আন্তর্জাতিক

চীন কেন দৈর্ঘ্যে এভারেস্টের চেয়েও বড় গর্ত খুঁড়ছে?

ভূপৃষ্ঠের গভীরে ৩৩ হাজার ফুট গর্ত খুঁড়ছে চীন। এই গর্ত ঘিরেই তৈরি হয়েছে চাঞ্চল্য। ইতোমধ্যে গর্ত খননের কাজ শুরু হয়েছে। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সিনহুয়া বলছে, চলতি মাসে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্বশাসিত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ টিলা মরুভূমি তাকলামাকানে গর্ত খোঁড়ার কাজ শুরু হয়েছে। 

তাকলামাকান মরুভূমির বিস্তৃতি ৩ লাখ ৩৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার। গর্তটি মাটির ১০ স্তর ভেদ করবে। প্রকল্পটি শেষ হতে সময় লাগবে ৪৫৭ দিন। এ সময়ের মধ্যে দুই হাজার টনের বেশি ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করবেন সংশ্লিষ্টরা।

রাষ্ট্রীয় পেট্রোরাসায়নিক কর্পোরেশন সিনোপেক এই প্রকল্প পরিচালনা করছে। তারা জানিয়েছে, এর উদ্দেশ্য ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে গভীরতার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া। গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষৎকারে তারা বলছে, খনিজ ও জ্বালানিসম্পদ শনাক্ত করার পাশাপাশি ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো পরিবেশগত বিপর্যয়ের ঝুঁকি পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে তারা এ উদ্যোগ নিয়েছে।

বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পৃথিবীর গভীরে মানুষ নির্মিত সরু ও গভীর গর্তকে ‘বোরহোল’ বলা হয়। সাধারণত, তেল বা পানি এবং অন্যান্য খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য এই গর্ত করা হয়। এমন বোরহোল চীনের একটি উচ্চাকাঙ্খী পদক্ষেপ। এটি চীনের সবচেয়ে বড় খনন প্রকল্প যা প্রথমবারের মতো ১০ হাজার মিটার কূপ খননের প্রতিবন্ধকতা ছাড়িয়ে যাবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই গর্ত ভূপৃষ্ঠের উপর থাকা এভারেস্ট পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের চেয়েও বেশি গভীর।

চিলির ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব টেমুকোর সিভিল ওয়ার্ক অ্যান্ড জিওলজি বিভাগের পরিচালক ভূপদার্থবিদ ক্রিশ্চিয়ান ফারিয়াস বিবিসিকে বলেন, ভূপৃষ্ঠের কাছের ১০ কিলোমিটার অনুসন্ধানে আমরা সাধারণত সিসমিক টমোগ্রাফি এবং অন্যান্য কৌশল ব্যবহার করি। এ ধরনের প্রকল্প খুব দরকারি। কারণ এগুলো এই অনুসন্ধানের পক্ষে বাস্তব প্রমাণ দেয়। তবে মাটির কঠিন অবস্থা এবং উচ্চ মাত্রায় চাপ ও চরম তাপমাত্রার কারণে তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের উত্তোলনের সময় ব্যাপক প্রযুক্তিগত এবং কারিগরি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে চীনকে। এ ছাড়া গর্তের স্থিতিস্থাপকতা ধরে রাখাটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। 

মার্কিন সম্প্রচার মাধ্যম ব্লুমবার্গকে সাক্ষাৎকার দেয়া চাইনিজ একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একজন বিজ্ঞানী সান জিনশেং বলেন, এই নির্মাণ প্রকল্পের সমস্যাটা অনেকটা দুটি পাতলা স্টিলের তারের উপর একটা বড় ট্রাক চালিয়ে নেওয়ার মতো কঠিন। 

যদিও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত মাটির নিচে গভীরতা ধরে রাখতে পেরেছিল। তবে, মাটির এতো নিচে পৌঁছানোটা আজও প্রচণ্ড জটিল। এই বোরহোল পৃথিবীর অভ্যন্তরে ১০টিরও বেশি মহাদেশীয় স্তর বা শিলার স্তর ভেদ করবে এবং পৃথিবীর ভূত্বকের ক্রিটেসাস সিস্টেমে পৌঁছে যাবে। যা প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি বছর আগে গঠিত শিলার বৈশিষ্ট্যযুক্ত।

চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (সিএনপিসি) প্রতিনিধি লিউ শিয়াওগ্যাং বলেন, এই কূপ খনন করার দুটি উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত এই প্রকল্পটি গভীর অনুসন্ধানে নতুন মেশিন বা যন্ত্রপাতি উৎপাদনে পেট্রোচায়নার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। প্রকল্পের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো- দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অতিগভীর তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধান। 

বলাবাহুল্য সিএনপিসি শুধু চীনেরই সর্ববৃহৎ তেল-গ্যাস কোম্পানি নয়, বরং বিশ্বেরও অন্যতম বড় তেল ও গ্যাস কোম্পানি এটি।

চীনের প্রেসিডেন্ট জিনপিং একে পৃথিবীর গভীরে অন্বেষণ অভিযান বলে অভিহিত করেছেন। ২০২১ সালে বিজ্ঞানীদের একটি সম্মেলনে গিয়ে এই প্রকল্পে দেশের আরো উন্নতি কামনা করেন তিনি। 

দেশটির প্রেসিডেন্ট বিজ্ঞানীদের ভূপৃষ্ঠের গভীরতা নিয়ে গবেষণা করার বিষয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানোর দুই বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর চীনে গভীরতম গর্ত খোঁড়ার এই প্রকল্প শুরু হলো। চীন এমন এক সময় এ ধরনের পদক্ষেপ নিলো যখন দেশটি বৈশ্বিক প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক শক্তি হিসেবে নিজের অন্তর্ভূক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিচ্ছে। আশ্চর্যজনকভাবে, এই কূপটি সেদিনই খোঁড়া শুরু হয় যেদিন বেইজিং ২০৩০ সালে চাঁদে পৌঁছানো প্রকল্পের অংশ হিসেবে কক্ষপথে মহাকাশ স্টেশনে তিনজন নভোচারীকে পাঠায়।

তবে চীনের খোঁড়া এই ৩২ হাজার ফুটের গর্তকে অবশ্য ‘পৃথিবীর গভীরতম’ বলা ঠিক হবে না। কারণ, সেই তকমা এখন পর্যন্ত আছে রাশিয়ার কাছে। রাশিয়ার ‘কোলা সুপারডিপ বোরহোল’র গভীরতা ১২ হাজার ২৬২ মিটার (৪০ হাজার ২৩০ ফুট)। ১৯৮৯ সালে এই গর্ত খোঁড়ার কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। গর্তটি খুঁড়তে সময় লেগেছিল ২০ বছর। তবে প্রযুক্তির উন্নতিতে গর্ত খোঁড়ার কাজ এখন আগের চেয়ে সহজ হয়েছে। তাই ৩২ হাজার ফুটের গর্ত খুঁড়তে হয়তো ২০ বছর সময় নেবে না চীন। কাজটি করতে তারা সময় নেবে মাত্র ৪৫৭ দিন।