সারাবিশ্বকে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সারাবছর একটি মহামারির সঙ্গে বসবাস ও লড়াই করতে হয়েছে। ২০২০ সাল শুরু হয়েছিল করোনাভাইরাসের মহামারি দিয়ে, আবার বছর শেষ হতে যাচ্ছে করোনার নতুন রূপের বিস্তারের আতঙ্ককে সঙ্গে নিয়ে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে বিশ্ববাসীকে প্রথমবারের মতো বিস্তৃত লকডাউনের সঙ্গে পরিচিত হতে হয়েছে। ভাইরাসের কারণে বিপর্যস্ত হয়েছে অর্থনীতি, এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও পড়েছিল এর প্রভাব।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে প্রথম করোনার সংক্রমণ ঘটে। প্রথম দিকে এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত কোনো তথ্যই ছিল না। সংবাদমাধ্যমের ওপর বেইজিংয়ের কড়াকড়ির কারণে চীনের বাইরে ভাইরাসের ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্য জানা যেতো না। তবে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করলে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তদন্ত শুরু করে চীনা বিজ্ঞানীরা। ওই মাসের প্রথম সপ্তাহে এটিকে একটি নতুন ধরনের করোনাভাইরাস হিসেবে ঘোষণা দেন তারা। সপ্তাহের ব্যবধানে ভাইরাস চীনের বিভিন্ন প্রদেশে এবং ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই প্রাদুর্ভাবকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা দেয়।
করোনার কারণে বিশ্ববাসী প্রথম লকডাউনের সঙ্গে পরিচিত হয়। সংক্রমণ প্রতিরোধে মার্চে একের পর এক দেশ লকডাউনের ঘোষণা দিতে থাকে। এক মাসেরও বেশি সময় লকডাউনের কবলে থাকায় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এপ্রিলের শেষ নাগাদ বিভিন্ন দেশে লকডাউন প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয়। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এসময় হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিল, এতো তাড়াতাড়ি বিধিনিষেধ তুলে নিলে করোনাভাইরাসের ভয়াবহ বিস্তার ঘটতে পারে।
জুলাইয়ে এসে বিশ্বের কয়েকটি দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে যায় পঙ্গপাল। ইরান, পাকিস্তান ও ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ফসল ধ্বংস করার পর পঙ্গপাল পূর্ব আফ্রিকার দিকে অগ্রসর হয়।
টিকা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও ২০২০ সালে নতুন রেকর্ড হয়েছে। যে কোনো টিকা উদ্ভাবন, উন্নয়ন ও বাজারে আসতে অন্তত কয়েকটি বছর সময় লাগে। করোনার মহামারি ঠেকাতে চলতি বছর টিকা উদ্ভাবনে তোড়জোড় শুরু করে উন্নত দেশগুলো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ৬০টি টিকার ক্লিনিক্যাল উন্নয়ন হয়েছে এবং ট্রায়ালে আছে আরও ১৭২টি। একটি রোগ প্রতিরোধে এতোগুলো টিকা উন্নয়নে কাজ করা রীতিমতো রেকর্ড। বছরের শেষ নাগাদ অর্থাৎ ডিসেম্বরে প্রথম সপ্তাহে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে টিকার অনুমোদন দেয় যুক্তরাজ্য।
আগস্টে লেবাননের বৈরুত বন্দর ধ্বংসের ঘটনায় হতচকিত হয়েছিল পুরো বিশ্ব। আনবিক বোমা হামলার কথা বাদ দিলে এটি ছিল বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী একটি বিস্ফোরণ । এ ঘটনায় প্রায় ২০০ মানুষ নিহত হয় এবং আহত হয় পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে চলতি বছর সমালোচনার কেন্দ্রে ছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনকে কেন্দ্র করে দেশটির এক স্কুলশিক্ষককে গলা কেটে হত্যা করে এক মুসলিম তরুণ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাক্রন ফ্রান্সে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। এমনকি তিনি ইসলামকে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করেন। ফরাসি প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণায় মুসলিম দেশগুলোকে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়।
করোনার মতো বছরজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সারাবিশ্বে যখন করোনা মহামারি প্রতিরোধে কাজ চলছে যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোতে তখন কোভিড-১৯ ঠেকাতে তেমন কোনো প্রস্তুতিই নেওয়া হয়নি। অর্থনীতি রক্ষার অজুহাতে ট্রাম্প লকডাউনের পথে হাঁটতে অস্বীকার করেছিলেন। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত করোনার বিস্তার ঘটে। করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা এখন বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রেই। সুরক্ষা ব্যবস্থা নিতে অনাগ্রহী ট্রাম্প নিজেও করোনায় আক্রান্ত হন। যুক্তরাষ্ট্রে বিভেদের রাজনীতি উস্কে দেওয়া ট্রাম্প নভেম্বরের নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। তবে নির্বাচনের ফল নিয়েও কম নাটক করেননি তিনি। ফল প্রত্যাখ্যান করে আদালত পর্যন্ত গিয়েছেন। তবে তাতেও কোনো লাভ হয়নি।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে যুক্তরাজ্যে করোনার নতুন একটি রূপ শনাক্ত হয়েছে। উহানে করোনার যে স্ট্রেনটি শনাক্ত হয়েছিল এটি তারচেয়েও ৭০ গুণ বেশি সংক্রামক। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য এটি তুলনামুলকভাবে কম বিপজ্জনক। ইতোমধ্যে ১৫টিরও বেশি দেশে শনাক্ত হয়েছে নতুন স্ট্রেনটি।