আন্তর্জাতিক

বিশ্বে শিক্ষার মানে ব্যবধান বাড়াচ্ছে তাপপ্রবাহ

চলতি সপ্তাহে রাজধানীতে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাওয়ায় ঢাকার একটি স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী হেনা খানকে তার পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

বার্তা সংস্থা এএফপিকে হেনা বলেন, ‘এই যন্ত্রণাদায়ক গরমে স্কুলে ঠিকমতো পড়াশোনা হচ্ছে না। শিক্ষকরা পড়াতে পারেন না, শিক্ষার্থীরা মনোযোগ দিতে পারে না। বরং আমাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে।’

হেনা খানা এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার চার কোটি শিক্ষার্থীদের এক জন যারা তাপপ্রবাহের কারণে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে শ্রেণিকক্ষের বাইরে ছিলেন। কারণ তাপপ্রবাহ এই অঞ্চলের কয়েকটি দেশে স্কুল বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ।

জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর কারণে জলবায়ু উষ্ণ হওয়ার সাথে সাথে তাপপ্রবাহ দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে তা উচ্চতার শিখরে পৌঁছায়। তাপপ্রবাহ চলাকালে বিশ্বজুড়ে সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা শিক্ষার্থীদের গরম ক্লাসরুমে পড়াশুনা করা বা তাদের বাড়িতে থাকতে উৎসাহিত করা নিয়ে লড়াই করছেন।

জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে বিশ্বের প্রায় ১৭ শতাংশ স্কুল বয়সী শিশু ইতিমধ্যেই স্কুলের বাইরে রয়েছে,।তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনুপাতটি অনেক বেশি। সাব-সাহারান আফ্রিকার প্রায় এক তৃতীয়াংশ শিশু যেখানে স্কুলের বাইরে সেখানে উত্তর আমেরিকায় এই হার মাত্র ৩ শতাংশ। উন্নয়নশীল বিশ্বে শিশুদের পরীক্ষার ফলাফলও উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে।

বিশেষজ্ঞরা রয়টার্সকে বলেছেন, তাপপ্রবাহ শিশুদের পড়াশোনার মানকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় উন্নয়নশীল দেশ এবং উন্নত দেশগুলোর মধ্যে শেখার ব্যবধান দীর্ঘ করতে পারে। এমনকি ধনী দেশগুলোর ধনী ও দরিদ্র জেলার মধ্যেও এই ব্যবধান দীর্ঘ হতে পারে। কিন্তু শিশুদের অতিরিক্ত গরমে স্কুলে পাঠানো তাদের অসুস্থ করে তুলতে পারে।

দক্ষিণ সুদানে মার্চের শেষের দিকে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বেড়ে যাওয়ার সময় প্রায় ২২ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য তাদের স্কুলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফিলিপাইন ও ভারতের হাজার হাজার স্কুল এপ্রিলের শেষের দিকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

বাংলাদেশ প্রায় তিন কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য স্কুল খোলা এবং বন্ধ রাখার মধ্যে দোদুল্যমান রয়েছে। তাপমাত্রা বিপজ্জনক স্তরে উঠলেও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করার চাপের মধ্যে রয়েছে স্কুলগুলো।

অলাভজনক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন-এর বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সুমন সেনগুপ্ত বলেছেন, দেশের অনেক স্কুলে ‘পাখা নেই, বায়ুচলাচল ব্যবস্থা ভাল নয় এবং এগুলোর টিনের ছাদ থাকতে পারে যা ভাল নিরোধক নয়।’

গত সপ্তাহে তাপপ্রবাহের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুলগুলো খোলার একদিন পর সোমবার তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে গিয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ আবারও প্রায় অর্ধেক জেলার সব প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে।

শিক্ষার্থীরা তাপপ্রবাহের সময় ক্লাসে যোগ দিলেও তাদের শিক্ষার ক্ষতি হতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রা মস্তিষ্কের জ্ঞানীয় ক্রিয়াকলাপকে ধীর করে দেয়, শিক্ষার্থীদের তথ্য ধরে রাখার এবং প্রক্রিয়া করার ক্ষমতাকে হ্রাস করে।

২০২০ সালের মে মাসের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি পরীক্ষার আগে উচ্চ তাপমাত্রার সংস্পর্শে আসে তবে তারা প্রমিত পরীক্ষায় আরও খারাপ ফল করেছে।

আমেরিকান ইকোনমিক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, শূন্য দশমিক ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতর শিক্ষাবর্ষ ওই বছরের শিক্ষাকে ১ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদনের সহ-লেখক বোস্টন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ জশ গুডম্যান জানান, যেসব স্কুলে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল সেগুলোতে তাপপ্রবাহের বেশিরভাগ নেতিবাচক প্রভাব অদৃশ্য হয়ে গেছে।

বিভিন্ন সমীক্ষা অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ স্কুলে অন্তত আংশিক শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আছে বলে মনে করা হয়।

নিম্ন আয়ের জেলাগুলোর স্কুল একাডেমিকভাবে তাদের ধনী জেলাগুলোর স্কুল থেকে পিছিয়ে রয়েছে। ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের ২০১৯ সালের সমীক্ষা অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বনিম্ন আয়ের শিক্ষার্থীদের গড় ফলাফল সর্বোচ্চ আয়ের ছাত্রদের থেকে প্রায় চার বছর পিছিয়ে।

গুডম্যান বলেন, ‘যখন এই জায়গাগুলোতে (শিক্ষার্থীরা) এক বছর বেশি তাপ অনুভব করে, তখন মনে হয় তারা কম শিখেছে।...জলবায়ু পরিবর্তন গরম ও শীতল দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষার ব্যবধানকে প্রশস্ত করবে।’

কিছু গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে অতিরিক্ত তাপ জন্মের আগেও শিশুর শিক্ষাকে প্রভাবিত করতে পারে। অর্থাৎ অনাগত শিশুর মস্তিস্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।