সাতসতেরো

ছায়া আর মায়ায় ঘেরা কাঙ্গাল হরিনাথের বাড়ি

কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার কুণ্ডুপাড়ায় কাঙাল হরিনাথের বাড়ি। একদিন তার বাড়িতে হাজির হলাম। ছায়াঘেরা বাড়িটিতে ভেঙে-চুরে যাওয়া একটি ঘর সময়ের সাক্ষী হয়ে টিকে রয়েছে। এই ঘরে এখন এক নারী বসবাস করেন। কাঙ্গাল হরিনাথ এই ঘরটাতেই বাংলার প্রথম মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপামেশিন বসিয়েছিলেন। মুদ্রণযন্ত্রটি এখনও সময়ের সাক্ষ্য দেয়, এটি বর্তমানে কাঙ্গাল হরিনাথ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। বাড়ির উঠানেই কাঙ্গাল হরিনাথের মঠ। মঠের কাছে রাখা তার ব্যবহৃত এক জোড়া খড়ম। বেলিফুলের গাছ রয়েছে মঠের পাশে। দেখলাম— বাড়িটি ছায়া ঘেরা এবং মায়াময়। অনেক ফুল গাছ আছে। ফুল পড়ে ছড়িয়ে থাকে মঠের চারপাশে। ঝরে পড়া ফুল, মঠ, দিনের তামা রং রোদ  আর খড়মের দৃশ্য সব মিলিয়ে অনন্য এক দৃশ্য তৈরি করে। বাড়িটি দেখাশোনা করেন কাঙ্গাল হরিনাথে চতুর্থ বংশধর, নাতবৌ গীতা।

মফস্বল সাংবাদিকতার জনক কাঙ্গাল হরিনাথ একাধারে সাহিত্যিক, প্রকাশক, সম্পাদক, গীতিকার ও সুরকার। তিনি ছিলেন লালনের শিষ্য। কাঙ্গাল হরিনাথের প্রকৃত নাম হরিনাথ মজুমদার।কাঙ্গাল ফিকির চাঁদ বা বাউল ফিকির চাঁদ নামেও পরিচিত তিনি। ১৮৩৬ সালে তৎকালীন নদীয়ার কুমারখালী গ্রামে তার জন্ম। কাঙ্গাল হরিনাথের জীবনাবসান হয় ১৮৯৬ সালের ১৬ এপ্রিল তারিখে। পড়ালেখা শুরু করেছিলেন ইংরেজি স্কুলে। কিন্তু আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা বেশিদূর এগোয়নি। নীলকরদের অধীনে চাকরি করেছেন পরবর্তীতে তাদের শোষণের বিরুদ্ধাচার করেছেন। কাঙ্গাল হরিনাথই শিক্ষা সম্প্রসারণে বিশেষত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ১৮৫৫ সালে বন্ধুদের সহায়তায় তিনি নিজ গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যদিকে অধিকার বঞ্চিত কৃষকদের সুখ, দুখ, আনন্দ, বেদনা, না পাওয়ার চিত্র তুলে ধরার জন্য শুরু করেন সাংবাদিকতা। শুরুতে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন এরপর ১৮৬৩ সালে নিজে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নামে একটি মাসিক প্রত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। পত্রিকাটি প্রথমে পাক্ষিক ছিল পরে সাপ্তাহিক পত্রিকায় পরিণত হয়। সে সময় ১ পয়সা মূল্যে বিক্রি হতো ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ । এতে কৃষকদের প্রতি নীলকর ও জমিদারদের অত্যাচারের কথা বিশেষ গুরুত্ব পেতো। ফলে উভয় পক্ষ কাঙ্গাল হরিনাথের বিরুদ্ধাচার শুরু করে। ভয় দেখায়। তবুও থেমে থাকেনি ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশ, থেমে থাকেননি কাঙ্গাল হরিনাথ। ১৮৭৩ সালে, কুমারখালি প্রেসের মালিক মথুরানাথ মৈত্রেয় হরিনাথ মজুমদারকে ‘এমএন’ প্রেসটি দান করেন। 

জানা যায় রাজশাহীর রানী স্বর্ণকুমারী দেবীর অর্থ সহায়তায় দীর্ঘ ১৮ বছর কাঙ্গাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকাটি প্রকাশ হতো। ১৮ বছর পর আর্থিক সংকট এবং রাজনীতিসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে পত্রিকাটি প্রকাশ বনধ হয়ে যায়। ১৮৮০ সালে তিনি কাঙ্গাল ফিকির চাঁদের দল নামে একটি বাউল দল গঠন করেন। নিজের রচনা করা ও সুর করা গান দলের সদস্যদের নিয়ে গেয়ে বেড়াতেন কাঙ্গাল হরিনাথ। গানে গানে অধ্যাত্মবাদ প্রচার করতেন কাঙ্গাল হরিনাথ। ১২৯০-১৩০০ বঙ্গাব্দের মধ্যে কাঙ্গাল হরিনাথ ‘কাঙ্গাল ফকির চাঁদ গীতাবলি’ নামে ১৬ খণ্ডে বাউল সঙ্গীতের বই প্রকাশ করেন। তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৮টি। 

কাঙ্গাল হরিনাথ তার পত্রিকা প্রকাশের জন্য একদল দক্ষ লেখককে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। এমএন প্রেস থেকেই বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘বিষাদ সিন্ধু’ মুদ্রিত হয়েছিল। এ ছাড়া লালন শাহের ‘খাচার ভেতর অচিন পাখি’ সহ মোট ২১টি গান গ্রন্থ আকারে মুদ্রিত করেছিলেন কাঙ্গাল হরিনাথ। 

কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর বর্তমানে বাংলাদেশ স্বাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের একটি শাখা জাদুঘর। ৯ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে এই জাদুঘরটি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থী ও সাধারণ দর্শকরা এই জাদুঘর দেখতে ভিড় জমান। বিদেশ বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের লোকজন এই জাদুঘর দেখতে আসেন।

কাঙ্গাল হরিনাথ একটি নাম  যে নাম অধিকার বঞ্চিতের অধিকারের কথা বলেছে আবার আধ্যাত্মবাদ প্রচার করেছে, আধুনিক সভ্যতার দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে নদীয়া তথা এই জনপদের  মানুষকে।