আন্তর্জাতিক

মোদির দিল্লিতে যেভাবে মুসলমানরা নিরাপত্তার খোঁজে ছুটছে

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে নাসরিন ও তার স্বামী তৌফিক উত্তর-পূর্ব দিল্লির শিব বিহারে বসবাস করছিলেন। ওই মাসে তাদের মতো মুসলমানদের লক্ষ্য করে দাঙ্গা শুরু হয়। তৌফিক যে ভবনে থাকতেন তার দ্বিতীয় তলা থেকে দাঙ্গাবাজ হিন্দুরা তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এ ঘটনায় তৌফিক গুরুতর আহত হন। প্রায় তিন বছর লাগে তার সুস্থ হতে।

দাঙ্গার পরপরই তৌফিক-নাসরিক দম্পতি দিল্লির দরিদ্র এলাকা লোনিতে চলে যান। এই এলাকায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।

রয়টার্সকে তৌফিক বলেন, ‘আমি ওই এলাকায় আর ফিরে যাব না। আমি মুসলমানদের মধ্যে নিরাপদ বোধ করি।’

রয়টার্স প্রায় দুই ডজন লোকের সাক্ষাৎকার নিয়েছে, যারা ভারতের রাজধানীতে মুসলমানরা রাজধানীর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর কাছ থেকে দূরের এলাকায় জড়ো হচ্ছে তার বর্ণনা দিয়েছেন। ২০২০ সালের মারাত্মক দাঙ্গা এবং মুসলিমবিদ্বেষী বক্তৃতা বৃদ্ধির পরে নিরাপত্তার খোঁজে ছুটে যাওয়া এই মানুষগুলোর সংখ্যা বেড়েছে। দিল্লির মুসলমানদের এভাবে স্থান পরিবর্তনের বিষয়টি এর আগে সংবাদমাধ্যমে তুলে আনা হয়নি।

ভারতে হিন্দু এলাকাগুলো থেকে মুসলমানদের সরে যাওয়ার কোনো সরকারি তথ্য নেই। দেশটিতে দীর্ঘ বিলম্বিত আদমশুমারির অর্থ হচ্ছে, বিগত এক দশকে মুসলিম ছিটমহল কতটা বেড়েছে তার নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। ভারতের ১৪০ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ মুসলমান।

দিল্লির গ্রাউন্ড জিরো হচ্ছে জামিয়া নগরের কেন্দ্রীয় পাড়া। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে  দীর্ঘদিন ধরে এলাকাটি মুসলমানদের জন্য একটি অস্থায়ী অভয়ারণ্য ছিল।

রাজনীতিবিদ,অধিকারকর্মী, ইমাম এবং পাঁচজন আবাসন ব্যবসার এজেন্ট সহ ১০ জন স্থানীয় নেতার মতে, নির্মাণের গতি বৃদ্ধি সত্ত্বেও আরো বেশি মুসলমান এই এলাকায় ভিড় করছে।  

জামিয়া নগরের মতো মুসলিম সংখ্যাগুরু এলাকায় অনেক বেশি মুসলমান বাড়ির জন্য ছুটে আসছে উল্লেখ করে দক্ষিণ দিল্লির রিয়েল এস্টেট এজেন্ট রাইস খান বলেন, ‘একজন মুসলমান যতই সাহসী হোক না কেন, তারা মনে করে যে তাদের সরে যেতে হবে। কারণ যদি একদল লোক আসলে তাদের বিপরীতে আপনি সত্যিই কতটা সাহসী হতে পারেন?’

ভারতের মুসলিম জনসংখ্যার উপর মাঠপর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদী কর্মকাণ্ডের তত্ত্বাবধানকারী এবং লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞানী রাফেল সুসেউইন্ড বলেন, ভারতে গত দশকে জাতীয়ভাবে বিচ্ছিন্নতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অধীনে ক্রমবর্ধমান ইসলামফোবিয়া এই বিচ্ছিন্নতা প্রবণতার ‘মূল চালক।’

জামিয়া নগরের ইমাম মো. সাহিল জানান, তার মসজিদের ভোরের নামাজে উপস্থিতির সংখ্যা গত চার থেকে পাঁচ বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে এবং এটি সেখানে জনসংখ্যার সামগ্রিক বৃদ্ধিকে প্রতিফলিত করে।

জামিয়া নগরের কংগ্রেস পার্টির কর্মী সৈয়দ সাঈদ হাসান জানান,, দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতার একটি বড় কারণ ছিল ২০২০ সালের দাঙ্গা। মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার নাগিরকত্ব আইন প্রবর্তন করার পর বিক্ষোভে দুই শতাধিক আহত এবং কমপক্ষে ৫৩ জন নিহত হয়। এদের বেশিরভাগই মুসলিম।

ভারতে অপরাধের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণকারী সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার রেকর্ড রাখে না। তবে তাদের দাবি, কংগ্রেস শাসনামলের তুলনায় ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বার্ষিক দাঙ্গার হার ৯ শতাংশ কমেছে।

কিন্তু স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ অর্গানাইজড হেট মুসলিমবিরোধী বিদ্বেষমূলক বক্তব্য উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধির তথ্য রেকর্ড করেছে। সংস্থাটির হিসাবে, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে যেখানে এ ধরনের ঘটনা ছিল ২৫৫টি, সেখানে ওই বছরের দ্বিতীয়ার্ধে তা বেড়ে হয়েছে ৪১৩টি। বিজেপির রাজনীতিবিদ এবং সহযোগী গোষ্ঠীগুলো এই প্রবণতার মূলে ছিল।