আন্তর্জাতিক

মিয়ানমারের যেসব ভিক্ষুর রয়েছে মার্সিডিজের গাড়িবহর

মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুন বা মান্দালে শহরে ঘুরতে গেলে যেকোনো সময় চোখে পড়তে পারে হাল মডেলের বিলাসবহুল মার্সিডিজ বা বেন্টলির গাড়িতে একজন প্রবীণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী যাতায়াত করছেন। বৌদ্ধ ভিক্ষু, তাও আবার ব্যক্তিগত বিলাসবহুল গাড়ি! কিন্তু অবাক হবেন না। এটা সামরিক অভ্যুত্থান পরবর্তী মিয়ানমার। সামরিক শাসনকে সমর্থনকারী এসব ভিক্ষুর রাজনৈতিক প্রভাবের সাথে সাথে তাদের নগদ প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ জেনারেলরা বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি তাদের সাহায্যকারী ভিক্ষুদের মূল্যবান পুরষ্কার প্রদান করছে।

সারাদেশে সামরিক শাসনের সহিংসতা ও নৃশংসতার বিষয়ে নীরব থাকার পাশাপাশি অভ্যুত্থানকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিচ্ছেন সন্যাসীরা। মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ এখন এই সন্যাসীদের সুবিধাবাদী দালাল হিসাবে আখ্যা দিচ্ছে। দেশের নিপীড়িত জনগণ, কর্মী এবং বিরোধী রাজনীতিকরা তাদের তালিকা করছেন। 

মিয়ানমারের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা একসময় তাদের রাজনৈতিক সক্রিয়তার জন্য পরিচিত ছিলেন। প্রথমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানানো এবং পরে বর্তমান সামরিক জান্তার পূর্ববর্তী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ছিলেন তারা। তবে, প্রায় এক দশক ধরে অনেক সন্ন্যাসী, বিশেষ করে প্রবীণ ও প্রভাবশালীরা তাদের রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। তারা এখন হিসাববিহীন সম্পদের মালিক এবং বিকাশমান ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। এটাকে অনেকটা বিয়ের মতো বলা যায়। সামরিক নেতারা ভিক্ষুদের সম্পদ ও সুরক্ষা দিয়ে সহযোগিতা করছেন। এর বিনিময়ে ভিক্ষুরা সামরিক বাহিনীকে সমর্থন ও বৈধতা দেওয়ার পাশাপাশি তাদেরকে বৌদ্ধধর্মের রক্ষাকারী হিসাবে উপস্থাপন করছেন।

২০২১ সালে অভ্যুত্থান করার আগে মিয়ানমারের রক্ষণশীল এবং অতি-জাতীয়তাবাদী সন্ন্যাসীদের অত্যন্ত সোচ্চার দলটি সামরিক বাহিনীকে সম্পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল। আরও কার্যকরভাবে ধর্মকে ব্যবহার করার জন্য সামরিক বাহিনী বহু বছর ধরে অতিজাতিয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোর সাথে শক্তিশালী সংযোগ গড়ে তুলেছিল। এই জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীটি মা বা থা নামে পরিচিত। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনটির বিরুদ্ধে মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানো এবং ধর্মীয় সহিংসতার ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। প্রেসিডেন্ট থেন সেইনের ২০১১-২০১৬ মেয়াদের সময় সামরিক ও বেসামরিক নেতারা দান, সুরক্ষা এবং রাজনৈতিক সমর্থনের মাধ্যমে মা বা থাকে সমর্থন করেছিলেন। ২০২১ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর এই গোষ্ঠীটির মাধ্যমে ধর্মের ট্রাম কার্ডটি খেলে দেয়। সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর থেকে হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নারীদের ধর্ষণ করছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে।

অভ্যুত্থানের পর থেকে জান্তাপ্রিয় হয়ে উঠেছেন বিশিষ্ট ভিক্ষু সিতাগু সায়াদাউ আশিন নানিসারা এবং ধম্মদুতা আশিন চেকিন্দা। এরা দুজনই জান্তা প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের কট্টর সমর্থক। এদের মধ্যে সিতাগু জেনারেল মিনকে রাজা বলেও আখ্যায়িত করেছেন। মিন অং হ্লাইং-এর আরেক কট্টর  সমর্থক হলেন পূর্ব শান রাজ্যের ইউ কোভিদা, যিনি ভাসিপাকে সায়াদাও নামে পরিচিত। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের মাথায় গুলি করতে নিরাপত্তা বাহিনীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। জান্তাকে নগ্নভাবে সমর্থন দেওয়ার বিনিময়ে এই ভিক্ষুরা পেয়েছেন বড় অংকের দান, বিলাসবহুল গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ এবং সরকারি বড় খেতাব। এদের মার্সিডিজ, লিঙ্কনস এবং বেন্টলির মতো  বিলাসবহুল গাড়ির বহর রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের হাতেই শোভা পায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দামি স্মার্টফোন।

সম্পর্ক গাঢ় করতে জেনারেল মিন অং এবং সেনাবাহিনীর শীর্ষ জেনারেলরা এসব ভিক্ষুদের তাদের বিলাসবহুল বাড়িতে ডেকে পাঠান। আবার ধর্মীয় উৎসবগুলোতে ছুটে যান এই ভিক্ষুদের আশ্রমে। সেনাবাহিনীকে নগ্ন সমর্থন জানানোর মাধ্যমে স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝখানে অবস্থান নেওয়া এই ভিক্ষুরা এখন পরোক্ষাভাবে মিয়ানমারের লাখ লাখ বেসামরিক নাগরিককে হত্যা ও ধর্ষণ করে যাচ্ছেন।

সূত্র: ইরাবতি ডটকম