স্বাস্থ্য

ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে ক্যারিয়ার গড়বেন কীভাবে

‘ফিজিওথেরাপি’ শব্দটির সাথে আজকাল আমরা সবাই কম-বেশি পরিচিত। ফিজিওথেরাপি একটি স্বতন্ত্র চিকিৎসাব্যবস্থা, যেখানে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াবিহীন শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়ে থাকে।

ফিজিওথেরাপিস্ট হতে চাইলে কমপক্ষে চার বছরের কোর্স ও এক বছরের ইন্টার্নশিপসহ ফিজিওথেরাপি বিষয়ে ব্যাচেলর বা স্নাতক ডিগ্রি গ্রহণ করতে হবে। শুধুমাত্র ফিজিওথেরাপি বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীকেই ‘ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক’ বলা হয়ে থাকে। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট সাধারণত অসুস্থতা, আঘাত ও শারীরিক প্রতিবন্ধিতা থেকে সৃষ্ট শারীরিক সমস্যা নির্ণয় ও চিকিৎসার কাজ করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, একজন রোগী কোনও প্রকার রেফারেন্স ছাড়াই সরাসরি একজন ফিজিওথেরাপিস্টের কাছ থেকে চিকিৎসা নিতে পারবেন। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট নামের পূর্বে ‘ডা.’ ব্যবহার করতে পারবেন।

১৯৬০ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে স্বতন্ত্র পেশা হিসেবে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসাসেবা আত্মপ্রকাশ করে। ঐ বছর রাজধানীর সেগুনবাগিচায় প্রতিবন্ধী শিশুদের পুনর্বাসনের জন্য প্রথম ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ফিজিওথেরাপি বিভাগ ও স্নাতকোত্তর অর্থোপেডিকস কোর্সের সঙ্গে ফিজিওথেরাপি বিষয়ে স্নাতক কোর্স চালু হয় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত)।

দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অফ দ্য প্যারালাইজড (CRP); হ্যান্ডিক্যাপ বাংলাদেশ, বিভিন্ন পুনর্বাসন প্রকল্প, স্পোর্টস দল, বিভিন্ন জায়গায় কাজের সুযোগ আছে ফিজিওথেরাপিস্টদের। বাংলাদেশে স্নাতক ডিগ্রিধারী ফিজিওথেরাপিস্টের সংখ্যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম।

দেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে ফিজিওথেরাপি পড়ার সুযোগ রয়েছে। তবে, বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপি নিয়ে পড়ার সুযোগ এখনও সীমিত। মোট ৮টি প্রতিষ্ঠানে ফিজিওথেরাপিতে পাঁচ বছর মেয়াদী বিএসসি ইন ফিজিওথেরাপি ডিগ্রি দেওয়া হয়, যার মধ্যে শেষ এক বছর ইন্টার্নশিপ রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান ৫টি। এর মধ্যে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন (NITOR) ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত ইন্সটিটিউট অফ হেলথ টেকনোলজি-ঢাকা (IHT) সরকারি প্রতিষ্ঠান।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- সাইক ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল টেকনোলজি, স্টেট কলেজ অফ হেলথ সায়েন্সেস ও সিআরপির অঙ্গ সংস্থা বাংলাদেশ হেলথ প্রফেশনস ইন্সটিটিউট (BHPI)।

ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন (NITOR): সরকারি প্রতিষ্ঠান নিটোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের অধীনে স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করতে পারবেন।

পাঁচ বছর মেয়াদী বিএসসি ইন ফিজিওথেরাপি কোর্সে (এক বছর ইন্টার্নশিপসহ) ভর্তি হতে চাইলে প্রার্থীকে অবশ্যই জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন বিষয়সহ মাধ্যমিক ও  উচ্চমাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।

সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অফ দ্য প্যারালাইজড (CRP): এ প্রতিষ্ঠানের অধীনে বাংলাদেশ হেলথ প্রফেশনাল ইন্সটিটিউটে (BHPI) স্নাতক, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ফিজিওথেরাপি বিষয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে। বিএইচপিআই থেকে বিএসসি ইন ফিজিওথেরাপির পাশাপাশি বিএসসি ইন অকুপেশনাল থেরাপি ও বিএসসি ইন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি ডিগ্রি দেওয়া হয়।

গণবিশ্ববিদ্যালয়: ঢাকার সাভারে অবস্থিত স্বতন্ত্র গণবিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিওথেরাপি বিষয়ে ইন্টার্নশিপসহ পাঁচ বছর মেয়াদী স্নাতক ও দুই বছর মেয়াদী স্নাতকোত্তর কোর্স চালু আছে।

স্টেট কলেজ অফ হেলথ সায়েন্স: ঢাকায় অবস্থিত স্টেট কলেজ অফ হেলথ সায়েন্সে স্নাতক পর্যায়ে বিএসসি ইন ফিজিওথেরাপি এবং ডিপ্লোমা ইন ফিজিওথেরাপি বিষয়ে পড়ার সুযোগ দিয়ে থাকে।

সাইক কলেজ অফ মেডিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (SAIC): ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত সাইক কলেজ অফ মেডিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে বিএসসি ইন ফিজিওথেরাপি এবং ডিপ্লোমা ইন ফিজিওথেরাপি বিষয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে।

ইনস্টিটিউট অফ হেলথ্ টেকনোলজি (IHT): ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে ইনস্টিটিউট অফ হেলথ্ টেকনোলজিতে বিএসসি ইন ফিজিওথেরাপি (ঢাকা ও রাজশাহী) এবং ডিপ্লোমা ইন ফিজিওথেরাপি বিষয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ্ সায়েন্স (IIHS): ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ্ সায়েন্সে বিএসসি ইন ফিজিওথেরাপি বিষয়ে বেসরকারিভাবে পড়ার সুযোগ রয়েছে। এটি জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ মেডিক্যালের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান।

এ ছাড়াও, সরকারি পর্যায়ে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (JUST)-এ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ফিজিওথেরাপি বিষয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে।

একজন ফিজিওথেরাপিস্টে হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ রয়েছে অনেক। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, যেমন: পঙ্গু হাসপাতাল, জাতীয় ট্রমা সেন্টার, সরকারি-বেসরকারি ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন কেন্দ্র বা স্পোর্টস দল ও ক্লাবে সুযোগ রয়েছে।

ফিজিওথেরাপির যথেষ্ট জ্ঞান ও দক্ষতা থাকলে আন্তর্জাতিক এনজিও-তে উচ্চপর্যায়ে কাজ করা সম্ভব। এ ছাড়া, ফুটবল, হকি, ভলিবলসহ অন্যান্য জাতীয় দলে ফিজিও কনসালট্যান্টের কাজ করে গড়ে তোলা সম্ভব আকর্ষণীয় ক্যারিয়ার।

উন্নত বিশ্বে ফিজিওথেরাপিস্ট অন্যতম পছন্দের পেশা হলেও বাংলাদেশে এ পেশা এখনও অনেক চ্যালেঞ্জিং অবস্থায় আছে। বাংলাদেশ সরকার এখন প্রতিবন্ধী ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প চালু করায় ফিজিওথেরাপিস্টদের জন্য সরকারি চাকরির সুযোগ বেড়েছে।

একটি বিষয় সবসময় মনে রাখা দরকার। এ পেশা সরাসরি জনস্বাস্থ্যের সাথে জড়িত। আপনার জ্ঞান-দক্ষতা আর আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাঁচাতে পারেন বহু মানুষের জীবন।

লেখক: ফিজিওথেরাপিস্ট, বিপিটি (জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান), পিজিডি ইন স্পোর্টস সায়েন্স (বিকেএসপি)।