আন্তর্জাতিক

রাশিয়ায় হঠাৎ আইএস কেন?

২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েছিল, তারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটকে (আইএস) মধ্যপ্রাচ্যে নির্মূল করেছে। এরপর থেকে অবশ্য আইএসের আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। 

তবে ২০২১ সালে তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর যখন বিদেশিরা কাবুল ছেড়ে যাচ্ছিল তখন বিমানবন্দরে ভয়াবহ হামলা চালায় আইএসের আঞ্চলিক শাখা ইসলামিক স্টেট ইন খোরাসান। তবে তালেবানের ব্যাপক অভিযানের পর আইএস-খোরাসানের আর কোনো সাড়াশব্দ মেলেনি। শুক্রবার রাশিয়ার রাজধানী মস্কোয় ক্রোকাস সিটি হলে সন্ত্রাসী হামলায় ১৩৩ জন নিহত হয়। এ ঘটনার পর সবার আগে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়, আইএস-খোরাসান এই হামলা চালিয়েছে বলে দায় স্বীকার করেছে।

গত দুদিন ধরে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আবার আলোচনায় চলে এসেছে আইএস। এই মুহূর্তে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, যে গোষ্ঠীটিকে যুক্তরাষ্ট্র নির্মূল করেছে বলে দাবি করেছিল, তারা হঠাৎ করে কীভাবে মাথাচাড়া দিলো? রাশিয়া যখন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে তখন সেদেশেই কেন আইএস হামলা চালালো?

সিরিয়ার বাশার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত এবং মধ্যপ্রচ্যে ইরানের আধিপত্য বিস্তার ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র আইএসকে সৃষ্টি করেছিল। গোষ্ঠীটির যখন উত্থান ঘটতে শুরু করেছিল তখন তাদের হাতে ছিল চকচকে মার্কিন এম-১৬ রাইফেল। এগুলো মার্কিন সেনাবাহিনীরই সরবরাহ করা বলে জানিয়েছিলেন বিশ্লেষকরা।

২০১৪ সালে কাউন্টার পাঞ্চ সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘আমেরিকা আইএসআইএসকে তিনটি উপায়ে ব্যবহার করছে: মধ্যপ্রাচ্যে তার শত্রুদের আক্রমণ করতে, বিদেশে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের অজুহাত হিসেবে কাজ করতে এবং দেশে একটি তৈরি করা অভ্যন্তরীণ হুমকি উস্কে দিয়ে আক্রমণাত্মক অভ্যন্তরীণ নজরদারির নজিরবিহীন সম্প্রসারণের ন্যায্যতা দিতে।’ ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল মার্টিন ডেম্পসি কংগ্রেসের শুনানিতে বলেছিলেন ‘আমি প্রধান আরব মিত্রদের জানি যারা (আইএসআইস) কে অর্থায়ন করে।’ আর্মড সার্ভিসেস কমিটির সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম এর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন, ‘তারা তাদের অর্থায়ন করে কারণ ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (সিরিয়ান প্রেসিডেন্ট) আসাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারেনি, তারা আসাদকে পরাজিত করার চেষ্টা করছিল’। মার্কিন কর্মকর্তাদের এ ধরনের স্বীকারোক্তিতে প্রতীয়মান হয় যে, আইএসের উত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল।

আফগানিস্তানে আইএস-খোরাসানকেও প্রত্যক্ষভাবে রক্ষা করে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। তালেবানকে দুর্বল করার একটি গোপন প্রচেষ্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রই এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটিকে গড়ে তুলেছিল। পূর্ব আফগানিস্তানের যে এলাকাটি আইএস-খোরাসান নিয়ন্ত্রিত করতো সেই অঞ্চলটিকে কৌশলগতভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করতো যুক্তরাষ্ট্র। ওই এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র রক্ষনাত্মক ভূমিকায় ছিল। অথচ তালেবান নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে পুরোপুরি আক্রমনাত্মক অবস্থান ছিল ওয়াশিংটনের।

দুই বছর ধরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনকে সহযোগিতা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সহায়তায় ইউক্রেন এখনও পর্যন্ত নিজেদের হাতছাড়া অঞ্চলগুলো রাশিয়ার কাছ থেকে উদ্ধার করতে পারেনি ইউক্রেন। বরং গত সপ্তাহে ইউক্রেনে ব্যাপক মাত্রায় হামলা শুরু করে রাশিয়া। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, রাশিয়ায় যেকোনো সময় সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। বিষয়টি এমন যে, ‘রান্নাঘরে কে রে? আমি চিনি খাই না’। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মস্কোর ক্রোকাস সিটি হলে হামলার কয়েক ঘণ্টার মাথায় যুক্তরাষ্ট্র জানালো, তারা নিশ্চিতভাবে জানতে পেরেছে আইএস-খোরাসান এই হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এসব আগ বাড়ানো পদক্ষেপে বোঝাই যাচ্ছে, নতুন করে আইএসকে মাঠে নামাতে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। এর মূল কারণ হচ্ছে, রাশিয়াকে ইউক্রেনের পাশাপাশি আরেকটি ময়দানে সম্পৃক্ত করতে চাচ্ছে তারা, যাতে দুই ময়দানে লড়তে গিয়ে সামরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে রাশিয়া।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দুধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির সদস্য রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের খেলাটি ধরতে পেরেছেন। এ কারেণে হামলার পরের দিনই তিনি বলেছেন, এই হামলার সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। হামলাকারীরা হামলার পরপর ইউক্রেনের দিকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। পুতিন একবারও তার মুখে আইএস-খোরাসানের নাম নেননি। 

মধ্যপ্রাচ্যে আইএসকে নামিয়ে স্বার্থ হাসিল করতে পারলেও এবার রাশিয়ায় বোধ হয় সুবিধা করতে পারবে না যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের মাথায় কত ধরনের দুর্বুদ্ধি থাকতে পারে তার হিসাব-নিকাশ কিছুটা হলেও জানেন পুতিন।