বৈশ্বিক সংঘাত সত্যিই কি আসন্ন? এমন একটি আশঙ্কা নিয়ে বিচলতি বিশ্বনেতারা। শুধু তাই নয়, এর নিয়ে রীতিমতো চর্চাও করছেন তারা।
সেই সংঘাত যদি শুরু হয়, তাহলে তার কেন্দ্র যে হবে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্র, তা বলাই যায়।এই যুদ্ধক্ষেত্রে ঘিরে নতুন করে ‘বৈশ্বিক সংঘাত’ এর শঙ্কা চড়াও হচ্ছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও পশ্চিমা নেতাদের কথায়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের হুমকি-ধমকিও।
আর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলোনস্কি ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বারবার আহ্বান রাখছেন, তারা যেন আরও কঠোর পদক্ষেপ নেয় রাশিয়ার বিরুদ্ধে। বৈশ্বিক সংঘাত বা পশ্চিমাদের সঙ্গে রাশিয়া ও তার মিত্রদের যুদ্ধের শঙ্কা কার কথায় কীভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে, সে দিকে নজর দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
বৈশ্বিক সংঘাতের হুমকি ‘সত্য ও বাস্তব’: পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী প্রথমে বলা যায় পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড ট্রাস্কের কথা। তার ভাষ্য থেকে এটা বোঝাই যায়, এই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে একক অস্ত্রের ব্যবহার এত ব্যাপক উদ্বেগ ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এই প্রথমবার।
পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড ট্রাস্ক
বৃহস্পতিবার ভোরে ইউক্রেনের দিনিপ্রোর মাটিতে কাঁপন ধরানো বিস্ফোরণগুলো তার প্রমাণ, বলছে বিবিসি।
ইউক্রেনকে রাশিয়ায় তাদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর অনুমতি দেওয়ার জন্য ব্রিটেন এবং আমেরিকার ‘বেপরোয়া সিদ্ধান্ত’ দায়ী করে মস্কো বলছে, এটি বৈশ্বিক যুদ্ধ শুরু করতে পারে। পোলিশ প্রধানমন্ত্রী টাস্ক বলছেন, “যুদ্ধ একটি নিষ্পত্তিমূলক পর্যায়ে প্রবেশ করছে।” তবে একটি বিশ্বব্যাপী সংঘাতের হুমকিও দেখছেন তিনি। তার ভাষায়- এই হুমকি ‘গুরুতর এবং বাস্তব’।
এদিকে স্টকহোমে তার ইউক্রেনীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে সাক্ষাত করে সুইডেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পল জনসন বলেছেন, “ইউক্রেনকে সমর্থন করা থেকে পশ্চিমাদের নিরুৎসাহিত করার প্রচেষ্টা কার্যকর হবে না।”
পুতিন বলছেন, পশ্চিমা দেশে হামলা চালাতে পিছপা হবেন না ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ছায়াশক্তি হিসেবে যুক্ত হয়ে পড়েছে বিশ্বের সব বড় বড় ও ধনী-উন্নত দেশ; নাম আসছে তৃতীয় বিশ্বের।
ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে বৈশ্বিক সংঘাতের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাচ্ছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এখানে শেষ নয়, তিনি রীতিমতো হুঁশিয়ার উচ্চারণ করে বলে দিয়েছেন, দরকার হলে তিনি পশ্চিমা দেশগুলোতে হামলা চালাতেও পিছপা হবেন না।
পশ্চিমাদের দেওয়া দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে গত মঙ্গল ও বুধবার রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলা করেছে ইউক্রেন। তার জবাবও দিয়েছে রাশিয়া। বৃহস্পতিবার ইউক্রেনের দিনিপ্রো এলাকায় ‘নতুন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র’ দিয়ে হামলা করে বসেছে মস্কো।
এই হামলা-পাল্টা হামলার জেরে যুদ্ধের বৈশ্বিক সংস্কারণ শুরু হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইউরোপের নেতারা। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেছেন ন্যাটো মহাসচিব।
ডাচ ও মার্কিন মিডিয়ার তথ্যের বরাত দিয়ে বিবিসি বলছে, ন্যাটো মহাসচিব এবং প্রাক্তন ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট ফ্লোরিডায় ট্রাম্পের বাসভবনে দেখা করতে গেছেন।
ডাচ পত্রিকা ডি টেলিগ্রাফের খবর অনুযায়ী, বিমানযোগে ফ্লোরিডায় গেছেন রুট, সেখানে পাম বিচে ট্রাম্পের অভিজাত মার-আ-লাগো বাসভবনে সাক্ষাৎ করবেন তিনি।
ইউক্রেনীয় বার্তা সংস্থা ইন্টারফ্যাক্সও সম্ভাব্য বৈঠকের খবর দিয়েছে। একই খবর রয়েছে ওয়াশিংটন পোস্টেও। বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়েছে তারা বলেছে, মস্কো এবং কিয়েভের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি অর্জনের বিষয়ে ট্রাম্প ও টাস্কের মধ্যে আলোচনা হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
স্টারমার বলছেন, পুতিন আগ্রাসন বন্ধ করলে যুদ্ধ হতে পারে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছেন, “পুতিন আক্রাসন বন্ধ করলে যুদ্ধ আজই শেষ হতে পারে।”
বিবিসি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনার সময় তার কাছে তারা জানতে চেয়েছিলেন, ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাজ্য কি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে আছে?
উত্তরে স্টারমার বলেন, “না, আমরা যুদ্ধে নেই, তবে ইউক্রেনে তাতে অবশ্যই আছে। কারণ ইউক্রেনে আক্রমণ শানিয়েছে রাশিয়া; সেই যুদ্ধ এখন ১ হাজার বেশি সময় ধরে চলছে।”
“এটি রাশিয়ার আগ্রাসনের ১ হাজার দিন, তবে ইউক্রেনের জন্য ১ হাজার দিনের আত্মত্যাগ। এবং সেই কারণেই আমরা ধারাবাহিকভাবে বলেছি যে, আমরা ইউক্রেনের পাশে আছি। আমরা পুতিনকে এই যুদ্ধে জয়ী হতে দিতে পারি না।”
পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি আগে কখনোই এত তীব্র হয়নি: কিম উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন বলেছেন, ‘আগে কখনোই’ পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি এত তীব্র হয়নি।
এই পরিস্থিতির জন্য পিয়ংইয়ংয়ের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ‘আক্রমনাত্মক এবং শত্রুতামূলক’ নীতিকে দায়ী করেছেন কিম জং-উন।
তিনি বলেছেন, “এর আগে কখনোই কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধরত পক্ষগুলো এত বিপজ্জনক এবং তীব্র সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়নি, যে কারণে এটি সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক থার্মোনিউক্লিয়ার যুদ্ধে পরিণত হতে পারে।”
বৃহস্পতিবার একটি সামরিক প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে উত্তর কোরিয়ার নেতা এই শঙ্কা ব্যক্ত করেন, লিখেছে দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম কেসিএনএ।
কিম জং-উনের ভাষায়- যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় ‘এরইমধ্যে তারা যতদূর যেতে পেরেছেন, তা থেকে বোঝা যায়, এটিকে তারা উত্তর কোরিয়ার প্রতি তাদের ‘আক্রমণাত্মক ও শত্রুতামূলক নীতি’ কখনই বদলাবে না।
উত্তর কোরিয়ার নেতা এমন সময় এসব কথা বলছেন, যখন রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধ নিয়ে বৈশ্বিক যুদ্ধের আশঙ্কা দেখছেন ইউরোপের নেতারা।
উত্তর কোরিয়ার নেতা ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের পক্ষে শক্ত অবস্থা নিয়ে রয়েছেন। দুই নেতার মধ্যে সম্প্রতি সম্পর্কের ঘনিষ্টতা আরও বেড়েছে। তারা দুই দেশে পরস্পর সফরও করেছেন। এখন দেশ দুটির মধ্যে অস্ত্র ও জ্বালানি বিনিময়ের কথাও শোনা যাচ্ছে।
বিবিসি লিখেছে, রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অস্ত্র ও সৈনিক পাঠিয়েছে উত্তর কোরিয়া। এর বিনিময়ে বিনিময়ে উত্তর কোরিয়াকে এক মিলিয়ন ব্যারেলেরও বেশি তেল দিয়েছেন পুতিন।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ সৎজ বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার একটি নতুন মধ্যবর্তী পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের ঘটনা চলমান যুদ্ধে ‘বিপজ্জনক অগ্রগতি’। বিবিসি লিখেছে, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স বলেছে- ইউক্রেনকে সমর্থন করতে এবং স্থায়ী শান্তি অর্জনের জন্য ‘প্রয়োজনীয় সবকিছু’ করবে তারা।
ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তিনি আশা করছেন আগামী মঙ্গলবার ব্রাসেলসে ন্যাটোর সঙ্গে জরুরি আলোচনা ‘অর্থপূর্ণ ফলাফল’ নিয়ে আসবে। সেই সেই ফলাফল যুদ্ধ শেষ করার ক্ষেত্রে নাকি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে ভূমিকা রাখবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।