আন্তর্জাতিক

রাজধানী নিয়ন্ত্রণে কর্তৃত্ববাদীদের কায়দা ও প্রতিরোধ

দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদ বা একনায়কত্বের উত্থান যেমন হচ্ছে, তেমনি তা ধসিয়ে দিতে নাগরিকরা প্রয়োজনে রাস্তায় নেমে আসছে; উভয় পক্ষের জন্য রাজধানী দখলের লড়াই হয়ে দাঁড়াচ্ছে শেষ বিন্দু। ডেভিড জ্যাকম্যান ও টম গুডফেলো কর্তৃত্ববাদ কায়েম করা ও তা ভেঙে দেওয়ার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে রাজধানী কীভাবে পরস্পরের পক্ষে-বিপক্ষে কাজ করে, তা নিয়ে ‘অটোক্র্যাটস অ্যান্ড সিটিজ: হাউ ক্যাপিটালস বিকাম অ্যা ব্যাটলগ্রাউন্ড ফর প্রোটেস্ট অ্যান্ড কন্ট্রোল’ শিরোনামের লেখায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। লেখাটি ‘রাজধানী নিয়ন্ত্রণে কর্তৃত্ববাদীদের কায়দা ও প্রতিরোধ’ শিরোনামে অনুবাদ করেছেন নাজমুল হোসেন।

গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান বিশ্বের দীর্ঘতম শাসনকারী নারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই দিন রাজধানী ঢাকায় লাখো মানুষ জড়ো হয়। জনতা একপর্যায়ে শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবনে ঢুকে পড়ে, ভাঙচুর চালায়। ঢুকে পড়ে সংসদেও। পুড়িয়ে দেয় তার বাবার স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বাড়ি। 

একটানা সাড়ে ১৫ বছর বাংলাদেশ শাসন করেছেন শেখ হাসিনা। এই সময়ে তিনি ‘স্বৈরাচার’ হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ। বিরোধীদের দমনে কঠোরতার চরম রূপও দেখিয়েছেন তিনি, এমনটিই বলছে সরকারের বাইরে থাকা প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ।

বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদের নবরূপ সংস্করণের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের এই গণঅভ্যুত্থান অনেকের জন্যই আশাব্যঞ্জক, যা কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে তরুণ সমাজের ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করার প্রতীকও বটে। তবে এ আন্দোলনের অন্যতম আকর্ষণীয় দিকটি হল, রাজধানী কীভাবে রাজনীতির কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে এবং সবকিছুকে তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। 

সম্প্রতি লেখা ‘কন্ট্রোলিং দ্য ক্যাপিটাল: পলিটিকাল ডমিন্যান্স ইন দ্য আরবানাইজিং ওয়ার্ল্ড’ বইয়ে বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দিয়েছেন- রাজধানী শহরকে কেন্দ্র করে কীভাবে রাজনীতি ঘুরপাক খায়। শাসক ও অভিজাতরা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে রাজধানীতে কীভাবে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে; সেটিকে নানাভাবে পেলে-পুষে রাখে। 

বইটিতে বিশ্বের দুটি দ্রুত নগরায়ন অঞ্চল সাব সাহারান আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির নানা বাঁক নিয়ে নজর দেওয়া হয়েছে। 

বাংলাদেশ, ইথিওপিয়া, শ্রীলঙ্কা, উগান্ডা, জাম্বিয়া ও জিম্বাবুয়েতে রাজধানী শহরে প্রভাব রাখতে ও আধিপত্য বিস্তারে শাসকগোষ্ঠীর কৌশলগুলোর খোঁজ করেন লেখকরা।

শহুরে নাগরিকরা কীভাবে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জুড়ে যায়, তাও খুঁজেছেন তারা। একইসঙ্গে এই শহুরে নাগরিকরা পরস্পরের সঙ্গে মিলে কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী করতে ও সমর্থন দিতে কীভাবে ভূমিকা রাখে, সেই তত্ত্বও খোঁজেন তারা।

এতে দুটি বিষয় বিশেষভাবে উঠে এসেছে। প্রথমত. বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনে বাস করা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ১০ বছর আগে যেখানে বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠী কর্তৃত্ববাদী শাসনে বাস করত, তা এখন বেড়ে ৭১ শতাংশ।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো নগরায়ন। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই এখন শহুরে এলাকাগুলোতে বসবাস করছে।

শহরে অস্থিরতা গত এক বছরে আমরা দেখলাম, রাজধানী ক্রমেই হয়ে উঠছে লড়াইয়ের ময়দান। কিছু গণতান্ত্রিক আন্দোলন সেখানে দানা বাঁধছে। 

২০২৪ সালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে বাঁক বদল ঘটল, সেখানে তাদের লড়াইয়ের কৌশল ছিল অভিনব। আর এই পুরো আন্দোলনেই বড় গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল রাজধানী শহর। ঢাকার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আন্দোলনের সূতিকাগার। 

একইভাবে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর নাগরিকরা জেগে উঠে যে প্রতিবাদ সংগঠিত করে, তার ফলাফল ছিল ক্ষমতাধর রাজাপাকসে পরিবারের দেশত্যাগ করা। অথচ এর আগে শহুরে নাগরিকরা বেশ কিছু প্রতিবাদ সংগঠিত করলেও তা রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকা শাসকগোষ্ঠীকে নাড়া দিতে পারেনি।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন রাজধানীতে দানা বাঁধলে সেগুলোর ব্যর্থ হওয়ার ঘটনা বিরল। 

২০২১ সালের নির্বাচনের আগে উগান্ডার কাম্পালায় মানুষ সড়কে নেমে এসেছিল। সেই বিদ্রোহ দমন করতে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। প্রতিবেশী কেনিয়ার প্রতিবাদ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০২৪ সালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একইভাবে আরেকবার সড়কে নেমে এসেছিল উগান্ডার নাগরিকরা।

২০২৪ সালের জুন মাসে কর বৃদ্ধির প্রতিবাদ থেকে নাইরোবিতে যে আন্দোলন সংগঠিত হয়, তা এক পর্যায়ে সেটি নাড়িয়ে দেয় রাজধানীকেও। পুলিশের সঙ্গে নৃশংস লড়াইয়ে জড়ায় প্রতিবাদকারীরা। 

একইভাবে নাইজেরিয়ায় পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে ২০২০ সালে বিক্ষোভে নামে দেশটির নাগরিকরা। সেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে আবুজা ও লাগোসের মতো শহরে। সেটি রীতিমতো গলদঘর্ম করে তোলে সরকারকে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই যুগে মানুষের মধ্যে দূরত্ব একটি ‘মেসেজ’ এর; অর্থাৎ একটি মেসেজেই যোগাযোগ করে ফেলা যায়। ইথিওপিয়ায় এই সহজ যোগাযোগের মাধ্যমেই তরুণরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদে নামেন। 

দেখা যাচ্ছে, শহরের বাসিন্দারা প্রতিবাদে নামলেই পরিস্থিতি ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। আর এই বিষয়টি অনুধাবন করে কর্তৃত্ববাদীরাও এটিকে ঠেকানোর নানা কৌশল রাখেন। পুলিশি বর্বরতাসহ নানা কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে সরকার প্রতিবাদ দমনে প্রচেষ্টা চালায়।

কর্তৃত্ববাদীদের কৌশল 

‘কন্ট্রোলিং দ্য ক্যাপিটাল: পলিটিকাল ডমিন্যান্স ইন দ্য আরবানাইজিং ওয়ার্ল্ড’ বইয়ে উঠে এসেছে কর্তৃত্ববাদীরা শহুরে বাসিন্দাদের শক্তি সম্পর্কে বেশ সচেতন। তারা রাজধানীতে আধিপত্য বজায় রাখতে বিভিন্ন ধরনের কৌশল অনুসরণ করেন। 

এসব কৌশলের মধ্যে দুটি বর্ণনা করা যাক। প্রথমত, শহরে নিজের পক্ষে রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা এবং লোকজনকে অবকাঠামোগত সুবিধা দেওয়া। 

আদ্দিস আবাবার ক্ষেত্রে যেমনটি দেখা যায়, ইথিওপিয়ার শাসক গোষ্ঠী নিজেদের অনুসারী গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে শাসন বজায় রাখত। 

দ্বিতীয়টি হলো, বিরোধী দলকে দমন করা। কোথাও নির্যাতন, নিপীড়নের মধ্য দিয়ে, আবার কোথাও নজরদারি, ভয়-ভীতি দেখাত শাসকগোষ্ঠী। 

আবার কোথাও কোথাও শাসকগোষ্ঠী নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন রেখা এঁকে দেয়। শ্রীলঙ্কায় যেমন, শহর গড়ে তোলা হয়েছিল ছবির মতো। মধ্যবিত্ত শহরবাসী তাতে উৎফুল্ল ছিল। কিন্তু শহরের বাইরের নাগরিকদের জীবন ছিল দুর্বিষহ। 

যাই হোক, সব মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে শহুরে নাগরিকরা এক দিকে যেমন খুব শান্ত, অন্যদিকে তাদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ শাসকের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে। নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক বিস্ফোরণের গতিও সমানতালে বাড়ছে। 

স্বৈরাচার শাসকের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাই শহুরে বাসিন্দাদের আকর্ষণ করতে হয়। তারা পাশে দাঁড়ালে শাসকের বিদায় হয়ে যায় শুধুই সময়ের ব্যাপার। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের ‘স্বৈরাচার সরকার’ শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে সেটি যেন আরও একবার প্রমাণিত হলো।

নোট: ৯০ হাজার লেখক ও গবেষকের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘কনভারসেশন’, যেখানে বিশ্লেষণ ও নিবন্ধ প্রকাশ হয়। সম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বে কর্তৃত্ববাদ ও একনায়কদের রাজনীতির কেন্দ্র হিসেবে রাজধানীকে নিয়ন্ত্রণের কৌশল নিয়ে এই প্ল্যাটফর্মে ২৯ অক্টোবর নিবন্ধ লিখেছেন দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

লেখক পরিচিতি: ডেভিড জ্যাকম্যান অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির উন্নয়ন অধ্যয়নের এবং টম গুডফেলো শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির আরবান স্টাডিজ অ্যান্ড প্ল্যানিংয়ের শিক্ষক।