্পনার মতো কাঁথায়ও ঐতিহ্যবাহী, রীতিসিদ্ধ ও সমতলভিত্তিক চিত্র বা নকশা প্রতীক বা সংকেতধর্মীতায় অভিব্যক্ত। শাড়ির পাড় থেকে সুতা তোলা এবং সুঁচের ঘাই বা ফোঁড় তোলা থেকে অলঙ্করণের নিমিত্তে নির্বাচিত চিত্রকলা এবং সেগুলোর বিন্যাস পদ্ধতি সবই পরম্পরাগত। তাই, চিত্র বা নকশী স্বভাবতই বৈচিত্র্যহীন এবং গতানুগতিক। চিত্রগুলো স্থির এবং নিশ্চল, উড়ন্ত পাখি বা ধাবমান পশুও তাই। তবে চিত্র বা নকশার সাবলীলতা এবং রৈখিক নৈপুণ্য চিত্রে এক আশ্চর্য পেলবতা আনে।  

দেশে নকশিকাঁথা সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে- নকশিকাঁথা, বেড কভার, থ্রি-পিস, ওয়ালমেট, কুশন কভার, শাড়ি, পাঞ্জাবি, টি-শার্ট, ফতুয়া, স্কার্ট, লেডিস পাঞ্জাবি, ইয়ক, পার্স, বালিশের কভার, টিভি কভার, শাড়ির পাড়, ওড়না, ফ্লোর কুশন, মাথার ব্যান্ড, মানি ব্যাগ, কলমদানি, মোবাইল ব্যাগ, শিকা, শাল, চাদর ইত্যাদি।  

অন্যান্য শিল্পকলার মতো কাঁথা সংরচনেও বাংলাদেশের মহিলাদের শ্রেষ্ঠত্ব অনস্বীকার্য। তবে অঞ্চল নির্বিশেষে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্রই অল্পাধিক নকশিকাঁথা রচনার ঐতিহ্য বর্তমান। সুঁই-এর ফোড়ে কাপড়ে নকশা তৈরির ঐতিহ্য এ উপমহাদেশে তো বটেই দুনিয়ার সর্বত্রই কম-বেশি বিদ্যমান। তবে পুরনো কাপড়ের প্রেক্ষাপটে পুরনো শাড়ির পাড়ের সুতার সামান্য উপকরণে এত ধৈর্য, এত নৈপুণ্য, নকশা বা অলঙ্করণের এত বৈচিত্র্য অতি-অবশ্যই বাঙালি-বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। হিন্দু-মুসলমান, ধর্ম-বর্ণ, জাতি-উপজাতি নির্বিশেষে কাঁথা বাঙালির বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নিজস্ব শিল্প এবং সকলের উৎসব অনুষ্ঠান, বিশেষত বিবাহাদি অনুষ্ঠানের অপরিহার্য উপকরণ এবং উপঢৌকন হিসেবে স্বীকৃত। তদুপরি, এর সাথে যুক্ত পারিবারিক, সামাজিক বংশ ও গোত্রগত আভিজাত্য। এককালে নকশিকাঁথা রচনা করে বাঙালি মহিলারা সমাজের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যে জানা যায়, ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, কুমিল্লা, যশোর ও খুলনার মহিলারাই কাঁথা বিনির্মাণে অধিকতর পারদর্শিনী। সাঁওতালী মেয়েদের নকশীকাঁথাও যে কোনো মানদণ্ডেই বাংলাদেশে বিশিষ্ট।

মানুষ শীত নিবারক হিসেবে কাঁথার ব্যবহার করে থাকে। গ্রাম বাংলার বিত্তবান ও বিত্তহীন সকল মহলেই এটি সমাদৃত। শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির মাঝেও কাঁথা ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। নকশি কাঁথার প্রচলন এর ব্যবহার ও বিপণনে বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব এনেছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এটি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর জনপ্রিয়তা ও কাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলে অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নকশিকাঁথা তৈরি, বিপণন ও রপ্তানিতে নিযুক্ত হয়েছে। এর ফলে আত্মসংস্থানকামী মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির লক্ষ্যে বৃহত্তর সংগঠিত উপায়ে সুযোগটি কাজে লাগানো দরকার। এই হস্তশিল্পটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিজস্ব শিল্প। এর ব্যাপক উৎপাদন, বিপণন, বৈদেশিক বাজার সৃষ্টি ও রপ্তানিকরণ দেশীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হতে পারে। 

উল্লেখ্য, গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি খুব শক্তিশালী শিল্প হলেও এর ভীত নাজুক। জিএসপি সুবিধা বঞ্চিত হলে এটির অবস্থা টালামাটাল হয়ে পড়ে। অথচ নকশিকাঁথা বা এর মতো আরো হস্তশিল্পজাত পণ্য রয়েছে, বিদেশে এসবের ভালো চাহিদাও রয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য এসবকে অবলম্বন করা সুবিধাজনক ও সন্মানজনক।

নকশি কাঁথার বাণিজ্যিক ব্যবহার বেশি দিনের নয়। সাম্প্রতি নকশিকাঁথা বাণিজ্যিক রূপ লাভ করেছে। প্রথম দিকে মানুষ তাদের নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনেই কাঁথা সেলাই করত। আত্মীয় স্বজন বা বাড়ির মেহমানদের অতিরিক্ত সমাদর করার জন্য তারা নকশিকাঁথা বিছিয়ে দিতো। এছাড়া সাধারণ কাঁথা দিয়েই তারা তাদের প্রয়োজন মেটাতো। বাংলার কৃষি সমাজে এটাই ছিল রীতি। বাড়িতে কেউ এলে তার জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বিছানায় বসানোই ছিল ভদ্রতার লক্ষণ। আর এই কারণেই তখনকার মেয়েরা নকশিকাঁথা সেলাই করতো। একটি নকশিকাঁথা সেলাই করতে তাদের বছরের পর বছর ব্যয় করতে হতো। ফলে তারা এই নকশিকাঁথা নিয়ে কোনো রকমের বাণিজ্যিক চিন্তা করার অবসর পায়নি। কালক্রমে, বলতে গেলে ব্রিটিশ আমলে যখন বিদেশিরা এদেশে আগমন করে তখন কিছু বিদেশি উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এদেশের নকশি কাঁথার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অর্ডার দিয়ে নানা রকমের নকশিকাঁথা বনিয়ে নিতো। কিন্তু শিল্পীরা তা সহজেই বানিয়ে দিতে চাইতেন না। বাংলাদেশে এটি সত্তরের দশকে বাণিজ্যিক রূপ লাভ করে। 

এ দেশের জামালপুরের বকশীগঞ্জ, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মাদারগঞ্জ, মেলান্দহ, যশোর, ফরিদপুর, সাতক্ষীরা অঞ্চলে নকশিকাঁথা বেশি তৈরি হয়ে থাকে। তা ছাড়া ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, রাজশাহী, বরিশাল, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সিলেটে নকশি কাঁথার বাজার ও ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ শিল্পকে কেন্দ্র করে কেবল জামালপুরেই গড়ে উঠেছে রংধনু হস্তশিল্প, সৃজন মহিলা সংস্থা, সুপ্তি, ক্যাম্প, কারু নিলয়, জোসনা হস্তশিল্প, প্রত্যয় ক্রাফট, রওজা কারুশিল্প, কারুপল্লী, কারু নীড়, দোলন চাঁপা, ঝিনুক, সূচিকা, তরঙ্গ, দিপ্ত কুটির, বুনন, অণিকা, মিম, মামিম, শতদলসহ প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠান। তাই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি নকশিকাঁথা তৈরি হয় জামালপুরে। বিশ্বে এখন নকশি কাঁথার বিশেষ বাজার তৈরি হয়েছে। পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন বাজারে এ শিল্প ইদানিং বেশ ভালো স্থান করে নিতে চলেছে। বাংলাদেশের নকশিকাঁথা গুণগতমানে উন্নত এবং দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় দেশ-বিদেশে এর চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যেও নকশিকাঁথা রপ্তানি হচ্ছে।  

নকশিকাঁথা মূলত নারীদের শিল্প। পুরো বাংলাদেশেই নকশিকাঁথা তৈরি হলেও ময়মনসিংহকে নকশি কাঁথার শহর ধরা হয়। এ ছাড়া রাজশাহী, যশোর, ফরিদপুর নকশি কাঁথার জন্য বিখ্যাত। সর্বপরি ভারত ও বাংলাদেশের লোকশিল্পের একটা অংশ নকশিকাঁথা। তবে বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত ভৌগলিক নির্দেশক ‘জি আই পণ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। ২০০৮ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নকশি কাঁথার ‘জি আই পণ্য’ স্বীকৃতি পেয়েছে।

তথ্যসূত্র:

খগেশকিরণ তালুকদার, বাংলাদেশের লোকায়ত শিল্পকলা, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৮৭, পৃ. ২২ উদ্ধৃত, সৈয়দ মাহবুব আলম, লোকশিল্প, সোনারগাঁও: বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউণ্ডেশন, ১৯৯৯, পৃ. ৩৮ ওয়াকিল আহমদ, বাংলার লোক-সংস্কৃতি, ঢাকা: জি. জি. অফসেট প্রেস, ২০০৪, পৃ. ৫২ The Art of Kantha, Modern Review, October, 1999, p. 457-458 ওয়াকিল আহমদ, তদেব, পৃ. ৫২। শাহ মো. মিনহাজুল আবেদিন, নকশীকাঁথা: বাংলার লোকসংস্কৃতির এক বৈচিত্র্যময় উপাদান, রোয়ার মিডিয়া, ১৭ জুলাই, ২০১৯ সৈয়দ মাহবুব আলম, লোকশিল্প, সোনারগাঁও: বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, ১৯৯৯, পৃ. ৪১ আবির মোহম্মদ সাদি, নকশিকাঁথা, বুনন, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০