শাহ মতিন টিপু : ভ্যালেন্টাইন ডে কে বলা হয় ভালবাসা দিবস। এই ভালবাসা প্রেমিক-প্রেমিকার। যুদ্ধের রক্তভূমিতেও দুটি বিপরীত লিঙ্গের মানুষ একে অপরকে খুঁজতে থাকে পরিপূর্ণভাবে বাঁচার স্বপ্নে। ভ্যালেন্টাইন ডে কে ঘিরে আছে আরোও কয়েকটি দিবস, যা অনেকের কাছেই অজানা।
যেমন- ৭ ফেব্রুয়ারি ‘রোজ ডে’, ৮ ফেব্রুয়ারি ‘প্রোপজ ডে’, ৯ ফেব্রুয়ারি ‘চকলেট ডে’, ১০ ফেব্রুয়ারি ‘টেডি ডে’, ১১ ফেব্রুয়ারি ‘প্রমিস ডে’, ১২ ফেব্রুয়ারি ‘কিস ডে’, ১৩ ফেব্রুয়ারি ‘হাগ ডে’, ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’। এই দিনগুলি অর্থাৎ ৭ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি সেই অর্থে সামাজিকভাবে তেমন গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু ১৪ ফেব্রুয়ারির কথা সম্পূর্ণ আলাদা। এর সাথে জড়িয়ে আছে এক মর্মান্তিক ইতিহাস- বিশ্ব প্রেমের ইতিহাস।
এই ঘটনার সময়কাল ২৬৯ খ্রীষ্টাব্দে। তখন রোমে ‘জুনো’ দেবীর আরাধনাকে ঘিরে ‘লিউপার কেলিয়া’ নামের উৎসব হতো। ‘জুনো’ প্রেমের দেবী। ‘লিউপার কেলিয়া’ ছিল সেই প্রেমের বন্ধনের উৎসব। উৎসবটি মজার। একটা কাঁচের জারে অবিবাহিত মেয়েরা তাদের নাম কাগজে মুড়ে রেখে দিতেন। অবিবাহিত পুরুষেরা এ জার থেকে একটি করে নাম তুলে নিয়ে ওই মেয়ের সঙ্গে এক সপ্তাহ মেলামেশার সুযোগ পেত। যদি তাদের মনের মিলন হত তাহলে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হত, না হলে আবার পরবর্তী বছরের জন্য অপেক্ষা। এই আনন্দময় উৎসবের সূচনাকাল ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি।
এই জনপ্রিয় উৎসবে এক সময় নেমে এল রাজতন্ত্রের কালো ছায়া। রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস সব দেবদেবীর আরাধনা বন্ধ করে নিজের ধর্মই রাষ্ট্রধর্ম বলে ফরমান জারি করেন। সম্রাট ছিলেন খুবই যুদ্ধপ্রিয়। তাই ‘লিউপার কেলিয়া’ উৎসবের ওপর তার বিশেষ রোষানল ছিল। কারণ অধিকাংশ যুবক বিবাহিত জীবন বেছে নেওয়ায় যুদ্ধে যেতে চাইত না। ফলে সেনার অভাব পূরণ করতে তিনি বিবাহও নিষিদ্ধ করেন। এর অবমাননায় চরম শাস্তি পেতে হত।
ইতিহাসে তাকালে দেখা যায়, যে কোনো ধর্মেই যখন কোনো করাল ছায়া আসে তখনই আবির্ভাব হয় মহামানবের। এখানেও একজন ধর্মযাজক আবিভূর্ত হলেন যার নাম সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। তিনি এই রাজধর্মের তীব্র বিরোধীতা করেন।
প্রেমিক-প্রেমিকারা গোপনে এই ধর্ম যাজকের কাছে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতেন স্থানীয় গীর্জায়। এভাবে যুব সমাজের একটা বিরাট অংশ সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের অনুগামী হয়ে পড়ে। তরুণ ধর্মযাজক ভ্যালেন্টাইনের অনুগামীদের দেখে ক্লডিয়াস রাগে জ্বলে ওঠেন। তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। আচমকাই একজোড়া যুবক-যুবতীকে বিবাহ দেবার সময় ধরাও পড়ে যান। বন্দী হন।
সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের বন্দীতে যুব সমাজের মধ্যে চাপা অসন্তোষ দেখা দেয়। অসন্তোষ যাতে না ছড়ায় সেজন্য সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীকে এক নির্জন কুঠুরিতে কড়া প্রহরায় রাখা হয়, যাতে তার সঙ্গে কেউ দেখা না করতে পারে। এখানেই ঘটে এক আশ্চর্য ঘটনা।
ভ্যালেন্টাইনকে যিনি পাহারা দিতেন সেই পাহারাদারের মেয়ে প্লাতিনা ছিলেন জন্মান্ধ। তা ছাড়াও প্রায়ই তীব্র মাথা যন্ত্রণায় কষ্ট পেতেন। এমনই প্রহরাকালে প্রহরীর বাড়ি থেকে খবর আসে মৃত্যুসম যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে প্লাতিনা। প্রহরী একবার তাকায় সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের দিকে। তিনি নাকি অলৌকিক ক্ষমতায় অধিকারী। প্রহরীও একজন পিতা। ভুলে যান রাজ নির্দেশ। গোপনে যন্ত্রণাগ্রস্ত মেয়েকে নিয়ে আসেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের কাছে। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন প্লাতিনার কপালে হাত রাখতেই মাথা যন্ত্রণা নিমেষে উধাও হয়ে যায়। কী হয়েছে প্রহরী জানতে পারে না। প্লাতিনা যখন ফিরে আসেন তার মুখে তখন স্বর্গীয় হাসি।
এরপর প্লাতিনাকে প্রায় প্রতিদিন সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। নিভৃতে কী কথা হয়, কেউ জানতে পারে না। মাথা যন্ত্রণাও চিরতরে ঠিক হয়ে যায়। এদিকে সম্রাট ক্লডিয়াস ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যু দিন ধার্য করে ফেলেছেন। সেই ‘লিউপার কেলিয়া’ উৎসবের দিনটি অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারি সেন্ট ভ্যালেন্টাইন একটা ছোট্ট চিঠি প্রহরীর হাতে দিয়ে বলেন তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর সেটি যেন প্লাতিনার হাতে দেন।
প্লাতিনা সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিজের চোখেই সেই চিঠিটি পড়েন। ভ্যালেন্টাইনকে হত্যার প্রতিবাদে নিজেওআত্মহত্যা করেন।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫/টিপু/রণজিৎ