১৫২১ খ্রিস্টাব্দের ৬ ফেব্রুয়ারি অটোম্যান বাহিনী কনস্টান্টিনোপল থেকে যাত্রা শুরু করে। এটি ছিল সুলতান সুলেমানের প্রথম অভিযান। অটোম্যান সেনারা যাত্রাকালে কঠোর শৃঙ্খলা মেনে চলেন। তারা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পথ চলতেন এরপর দুপুরে তাঁবু খাটিয়ে বিশ্রাম করতেন, বিশ্রাম শেষে আবারো পরদিন সকালে যাত্রা শুরু করতেন। অটোম্যান বাহিনীর সাবা ও দানিউবের মোহনায় পৌঁছে যায়। এখানে এসে সুলতানের আদেশে একটি দ্বীপে কামান বসানো হয়। সিদ্ধান্ত হয় এই দিক থেকে বিলগ্রেড দূর্গে গোলা নিক্ষেপ করার। টানা তিন সপ্তাহ গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে অটোম্যানরা কিন্তু কোন ফল হয় না। বেলগ্রেড দুর্গে ছিল মাত্র সাতশ সৈন্য, তাদের সহায়তায় কেউ এগিয়ে আসেনি কিন্তু দুর্গ ছিল মজবুত ফলে তারা বেঁচে যাচ্ছিল।
সুলতানের একরোখা মনোভাব এর ফলে টানা গোলা বর্ষণ চলতে থাকে। দুর্গ প্রাচীরের নিচে বসানো হয় মাইন। এরপর অবশেষে আত্মসমর্পণ করে দুর্গবাসীরা। বেলগ্রেড দুর্গের অধিবাসী এসে সুলতানের হাত চুম্বন করেন এবং সম্মান সূচক তাকে একটি আলখাল্লা পরিয়ে দেয়া হয়। সুলতানের আদেশে শুকরিয়া নামাজ আদায় করেন সেনারা। বেলগ্রেড দুর্গের ভেতরে তিনবার বেজে ওঠে জেনিসারি সংগীত। সুলতান নিজেও দুর্গায় প্রবেশ করেন এবং একটি গির্জায় সালাত আদায় করেন। বালি আগাকে বেলগ্রেডের নতুন গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়। তারপর আবার শুরু হয় উসমানীয়দের বিজয় যাত্রা। তারা সাবাক, সেলমিন ও সামনোদিরা শহর জয় করে। কেটে ফেলা হয় উপকূলের বনভূমি, উন্মুক্ত হয়ে যায় মধ্য ইউরোপগামী পথ। অটোম্যানদের বিজয় গাঁথা পৌঁছে যায় ইউরোপের সর্বত্র। ভেনিস ও রাশিয়ার দূতরা অভিনন্দন জানায় সুলতানকে। সে সময় তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিল। বেনিতে নিযুক্ত অটোম্যান দূতকে পাঁচশ স্বর্ণমুদ্র উপহার দেওয়া হয়। সুলতান ফিরে আসেন কনস্টান্টিনোপলে।
আইয়ুব মসজিদে তিনি শুকরিয়া নামাজ আদায় করেন। উৎসুক জনতা রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধ ভাবে অপেক্ষা করছিল। সুলতানকে এক নজর দেখার জন্য তারা ছিল উন্মুখ। বিজয়ের আনন্দের সুলতান সভার জন্য খাবারের আয়োজন করেন। হাঙ্গেরীয়, ওস্ট্রিয়া জয়ের পথের দার উন্মুক্ত হওয়ার পরেও সুলতান সেদিকে মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। তাকে বারবার বিরক্ত করছিল রোডস দ্বীপে অবস্থিত নাইট হসপিটালাররা। তাই তাদেরকেই সুলতান চাচ্ছিলেন প্রথমে শায়েস্তা করতে।
১৫২২ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে সুলতান রওনা হলেন রোডস অভিমুখে। সুলতানের সঙ্গে ছিল এক লাখ সেনা। তিনি বিপরীত প্রান্তে অবস্থান নিলেন। পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ৪০০ জাহাজের নৌবহর পাঠালেন রোডস দ্বীপ অভিমুখে। ২৬ জুন কোবাস পাশার নেতৃত্বে ৪০০ অটোম্যান জাহাজ এসে উপস্থিত হয়ে রোড দ্বীপে। ২৮ জুলাই সুলতান নিজে উপস্থিত হন। অটোম্যানরা পোতাশ্রয় অবরোধ করে ফেলে। ২৯ জুলাই থেকে শুরু হয় লাগাতার গোলাবর্ষণ। গোলাবর্ষণের প্রাচীরের খুব একটা ক্ষতি হচ্ছিল না। ৪ সেপ্টেম্বর মাইন বিস্ফোরণের ফলে প্রাচীরে প্রায় ১২ মিটার অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত লড়াই চলতে থাকে। অটোম্যানদের নেতৃত্বে ছিলেন কাশিম পাশা আর নাইট টেম্পলদের নেতৃত্বে ছিলেন দ্যা লায়ন অ্যাডাম। সেদিন অটোম্যানরা বারবার প্রাচীরে আঘাত হানলেও হামলা সফল হচ্ছিল না। ২৪ সেপ্টেম্বর সুলতানের নির্দেশে প্রাচীরের বিভিন্ন স্থানে জোরালো আঘাত হানা হয়। প্রচন্ড লড়াইয়ে শহীদ হয় ৪৫ হাজার অটোম্যান সেনা। সুলতান সেদিনের জন্য যুদ্ধ স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন। এদিকে অবরোধ দীর্ঘ হওয়ায় দুই পক্ষকে হারাতে হচ্ছিল প্রচুর সেনা। এদিকে শহরে বাড়তে থাকে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব। দুপক্ষই মনোবল ভেঙে যায় তবুও থেমে থেমে লড়াই চলতে থাকে। শেষে বাধ্য হয়ে ২২ ডিসেম্বর নাইটরা আত্মসমর্পণ করে।
সুলতান তাদেরকে দ্বীপ ত্যাগ করে যাওয়ার জন্য বারো দিনের সময় বেঁধে দেয়। এছাড়াও সুলতান ঘোষণা দেন যে কাউকে যেন জোর করে ধর্মান্তরিত করা না হয়, শিশুদেরকে দাস বানানো না হয়, কোন গির্জাকে মসজিদের রূপান্তরিত করা না হয়, এবং কারো সম্পদ কেড়ে না নেয়া হয়, কেউ বিদায় নিতে চাইলে তুর্কি জাহাজে করে তাকে ক্রিন্ট দ্বীপে পৌঁছে দেওয়া হবে। এমন শর্ত অবিশ্বাস করতে পারছিল না নাইটরাও। জয়ের পর সুলতানকে অভিনন্দন জানিয়ে ভেনিস, মক্কা ও পারস্য থেকে পত্র আসে। এমনকি মস্কো থেকেও পত্র মারফত অভিনন্দন জানানো হয় সুলতানকে। ১৫২৩ খ্রিস্টাব্দের পহেলা জানুয়ারি নাইটরা শহর ছেড়ে চলে যায়। জাহাজে করে যাত্রা শুরু করে ক্রিন্টের উদ্দেশ্যে। এই জয়ের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরে প্রতিষ্ঠা হয় অটোমানদের কর্তৃত্ব।
কনস্টান্টিনোপল, শাম ও কাইরোর বিভিন্ন বন্দরের সাথে যোগাযোগ সহজ হয়। ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সুলেমান হাঙ্গেরি যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন সে লক্ষ্যেই তিনি বেলগ্রেড জয় করেছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে নানা ব্যস্ততায় আর সামনে আগাতে পারেনি সুলতান।
১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, যে করেই হোক এবার চূড়ান্ত আঘাত হানবেন। ১ লাখ সেনা ও তিনশ কামান নয়ে ইস্তাম্বুলের আর্জিয়ানাপুল ফটক থেকে হাঙ্গেরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। দিনটি ছিল ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের একুশে এপ্রিল। তার সাথে ছিলেন উজিরে আজম ইব্রাহিম পাশা, ভগ্নিপতি মোস্তফা পাশা, আয়াস বে ও ইউনুস বে। অটোম্যান বাহিনী দ্রুত পথ চলছিল। তারা মাত্র পাঁচ দিনেই সাবা ও দাবরা নদী অতিক্রম করে।
হাঙ্গেরি রাজার দ্বিতীয় লু এর কোন শক্তি ছিলনা অটোম্যানদের মোকাবিলা করার। তিনি সর্বসাকুল্যে করলে মাত্র ৩০ হাজার সেনা একত্র করেন। তার বাহিনী ছিল ভারী বর্মে সজ্জিত নাইটদের উপর নির্ভরশীল। অটোম্যান বাহিনী ছিল তাদের চেয়ে অতি আধুনিক। তাদের ছিল মাস্কের সজ্জিত ২০০) জেনিসারি সেনা। ২৯ আগস্ট দুপুর তিনটার দিকে দুই বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যুদ্ধ মাত্র চার ঘন্টা স্থায়ী ছিল। যুদ্ধে ১৪ হাজারেরও বেশি হাঙ্গেরির সেনা নিহত হয়। পলায়ন করেন রাজা লুই।
১০ সেপ্টেম্বর সুলতান জনশূন্য বুদায় প্রবেশ করেন। দুর্গ ও এর আশেপাশের এলাকায় কয়েকটি অভিযান চালিয়ে ফিরে আসেন। বৈরী আবহাওয়ার জন্য ১৫২৯ ও ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা দখলের দুটি অভিযান ব্যর্থ হয়। ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রিসের উত্তরপূর্ব অংশে অটোমান নৌবহর ও খ্রিস্টান জোটের মধ্যে সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক প্রিভেজার যুদ্ধ। পোপ তৃতীয় পোলের আহবানে খ্রিস্টান নৌবহর একত্রিত হয়েছিল অটমান্দের মোকাবেলা করার জন্য। প্রিভেজার যুদ্ধ ছিল ১৬ শতকে ভূমধ্যসাগরে হওয়া বড় যুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি যুদ্ধ। এই যুদ্ধে খ্রিস্টান জাহাজ জোট অটোম্যানদের দুর্বল জাহাজের শক্তির কাছে হেরে যায়। দ্যা কিং অফ পাইরেটস খাইরুদ্দিন বারবারোসার দক্ষতায় অটোম্যানদের জয় নিশ্চিত হয়। এই যুদ্ধের পর থেকে লিপানটোর যুদ্ধের আগ পর্যন্ত তেত্রিশ বছর ভূমধ্যসাগরে একক আধিপত্য ছিল অটোম্যানদের।
১৫৪১ সালে সুলতান তার বাহিনী নিয়ে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট অবরোধ করেন। সুলতানের বাহিনীতে সেনা সংখ্যা ছিল ৩১০০০ এর মধ্য জেনিসারি সৈন্য ছিল ৬৩৬২ জন। ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দের ২১ আগস্ট এই বাহিনী বুদাপেস্টে পৌঁছে যায়। যুদ্ধে অটোম্যানরা জয়ী হয়। প্রায় দেড়শ বছর পর্যন্ত হাঙ্গেরিতে অটোমানদের শাসন স্থায়ী হয়।। সুলতানের শেষ অভিযান ছিল হাঙ্গেরিতে। ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ আগস্ট অটোম্যান বাহিনী জিকেতবার দুর্গ অবরোধ করে। যুদ্ধ চলাকালীন সুলতান ছিলেন গুরুতর অসুস্থ। ডাক্তার বারবার নিষেধ করছিলেন কিন্তু সুলতান কারো কথা না শুনেই যুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় তার বয়স ছিল ৭২ বছর। দুর্গ অবরোধ করার পর অটম্যান কামানগুলো একটানা গোলা বর্ষণ করতে থাকে। কোন ফলাফল দেখতে না পেয়ে সুলতান মানসিকভাবে কিছুটা ভেঙে পড়েন। ৬ সেপ্টেম্বর সুলতান সেনাদের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেন এই ভাষণের পর তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। সাথে সাথে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। চিকিৎসক সুলতানকে পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন। পরে ইস্তাম্বুলে তার নির্মিত সোলাইমানিয়া মসজিদের সামনে তাকে দাফন করা হয়।
সুলতান সুলেমান ছিলেন অটোম্যান শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী একজন শাসক। তিনি নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন তার এই ডায়েরী বা দিনলিপিও হয়ে উঠেছে ইতিহাসের মূল্যবান উৎস। তিনি মুহিব্বি ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন। তিনি নিজ হাতে কুরআনুল কারিমের আটটি কপি সংকলন করেন এবং সুলাইমানিয়া মসজিদে দান করেন।
তার শাসনামলে অটোম্যান সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি পেয়েছিল অনেক। জনসংখ্যা দেড় কোটি থেকে আড়াই কোটিতে পৌঁছেছিল। আধুনিক হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট থেকে সৌদি আরবের মক্কা এবং আলজেরিয়া থেকে বাগদাদ ছিল তার রাজ্যের সীমানা। ভারত সাগর ও ভূমধ্যসাগরে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াতো তার নৌবহর। ১৫৪৮ সালে অটোম্যান নৌবহর পর্তুগিজদের সাথে লড়াই করে এডেন বন্দর উদ্ধার করে নেয়। তিনি তিনবার ইরানের শিয়া পরিচালিত সাফাবি সাম্রাজ্যে আক্রমণ করেছিলেন। সুলেমানের মৃত্যুর পর অটোমানদের মধ্যে এমন শক্তিশালী শাসক আর দেখা যায়নি। এরপর দিনদিন তাদের দুর্বলতা প্রকট হতে থাকে। ক্রমশ প্রতাপ কমতে থাকে অটোম্যান সাম্রাজ্যের। যার চূড়ান্ত পতন ঘটে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে কামাল পাশার হাতে খেলাফত বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে।
প্রথম পর্ব: সুলতান সুলেমানের ইতিহাস