সাতসতেরো

আরজ দুয়ার পেরিয়ে

একজন দার্শনিক যে জীবন যাপন করেন, সে জীবনও নতুন দর্শন তৈরি করে। চারণ দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের জীবন নিয়ে তাই বলা যায়। আরজ আলী মাতুব্বর বরিশাল মেডিকেল কলেজকে মরণোত্তর দেহ দান করে গেছেন। যাতে মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা উপকৃত হয়। সেই অনুযায়ী, আরজ আলী মাতুব্বরের মৃতদেহ বরিশাল মেডিকেল কলেজকে দান করা হয়েছে। কিন্তু আরজ আলী মাতুব্বরের বাড়িতেই রয়েছে তার কবর।

অদ্ভূত ব্যাপার হলো, এই মনীষী তার জীবদ্দশায়— পড়ে যাওয়া দাঁত সংগ্রহ করে রাখতেন। আরজ আলীর যুক্তি ছিল, দেহের তিনটি অংশ পঁচে না। চুল, হাড় বা দাঁত এবং নখ। এই তিনটি জিনিস থেকে কয়েকটি দাঁত, কাটা চুল, আর কাটা নখ প্লাস্টিকের বয়ামে ভরে নিজ হাতে কবর তৈরি করে, দাফন করে গেছেন। সেই কবরে লেখা ‘আরজ’। আরজ আলী জীবদ্দশায় চল্লিশাও করে গেছেন। জানা যায়, তিনি পেশায় ছিলেন আমীন। তবে ৬০ বছর বয়সের পর তিনি যে টাকা পয়সা আয় করতেন তা সংসারে দিতেন না। তার যুক্তি ছিল, সরকারিভাবে মানুষ ৬০ বছর বয়সে অবসরে যায়। সুতরাং এই বয়সের পরে তিনি যা আয় করবেন তা সংসারের কেউ পাবে না। এর আগে তার অর্জিত সম্পদ উত্তরাধিকারদের মধ্যে ভাগ করে দেন আরজ আলী। আর পরের আয় দিয়ে গড়ে তোলেন একটি লাইব্রেরি। আরজ আলীর বাড়ির ছোট্ট ভিটেই সেই কবর, লাইব্রেরি আর তার থাকার ঘরটি নিভৃতে দাঁড়িয়ে আছে।

বরিশালের চরবাড়িয়া ইউনিয়নের লামচরীতে আরজ আলীর বাড়ি। বাড়ির সুদৃশ্য গেটে লেখা ‘আরজ দুয়ার’। এই দুয়ার দিয়ে প্রবেশ করার সময় মনে হলো আরজ আলী মাতুব্বরের দর্শনের জগতে প্রবেশ করছি। ছোটবেলায় আরজ আলী মাতুব্বরের বইপড়ে লামচরী নামটি ভুলতে পারিনি। সেই লামচরীতে গিয়ে আরজ আলীর স্মৃতি খুঁজছিলাম। তাকে বাস্তবে উপলব্ধি করতে পারলাম।

স্বশিক্ষিত, চারণ দার্শনিক ছিলেন আরজ আলী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি ছিল না অথচ তার রচিত বই এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও পড়ানো হয়ে থাকে। সুতরাং উনি কত বড় মাপের দার্শনিক ছিলেন, সহজেই অনুমান করা যায়। 

বাড়ির ভিটেই দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, এক জীবন কত কী খুঁজে ফেরা মানুষটি আর নেই। তাকে ঘিরে ওই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে আগ্রহ, কৌতুহলও তেমন আছে বলে মনে হলো না। কিন্তু তাতে আরজ আলী মাতুব্বকের উত্থাপিত প্রশ্ন গুলো সহজে অস্বীকার করা যায় না, এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে; এইতো! 

বাড়িতে এসেও যেন আরজ আলীর অন্দরে প্রবেশের অভিজ্ঞতা নেওয়া গেলো না। তার ঘরের দুয়ার বন্ধ ছিল। বাড়িতে কেউ ছিল না। স্থানীয় একজন জানালেন, ‘‘আরজ আলী মাতব্বরের এই বাড়িতে তার নাতি থাকে। তিনি পাশ্ববর্তী লামচরী বাজারে দোকান করে।’’ তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। 

কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে এই নিভৃত বাড়িতে কিছু সময় কাটিয়ে আবার রওনা দিলাম গলির হাট। পথে বেশ বিপত্তিতে পড়তে হয়েছিল। আগে এক সময় গলির হাট থেকে লামচরীতে আরজ আলীর বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি যেত। কিন্তু কীর্তনখোলা নদীর ভাঙনের ফলে রাস্তাটি ভেঙে গেছে। সুতরাং রাস্তাটি পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। কোনো কোনো যায়গায় এখনও বাঁশের ব্রিজ আছে। জোয়ারের পানি আসার ফলে রাস্তার কোথাও কোথাও কাঁদা পানি মাড়াতে হয়।

প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে তালতলী বাজারে পৌঁছলাম। তারপর গাড়িতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বাড়িটি দেখেও যেন দেখা হলো। যেমন আরজ আলী মাতুব্বরকে বুঝেও বোঝা যায় না।