আন্তর্জাতিক

ট্রাম্পকেই শেষ পর্যন্ত কেন বেছে নিলেন মার্কিনিরা

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হয়েছেন- এ খবর এখন বাসি হয়ে গেছে। কিন্তু সব জরিপ, পূর্বাভাস উড়িয়ে দিয়ে নাটকীয়ভাবে বিপুল ভোটের ব্যবধানে তিনি কিভাবে জয় পেলেন সেটাই এখন প্রশ্ন। 

ট্রাম্পের এই জয়ের পেছনে কারণ বিশ্লেষণ করলে সবার আগে যে বিষয়টি উঠে আসবে সেটি হচ্ছে ডেমোক্রেট শিবিরের ব্যর্থতা। এই তালিকার শীর্ষে থাকবে কমলা হ্যারিসকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়নের ক্ষেত্রে গত চার বছর কোনো চিন্তাভাবনাই করেনি ডেমোক্রেটিক পার্টি। জুনে ট্রাম্পের সঙ্গে বিতর্কে পরাজয়ের পর বাইডেনের ওপর হতাশা তৈরি হয় ডেমোক্রেট শিবিরে। দলীয় চাপে শেষ পর্যন্ত বাইডেন সরে গিয়ে কমলার জন্য জায়গা ছেড়ে দেন। নির্বাচনের মাত্র তিন মাস আগে কমলাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এর ফলে নির্বাচনের জন্য আপামর মার্কিন জনগণের কাছে নিজেকে সেভাবে উপস্থাপনের সুযোগ কমই পেয়েছেন তিনি।

দীর্ঘদিন ধরেই বলা হচ্ছিল, বাইডেন সম্ভবত তার বয়স বা অন্য কিছুর কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের সাথে ক্রমবর্ধমানভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন। একই ভুল করেছেন বয়সে ছোট হ্যারিস। তিনি কেবল বছরের পর বছর ধরে দেশজুড়ে হতাশাকে উপেক্ষা করেছিলেন।

জ্বালানি, নিত্যপণ্য এবং ভাড়ার মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের ক্রমবর্ধমান খরচ জনগণের মনকে বিষিয়ে তুলেছিল। এর ফলে জনগণ তাদের কষ্ট বুঝতে পারবে এমন প্রার্থীর সন্ধান করছিলেন। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বাইডেনের ভূমিকাও সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিল। অনেকে বিশ্বাস করে, এই সংঘাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক চাপকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা এবং সরকারি ব্যয় নিয়ে জনগণ হতাশাকে আরো বেড়েছে।

এমনকি ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যেও বাইডেনের সমর্থন সর্বসম্মত ছিল না। অভিবাসন, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং ছাত্র ঋণ মাফের মতো নীতির বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপারে উদ্বেগ দলটিকে বিভক্ত করেছে। নির্বাচনী প্রচারের সময় হ্যারিস এই বিষয়গুলো স্বীকার করতে বা হতাশ ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ হন। এই অভিযোগগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধানের পরিবর্তে তিনি স্রেফ আলোচনা করে গেছেন। চাপের মুখে থাকা ইস্যুগুলোতে সংযোগ স্থাপনের এই অক্ষমতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন তুলেছেন- কমলা এমন সময়ের জন্য সঠিক প্রার্থী কিনা।

এরপর আসে ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যু। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের বিষয়ে হ্যারিসের অবস্থান, বিশেষ করে ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ এর প্রতি তার অটল সমর্থন তার রাজনৈতিক পতনে আরো একটু ভূমিকা রেখেছে। ফিলিস্তিনিপন্থী কর্মীদের দাবিকে উপেক্ষা দেশের প্রগতিশীলদের একটি মূল অংশকে হ্যারিসের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে হ্যারিস আবার মাঝে মাঝে দুই নৌকায় প দেওয়ার মতো আচরণ করেছেন। কখনো কখনো তিনি ইসরায়েলি সামরিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছেন। বিষয়টি তাকে ইসরায়েলপন্থী গোষ্ঠীদের কাছ থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে গেছে। তার ‘ঘরেও না বাইরেও না’ এই অবস্থান দুই পক্ষকেই দূরে ঠেলে দিয়েছে।

এবার আসি ট্রাম্পের সাফল্যের কারণ প্রসঙ্গে। এক কথায় বলতে গেলে কমলার যেখানে ব্যর্থতা ট্রাম্পের সেখানে সাফল্য। ডোনাল্ড ট্রাম্প অবৈধ অভিবাসী প্রবেশ ঠেকাতে ‘সীমান্ত বন্ধের’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই একটি ইস্যুতেই অনেক মার্কিনি ট্রাম্পকে সমর্থন করেন। কারণ বাইডেনের শাসনামলে সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টা রেকর্ড সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিল। অতিরিক্ত অভিবাসী প্রবেশের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সীমান্তবর্তী ছাড়া দূরের অঙ্গরাজ্যগুলোতেও। বিভিন্ন জনমত জরিপ জানিয়েছিল, অভিবাসন ও অভিবাসী সংকট সমাধানে কমলা হ্যারিসের চেয়ে ট্রাম্পের ওপরই আস্থা বেশির ভাগ আমেরিকানের। অভিবাসী ইস্যু ছাড়াও ট্রাম্প কর কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি আমদানির উপর ১০ শতাংশ শুল্ক কমানো এবং জ্বালানির মূল্য কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।  ট্রাম্প সার্বিক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে জীবনযাত্রাকে সাশ্রয়ী করার অঙ্গীকার করেছিলেন।

২০১৬ সালে প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ট্রাম্প একটি সূত্র নিয়ে কাজ করেছিলেন। ওই সময় তিনি নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন যে, তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি দেশের সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারেন।

২০২৩ সালে বিষয়টি স্বীকার করে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘২০১৬ সালে, আমি ঘোষণা করেছিলাম যে, আমি আপনাদের কণ্ঠস্বর। আজ আমি এর সঙ্গে যোগ করছি: আমি আপনাদের যোদ্ধা। আমি আপনাদের ন্যায়বিচার। যাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে এবং বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে, আমি তাদের জন্য প্রতিশোধ।’

২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইস্যুতে একের পর এক মামলা হতে শুরু করে। এমনকি বেশ কয়েকটি মামলায় তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন এবং জরিমানার দণ্ড পেয়েছেন। এরপরেও ট্রাম্প রিপাবলিকানদের মধ্যে নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার দলের একমাত্র যোগ্য প্রার্থী।

জুলাই মাসেই নিজেকে ‘মাচোম্যান’ হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ পেয়েছিলেন ট্রাম্প। ওই সময় একজন বন্দুকধারী পেনসিলভানিয়ার বাটলারে ট্রাম্পের সমাবেশে গুলি চালায়। একটি বুলেট ট্রাম্পের কানের পাশ দিয়ে চলে যায় এবং তার এক সমর্থক নিহত হয়। গুলিতে আহত ট্রাম্পে মুখ রক্তে ভেসে গিয়েছিল। ওই মুহূর্তে তিনি দাঁড়িয়ে বাতাসে তার মুষ্টি উঁচিয়ে চিৎকার করেছিলেন ‘যুদ্ধ! যুদ্ধ! যুদ্ধ!।’ কয়েক সপ্তাহ পরে তাকে দ্বিতীয় হত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। দুটি ঘটনাতেই ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়।

নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প সফল হয়েছেন। বিজয়ীর হাসি শেষ পর্যন্ত তিনিই হাসলেন। তবে মার্কিনিদের মুখে এই হাসি সংক্রমিত হয়ে আগামী চার বছর থাকবে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।