সাতসতেরো

‘জীবনের ভাঙা-গড়া তো থামে নারে মা’

চুন্নু শেখের বয়স এখন প্রায় ৬৫ বছর। পাঁচ কন্যা সন্তানের পিতা তিনি। ছেলে নেই বলে কোনো আক্ষেপ নেই। জীবনের কোনো ঘটনাকেই অস্বাভাবিক মনে করেন না তিনি। চুন্নু শেখের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, ততক্ষণে অগ্রহায়ণের কুয়াশা মাখা বুনো ঘাসফুলের পাপড়ি থেকে কুয়াশা মুছে গেছে। বাতাসে দুলছে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের ছোট বড় গাছের পাতা ও ফুল। কিছু পাতা ঝরে পড়েছে ধুলায় আর কিছু পাতা হলুদ হয়ে উঠেছে। কখন যেন আচমকা বাতাসে অথবা নিরবেই ঝরে পড়বে এইসব ফুল ও পাতা। তিনি বলেন, ‘আমার দুই সংসারে পাঁচ মাইয়া। প্রথম স্ত্রী তিন মেয়ে রাইখে মইরে গেছে। তারপর আবার বিয়া করছি। আল্লা আমার যা দেওয়ার দেছে। আমারে ছেলে দেলে, আল্লাই দেতে পারতো না? পারতো। কিন্তু দেয় নাই। সে খুশি, আমিও খুশি।’

চার বছর আগেও পিরোজপুরে গ্রামের বাড়িতে সাজানো গোছানো সংসার ছিলো তার। মুদি দোকান ছিল আর ছিল গাছের ব্যবসা। পিরোজপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে গাছ কিনে ইন্দিরা হাট, স্বরূপকাঠিতে বিক্রি করতেন। একদিন নাজিরপুর এলাকায় ট্রলারভর্তি গাছ নদীতে ডুবে যায়। সেই থেকে গাছের ব্যবসা ছেড়ে দেন তিনি। ছোট্ট মুদি দোকানই ছিল তার একমাত্র আয়ের উৎস। বাড়ি বলতে ডোবার ওপর ছোট্ট ঘর আর দোকান ছিল তার। কিন্তু দোকানসহ ঘরটি একটি ভেঙে পড়ে ডোবায়। ঋণ করে সংসার চালাতে গিয়ে দিনে দিনে ঋণ বেড়ে যাচ্ছিলো। এরপর ভাগ্যের সন্ধ্যানে ঢাকার মিরপুরে চলে আসেন চুন্নু শেখ। এখন পর্যন্ত দুই বার স্ট্রোক হয়েছে চুন্নুর। ফলে বাম হাত ঠিকমতো নাড়াতে পারেন না। ঢাকায় এসে প্রথমে ভিক্ষা করতেন, তারপর মানুষের ওজন মাপাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন তিনি।

চুন্নু শেখ সকাল ৮টায় শহীদ বুদ্ধিজীবী করবস্থানের গেইটে চলে আসেন। রাত আটটা পর্যন্ত এখানেই বসে থাকেন। এই সময়ের মধ্যে আয় হয়, তাই নিয়ে খুশি মনে বাসায় ফিরে যান। দিনে গড়ে ১২০ টাকা আয় হয় তার। কোনো কোনো দিন ২০০ টাকাও আয় করেন।

চুন্নু বলেন, ‘এইধারে এক প্রতিবন্ধী থাকতো, সে ভিক্ষা করতো। নাম মন্নু। ওর ধারে বইয়া আমিও ভিক্ষা করতাম। কিন্তু আমার ভালো লাগতো না। মন্নু বুদ্ধি দিলো ওজন মাপার মেশিন কেনার। তারপর ভিক্ষা ছাইড়া ছিলাম।’

ওজন মাপার মেশিনটাকে সম্পদ মনে করেন চুন্নু। দিনে এক কেজি চাল কেনার টাকা উঠলেই নাকি খুশি তিনি। জহুরাবাদ মাদবার গলিতে একটি ছোট্ট বাসায় স্ত্রী আর ছোট মেয়েকে নিয়ে বসবাস করেন চুন্নু। তার জীবনের লক্ষ্য ঋণ শোধ করতে পারলে গ্রামে ফিরে যাবেন। ছোট মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে আবারও মুদি দোকানের ব্যবসা চালু করবেন। তখন আর স্ত্রীকে চাকরি করতে দেবেন না। 

চুন্নুর ভাষায়, ‘হের (স্ত্রীর) তো বয়স হইতাসে, মেয়েটারেও বিয়া-শাদি দিতে হইবে।’

গ্রামে গিয়ে আবার নতুন করে সংসার সাজাবেন?— প্রশ্নের উত্তরে চুন্নু শেখ বলেন, ‘কী করবো? জীবনের ভাঙা -গড়া তো থামে নারে মা’