রাজনীতি-অর্থনীতির ঝড়-ঝাপটা উত্তরণের সুযোগ শুধু নয়; এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশের ডাকও উঠেছে শ্রীলঙ্কায়। আর সেই ‘ডাকের নেতা’ হিসেবে সামনে এসেছে একটি নাম- অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে।
দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের অবসান হলেও শ্রীলঙ্কায় জাতিগত বিভেদরেখা প্রচ্ছন্নে ‘ঘুন পোকা’র কুরে কুরে খাচ্ছিল দেশটির জাতীয় স্বত্তাকে। ‘বাহুবলী’ স্টাইলে রাজাপাকসদের শাসনে জাতিগত বিভাজন আরও গভীরে প্রবেশ করলেও সেই ‘অন্ধকার গর্ত’ থেকে ‘মুক্তির আকাশ’ পাওয়ার আশা জেগেছে সব জাতির মানুষের মধ্যে। বিশেষ দেশটিতে সংখ্যালঘু মুসলিম ও তালিমদের ‘মনের মানুষ’ হয়ে উঠেছেন বিস্ময় জাগানিয়া জয় নিয়ে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে বসতে যাওয়া অনূঢ়া।
বামপন্থি ঘরানার অনূঢ়া কুমার দিশানায়েকে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে লঙ্কানদের ‘ত্রাতা’ হিসেবে হাজির হয়েছেন, যার ইতিহাস নতুন করেই লিখতে হচ্ছে। তার নেতৃত্ব জয় করেছে রাষ্ট্র-সমাজে কোণঠাঁসা মুসলিম ও তামিলদের। মূলত তাদের ভোটেই দেশটির ইতিহাসে কোনো বামপন্থি নেতা হিসেবে প্রেসিডেন্ট হলেন অনূঢ়া।
দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় প্রথমবারের মতো আরও যা হলো, সেটি হচ্ছে- রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এলো বামপন্থিরা।
এই যে অনূঢ়া ও তার দলের ক্ষমতা কেন্দ্রে আসন পাওয়ার ঘটনা, তা মূলত অনিশ্চয়তায় ভোগা লঙ্কানদের মুক্তির রায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। দেশটির মানুষ থমকে পড়া অর্থনীতি আবার সচল করার প্রত্যাশা নিয়ে, পরিবর্তনের নেতা হিসেবে অনূড়াকে বেছে নিয়েছে।
নির্বাচনি প্রচারণায় অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে
২০২২ সালে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়ার পর এটি ছিল শ্রীলঙ্কা অনুষ্ঠিত প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তাতেই পুরোনোদের বিতাড়িত করে শাসন ক্ষমতায় পরিবর্তনের লক্ষ্যে রায় পেয়েছেন ৫৫ বছর বয় অনূঢ়া। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাজিথ প্রেমাদাসা ও বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের ব্যালটে ভোট পড়ার হারও সেই বার্তা স্পষ্ট করে দিয়েছে।
২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাত্র ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন অনূঢ়া কুমারা। ব্যবধান মাত্র পাঁচ বছরের। অথচ এই কয়েকটি বছরের ব্যবধানে আসা নির্বাচনের প্রথম দফায় তার ঝুলিতে জমা হয় ৪২ দশকি ৩১ শতাংশ ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেমাদাসা পান ৩২ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভোট। তাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, লঙ্কান ‘দিন বদলের ডাকে’ সাড়া দিয়েছে, মাত্র পাঁচ বছর আগেও যে দলটি বলতে গেলে ভাসমান ছিল; তারাই সোজা হেঁটে পৌঁছে যায় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের দুয়ারে।
আর সম্প্রতি দ্বিতীয় দফায় ভোটের পর অনূঢ়া পৌঁছে যান প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের অন্দরে, অর্জন করে মসনদে বসার জনরায়।
নির্বাচনে সংসদের ২২৫টি আসনের মধ্যে অনূঢ়া দিশানায়াকের ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) পার্টি ১৫৯টি আসনে জয় লাভ করেছে। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ও ক্ষমতাসীন প্রেমাদাসার দল পেয়েছে মাত্র ৪০টি আসন।
কলম্বো থেকে জয় পাওয়া ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার পার্টির নেতা সমনমলী গুণসিংহে বলেন, ‘আমরা খুশি, কারণ আমরা এখন জনগণের জন্য কাজ করতে পারব। জনগণ দেখিয়েছেন, তারা পরিবর্তন চান; তারা পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিয়েছেন।’
তামিলদের বড় সমর্থন পেয়েছেন অনূঢ়া কুমারা
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নেতা হিসেবে নিজেকে জনগণের সামনে আনেন অনূঢ়া দিশানায়েকে। এর ফলে একে একে শিক্ষার্থী, কর্মচারী, মুসলিম ও তামিলদের বড় অংশ তার সমর্থনে এগিয়ে আসেন; স্লোগান ধরেন তার জয়ের জন্য।
বিশ্লেষকদের মতে, অনূঢ়া দিশানায়েকে সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে এক ‘বৃহত্তর জোট’ গড়ে তুলতে পেরেছেন।
বিদ্রোহ থেকে জনপ্রিয়তা ১৯৬৮ সালের ২৪ নভেম্বর শ্রীলঙ্কার মধ্যাঞ্চলের গালেওয়েলা শহরে দিশানায়েকের জন্ম। সেখানে নানা সংস্কৃতি-ধর্মের মানুষের সঙ্গে মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠেন তিনি। লঙ্কার মাটি ও মানুষের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক।
সরকারি স্কুলে পড়া শেষে স্নাতক সম্পন্ন করেন পদার্থবিদ্যায়। ১৯৮৭ সালের দিকে ভারত-শ্রীলঙ্কা চুক্তি হয়। সে সময় ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি। ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯- এই দুই বছর মার্কসবাদী রাজনৈতিক দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহে অংশ নেয়। পরে এই দলের নেতা হন অনূঢ়া দিশানায়েকে।
এই দুই বছর মূলত গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত তরুণরা মার্কসবাদী দলের পতাকা তলে শামিল হয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও বেসামরিক মানুষদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ও জঙ্গি হামলা চালায়। সেই বিক্ষোভে প্রাণ হারান হাজারো মানুষ।
১৯৯৭ সালে জেভিপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হন দিশানায়েকে। ২০০৮ সালে দলের প্রধান হন তিনি। এরপর ওই দুই বছর আতঙ্ক সৃষ্টি ও সহিংসতার জন্য নিজ দলের ভূমিকায় ক্ষমা চেয়েছেন তিনি।
২০১৪ সালে বিবিসিকে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'ওই সংঘাতের সময় এমন অনেক কিছুই হয়েছে, যা অনুচিত। আমরা খুবই অনুতপ্ত। আমাদের হাত ধরে যেসব কাজ হয়েছে, তা একদমই ঠিক হয়নি। আমরা সবসময় সেসব ঘটনার ভয়াবহতায় দুঃখিত ও হতবাক হই।'
প্রথম কোনো বামপন্থি নেতা হিসেবে প্রেসিডেন্ট হলেন অনূঢ়া
২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল রাজধানী কলম্বোর বেশ কয়েকটি গির্জা ও আন্তর্জাতিকমানের হোটেলে ধারাবাহিক বোমা হামলার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র দিন ইস্টার সানডের ওই ভয়াবহ ঘটনায় অন্তত ২৯০ জন নিহত ও হাজারো মানুষ আহত হন।
পাঁচ বছর পরও ওই ঘটনার নেপথ্যে কে বা কারা ছিল, সরকারি তদন্তে তা উদ্ঘাটিত হয়নি। সম্প্রতি দিশানায়েকে বিবিসিকে বলেন, তিনি নির্বাচিত হলে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে তদন্ত করবেন।
পরিবর্তনের জন্য ভোট গত বৃহস্পতিবার কলোম্বর মারাদানার একটি ভোটকেন্দ্র থেকে বের হন অনূঢ়া কুমারা। তখন ৫৬ বছর বয়সি আব্দুর রহমান সাইয়্যাদু সুলাইমান নামে একজন চিৎকার করে তাকে কিছু শোনার অনুরোধ করেন। তবে পুলিশ তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে বলেন।
পরে সুলাইমান বলেন, ‘‘আমি চাই, তিনি (দিশানায়েকে) জনগণের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনুক। আগের সরকারের সময়ে মহামারি করোনায় আক্রান্ত এক শিশুর মরদেহ দাহ্য করা হয়। তখন আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। আমি আমার ধর্মের পক্ষে কথা বলেছিলাম। মুসলমানদের সঙ্গে ন্যায়বিচার করা হয়নি।’’
সুলাইমানের আশা, দিশানায়েকে সেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে যা আগের সরকার করেনি। এখন এমন কিছুই করা হবে যা আগে কখনও হয়নি।
বিশ্লেষকদের ভাষ্য, গোতাবায়া ও তার পূর্বসূরী সরকারগুলো দুর্নীতি, রাজনীতিক দায়মুক্তি ও অপশাসনের কারণে ভিন্নধর্মী রাজনীতি ও রাজনীতিবিদের ধারণার দিকে ঝুঁকে পড়েছে লঙ্কাবাসীরা। এতে সুগম হয় দিশানায়েকের বিজয়ের পথ।
নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সামনে অর্থনৈতিক সংকট ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে একাধিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে
রাজনীতি বিশ্লেষক অরুণা কুলাতুঙ্গার মতে, ১৯৭৭ সালের পর এবারই প্রথম চমক সৃষ্টি হয়েছে, আর তা হলো সংসদে একক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন। এটাই প্রথম যে সংসদে আইন পাসের জন্য কোনো মিত্র বা জোটের ওপর নির্ভর করতে হবে না। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে অনূঢ়া এখন সংবিধান সংশোধন করতে পারবেন। এনপিপি ভোটের আগেই এমন একটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘‘এই ফলটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একক কোনো দল জাতি, ধর্ম-বর্ণের কারণে বিভাজনের রাজনৈতিক কাঠামো ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছে। কারণ আগের রাজনৈতিক দলের জোট সরকার গঠনের ফলে নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সমস্যা হতো। যা এখন আর হবে না। তাই এনপিপির কাছ থেকে প্রত্যাশা অনেক বেশি।’’
৩৮ বছর বয়সি বসন্তরাজ নামে এক দিনমজুর বলেছেন, ‘‘এনপিপি প্রার্থীর বিষয়ে তিনি কিছু জানতেন না। কিন্তু তিনি ভালোর জন্য ভোট দিয়েছেন। ’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা বছরের পর বছর একই লোকদের ভোট দিয়ে এসেছি, কিন্তু কোনা পরিবর্তন হয়নি। আমরা দেখব এখন কী হয়।’’
তামিলদের বড় সমর্থন নির্বাচনের ফলে প্রধান চমক ও বড় রদবদল দেখা গেছে জাফনা জেলায় বিজয় লাভের মধ্য দিয়ে। শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলের এই জেলা তামিলদের প্রাণকেন্দ্র ও অন্যান্য অনেক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর জোরালো ঘাঁটি। ২০০৯ সালের মে মাসে বিদ্রোহী তামিল টাইগারদের পরাজিত করে শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনী। যার মধ্য দিয়ে দেশটিতে শেষ হয় ২৬ বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। ওই গৃহযুদ্ধে শ্রীলঙ্কায় প্রায় ১ লাখ মানুষ নিহত হন। প্রায় ২০ হাজার মানুষ নিখোঁজ হন। আর সেখানেই এনপিপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছে।
সামাজিক সংস্কার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনূঢ়ার অনড় অবস্থান নাগরিকদের আকৃষ্ট করেছে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে অনূঢ়ার জনপ্রিয়তাও। যার স্পষ্ট প্রভাব দেখা গেছে নির্বাচনের ফলাফলে। অনূঢ়া যেসব রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম কঠোর দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ, বড় ধরনের কল্যাণ প্রকল্প এবং কর কমানোর অঙ্গীকার।
জাফনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সিনিয়র প্রভাষক আহিলান কাদিরগামার বলেন, ‘‘নির্বাচনের আগেই উত্তরাঞ্চলের তামিল সম্প্রদায়ের মধ্যে এনপিপির প্রতি জরোলো সমর্থন দৃশ্যমান ছিল। তামিল সম্প্রদায়ের লোকজন প্রতিশ্রতি রক্ষা না করায় আগের নেতাদের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলো। এখন এনপিপির উচিত হবে গৃহযুদ্ধের সময় বেদখল হওয়া জমি ফিরিয়ে দিতে পদক্ষেপ নেওয়া। তামিল ও মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উদ্বেগ দূর করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া। তবে এটা কোনো সহজ কাজ নয়।’’
(আলজাজিরা ও বিবিসি অবলম্বনে।)