ইউকি ওয়াতানাবে প্রতিদিন ১২ঘন্টা অফিস করতেন। তবে এটাকে একটি ছোট দিন হিসাবে বিবেচিত হয়। জাপানে সর্বনিম্ন সাধারণ কর্মঘন্টা সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।
জাপানের বৃহত্তম টেলিকম এবং ই-পেমেন্ট কোম্পানিগুলির জন্য কাজ করেন ওয়াতানাবে।
২৪ বছর বয়সী এই তরুণী বলেন, ‘সর্বশেষ আমি (অফিস) ত্যাগ করব রাত ১১টায়।’
সময়মতো কর্মস্থল ছাড়ার কথা বলা কিংবা কিছু সময় ছুটি নেওয়া জাপানের প্রতিষ্ঠানগুলোতে যথেষ্ট জটিল। তবে এরচেয়ে জটিল হচ্ছে পদত্যাগের প্রস্তাব দেওয়া। কারণ বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিতে কর্মীদের এই প্রস্তাবকে অসম্মানের চূড়ান্ত রূপ হিসাবে দেখা হয়। শ্রমিকরা ঐতিহ্যগতভাবেই কয়েক দশক ধরে একজন নিয়োগকর্তার প্রতিষ্ঠানে থাকে, তবে সেটা আজীবনের জন্য নয়।
পদত্যাগ পত্র জমা দিলে সবচেয়ে চরম ক্ষেত্রে ক্ষুব্ধ শীর্ষ কর্মকর্তা সেটি ছিঁড়ে ফেলেন এবং কর্মচারীদেরকে থাকতে বাধ্য করার জন্য হয়রানি করেন।
ওয়াতানাবে তার আগের চাকরিতে অসন্তুষ্ট ছিলেন। কারণ তার প্রাক্তন সুপারভাইজার প্রায়ই তাকে উপেক্ষা করতেন। কিন্তু তিনি পদত্যাগ করার সাহস পাননি।
সিএনএনকে ওয়াতানাবে বলেন, ‘আমি চাইনি যে আমার প্রাক্তন নিয়োগকর্তা আমার পদত্যাগ প্রত্যাখ্যান করুক এবং আমাকে দীর্ঘকাল তার প্রতিষ্ঠানে রাখুক।’
কিন্তু তিনি এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য একটি উপায় খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি মোমুরির সাহায্য নেন। আর এই মোমুরি হচ্ছে একটি সংস্থা যেটি ভীতু কর্মীদের তাদের বসদের কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিতে এবং কর্মস্থল ছেড়ে যেতে সাহায্য করে।
চমৎকার একটি নৈশভোজের জন্য যে পয়সা গুনতে হয়, সেই খরচের বিনিময়ে অনেক জাপানি কর্মী এই প্রক্সি ফার্মগুলোকে চাপমুক্তভাবে পদত্যাগ করতে সহায়তা করার জন্য ভাড়া করে।
কোভিডের আগে এই শিল্পের অস্তিত্ব ছিল। তবে মহামারির পরে এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। সারাদেশে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কত, তার সরকারি পরিসংখ্যান নেই। তবে দিন দিন এসব প্রতিষ্ঠানের চাহিদা বাড়ছে।
মোমুরির অপারেশন ম্যানেজার শিওরি কাওয়ামাতা জানান, শুধুমাত্র গত বছরেই তারা ১১ হাজার ক্লায়েন্টের কাছ থেকে অনুসন্ধান পেয়েছে।
টোকিওর ব্যস্ততম ব্যবসায়িক জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম মিনাটোতে ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটি চালু হয়। ‘মোমুরি’ এর অর্থ জাপানি ভাষায় ‘আমি আর এটি করতে পারব না।’
যারা পূর্ণ চাকরি করেন তাদের পরামর্শ ফি বা সহায়তা ফি হচ্ছে ২২ হাজার ইয়েন (প্রায় ১৫০ মার্কিন ডলার), যারা যারা খণ্ডকালীন চাকরি করেন তাদের জন্য ১২ হাজার ইয়ে। প্রতিষ্ঠানটি কর্মচারীদের তাদের পদত্যাগ, তাদের কোম্পানির সাথে আলোচনা করতে এবং আইনি বিরোধ দেখা দিলে আইনজীবীদের পরামর্শ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়।
শিওরি কাওয়ামাতা বলেন, ‘কিছু লোক তাদের পদত্যাগপত্র তিনবার ছিঁড়ে ফেলার পরে কিংবা নিয়োগকর্তাদের কাছে মাটিতে নতজানু হওয়ার পরেও পদত্যাগ করতে না দিলে এরপর আমাদের কাছে আসেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মাঝে মাঝে এমন লোকদের ফোন পাই, যারা কান্নাকাটি করে, আমাদের কাছে জানতে চায় তারা অমুক তমুকের ওপর ভিত্তি করে তাদের চাকরি ছেড়ে দিতে পারে কিনা। আমরা তাদের বলিম এটা ঠিক আছে এবং তাদের চাকরি ছাড়া শ্রম অধিকারের মধ্যে পড়ে।’
কিছু কর্মী অভিযোগ করেন, কর্তারা পদত্যাগ করার চেষ্টা করলে তাদের হয়রানি করেন। এসব হয়রানির মধ্যে রয়েছে কর্মীর অ্যাপার্টমেন্টে বারবার ডোরবেল বাজানো।
জাপানে দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার সংস্কৃতি রয়েছে। বিভিন্ন খাতের কর্মচারীরা শাস্তিমূলক কর্মঘণ্টা, সুপারভাইজারদের উচ্চ চাপ এবং বৈষম্যের অভিযোগ করেছে। জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসিক চাপ এতোটাই মারাত্মক যে বিষয়টি প্রকাশ করার জন্য ‘কারোশি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, যার অর্থ ‘অতিরিক্ত কাজে মৃত্যু।’ এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকর্তারা ব্যাপকভাবে ‘কালো তালিকার সংস্থা’ হিসাবে পরিচিত।
টোকিওর হিটোতসুবাশি ইউনিভার্সিটি বিজনেস স্কুলের মানবসম্পদ অধ্যাপক হিরোশি ওনো বলেছেন, পরিস্থিতি এতটাই চাপা হয়ে উঠেছে যে সরকার তাদের নিয়োগের ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য অনৈতিক নিয়োগকর্তাদের একটি তালিকা প্রকাশ করতে শুরু করেছে এবং এদের প্রতিষ্ঠানে কাজ করার বিপদ সম্পর্কে চাকরিপ্রার্থীদের সতর্ক করেছে।
২০১৭ সালে তালিকা প্রকাশের পর থেকে ৩৭০টিরও বেশি কোম্পানিকে সারা দেশে শ্রম ব্যুরো কালো তালিকাভুক্ত করেছে।
জাপানের স্বাস্থ্য, শ্রম ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৫৪ জন লোক অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার কারণে মস্তিষ্ক ও হার্টের রোগে মারা গেছে। দুই দশক আগে এই সংখ্যা ছিল ১৬০।
জাতীয় সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকে-এর একজন ৩১ বছর বয়সী রাজনৈতিক প্রতিবেদক ২০১৭ সালে কর্মস্থলে দীর্ঘ সময় কাটানোর কারণে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। তিনি তার মৃত্যুর আগে মাসে ১৫৯ ঘন্টা অতিরিক্ত সময় কাজ করেছিলেন।