পুরান বাজারের পশ্চিমে মেঘনা আর উত্তরে ডাকাতিয়া নদী। দু’টি নদীর ঠিক পাড় ঘেঁষেই বাজারের অবস্থান। মূলত ডাকাতিয়া এসে মিশেছে মেঘনায়। আবার অন্যদিক থেকে পদ্মার মিলনস্থলও এ মেঘনা-ডাকাতিয়া। তাই এটি তিন নদীর মোহনাও বলা চলে। এ মোহনাতেই পুরান বাজার দাঁড়িয়ে শত বছরেরও বেশি সময় ধরে।
চালপট্টি, ডালপট্টি, যোগীপট্টি, মনোহারীপট্টি, আমপট্টি, বাতাসাপট্টি, ট্রাঙ্কপট্টি, তেলপট্টি, ফলপট্টি, তামাকপট্টি, আড়ৎপট্টি, সুতাপট্টি, খলিফাপট্টি, টিনপট্টি, ঘোষপট্টি, বানিয়াপট্টি কিংবা মসলাপট্টি। এমন অনেক পট্টি আছে চাঁদপুরের পুরান বাজারে। আর এ পট্টি মানে গলি বা সড়ক। যে পণ্যের নামে যে পট্টি, সেই পণ্য পাওয়া যাবে সেই পট্টিতে। তাই নির্দিষ্ট কোনো পণ্যের প্রয়োজন হলে পুরো বাজার না ঘুরে সেই পট্টিতে গেলেই পণ্যটি মিলবে।
হেমন্তের এক দুপরে বন্ধু ফরিদকে নিয়ে প্রবেশ করি অনেক পট্টির এ বাজারে। ছেলেবেলায় এ বাজারে অনেক এসেছি। তারপর দীর্ঘ বিরতি। ঘুরে ঘুরে পট্টির আড়ৎ বা দোকানগুলোতে বেচাকেনা দেখি। পাইকারি বা খুচরা সবরকম বেচাকেনা চলে এখানে। অবশ্য পাইকারির দোকান বা প্রতিষ্ঠানই এ বাজারে বেশি। ডাল-চাল, তেল-নুন থেকে শুরু করে পেঁয়াজ-কাচামরিচ কিংবা মাছ-মাংস, পোশাক-প্রসাধনী সবই মেলে এখানে। তবে সুতা, জ্বাল কিংবা মাছ ধরার সরঞ্জামের দোকানের সংখ্যা এখানে তুলনামূলক বেশি। কারণ এ অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ মেঘনায় ইলিশমাছ ধরার কাজে সম্পৃক্ত। মাছ ধরার সরঞ্জাম বেশি আছে বাজারের যোগী পট্টিতে। এ পট্টির অনেক দোকানের সামনে দেখি মাছ ধরার জ্বাল সেলাই করছেন সেলাইয়ের কারিগর। স্থানীয়রা সেলাইয়ের কারিগরকে খলিফা বলেন।
বাজারের পট্টিগুলোতে ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম আছে। তবে ছেলেবেলায় দেখা পুরান বাজারের সঙ্গে এখনকার পুরান বাজারের কিছুটা অমিল। ছেলেবেলায় নানা মমতাজ উদ্দিন ভুঁইয়া বা মামা আবদুর রব ভুঁইয়ার সঙ্গেই এ বাজারে প্রথম আসি। খুলনা থেকে চাঁদপুর বেড়াতে আসলে নানা বা মামা আমাদের বাজারে নিয়ে আসতেন। বাজারের যোগী পট্টিতে নানার দোকান ছিল। তাদের সঙ্গে বাজারের নানা পট্টিতে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করেছি অনেক। নানা গত হয়েছেন অনেক আগে। তবে এখনও মামার দোকান আছে এ বাজারে।
বাজারের পশ্চিমে মেঘনা আর উত্তরে ডাকাতিয়া নদী। দু’টি নদীর ঠিক পাড় ঘেঁষেই বাজারের অবস্থান। মূলত ডাকাতিয়া এসে মিশেছে মেঘনায়। আবার অন্যদিক থেকে পদ্মার মিলনস্থলও এ মেঘনা-ডাকাতিয়া। তাই এটি তিন নদীর মোহনাও বলা চলে। আর এ তিন নদীর মোহনাতেই পুরান বাজার দাঁড়িয়ে আছে শত বছরেরও বেশি সময় ধরে।
এ বাজার চাঁদপুরের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। চাঁদপুরের শিল্প-কারখানাও এ বাজারকেন্দ্রিক। তিন-চার দশক আগেও এ বাজার আরও জমজমাট ছিল। সে তুলনায় এখন কিছুটা কমতি। এর কারণ নদীর ভাঙনে বাজার ছোট হয়ে আসা। অন্যদিকে ডাকাতিয়া নদীতে সেতু হওয়ার চাঁদপুর শহরের নতুন বাজার জমজমাট হওয়া। ফলে কিছুটা রমরমা হারিয়েছে পুরান বাজার। তবে একেবারে মিলিয়ে যায়নি। সকাল-সন্ধ্যা হাঁক-ডাক বা শোরগোল এখনও বজারে প্রাণের সঞ্চার সৃষ্টি করে। এখনও এ বাজারে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার দোকান আছে চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির হিসেব অনুযায়ী।
লবণ বাণিজ্যের জন্য এ বাজার এক সময় বেশ পরিচিত ছিল। এখনও আছে, তবে আগের মতো নয়। এখনও এ বাজার এ অঞ্চলের চাল, ডাল, তেল, নুন বা বিভিন্ন শস্যজাতীয় পণ্যের বৃহৎ পাইকারির বাজার বলেই গণ্য।
বাজারে যেসব স্থাপনা ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে দাঁড়িয়ে তারমধ্যে অন্যতম পুরান বাজার জামে মসজিদ। দোতালা ভবনের এ মসজিদের গায়ে রঙিন কাচ ও পাথর দিয়ে কারুকাজ আছে। শতবর্ষের এ মসজিদের মিনারটিও বেশ উঁচু। এ ছাড়া দেড়শ বছরের বাজারের মন্দিরটি আছে এখানকার ঐতিহ্যের তালিকায়।
ছেলেবেলায় দেখা বাজারের দোকানগুলো অধিকাংশই ছিল টিনের। এখন কিছু ইটের ভবনও আছে। তবে বাজারের আগের রূপ পুরোটা বদলায়নি। অবশ্য যে রূপটি এখন দেখি না সেটি হলো বাজারের বানর। ছেলেবেলায় যখনই এ বাজারে এসেছি তখনই দেখি বাজারের দোকানগুলোর চালে অসংখ্য বানর ছোটাছুটি করছে। কিন্তু আগের তুলনায় এখন দেখা যায় খুবই কম। বাজারের দোকানদাররা জানান আধুনিক স্থাপনা, খাবারসহ নানা কারণে বানর এখন কম দেখা যায়।
আমরা বাজারের নানা পট্টি ঘুরে এসে বসি ঘোষ পট্টির সুনন্দা কেবিনে। প্রাচীন এ মিষ্টির দোকানটির প্রতিষ্ঠাতা সুরেশ চন্দ্র ঘোষ। এখন তার ছেলেরা এটি পরিচলানা করছেন। আমরা দই-মিষ্টি খাই। বেশ স্বাদের। তারপর চা পান করে বিদাই হই বাজার থেকে।
ছবি: লেখক