আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সামর্থ্যবান সবাইকে করের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েও শেষ মুহূর্তে নিজের অবস্থান থেকে পিছিয়ে এলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সুপারিশে আগামী অর্থবছরে সামর্থ্যবান সবাইকে করের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে এসেছেন তিনি।
তবে কর আদায় বাড়ানো হবে। চলতি অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকবে বলে মনে করছেন অর্থমন্ত্রী। আগামী অর্থবছরের বাজেট ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে এবং বাজেটে ছিটমহলবাসী ও চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। সেই সঙ্গে হিজড়া ও সমাজের দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন উদ্যোগ নেওয়া হবে।
শুক্রবার সিলেটের ধোপাদীঘিরপাড়ে নিজস্ব বাসভবন ‘হাফিজ কমপ্লেক্স’-এ আসন্ন বাজেট নিয়ে রাইজিংবিডিকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রাইজিংবিডির বিশেষ প্রতিনিধি কে এম এ হাসনাত।
আগামী ৪ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে, আর বাজেট পাস হবে ৩০ জুন। এই নিয়ে জাতিকে টানা সাতটি বাজেট দেওয়ার নতুন রেকর্ড গড়তে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এর আগে এরশাদ সরকারের সময় দুটি বাজেট দিয়েছিলেন তিনি। তবে ১২টি বাজেট দিয়ে সিলেটের আরেক কৃতী সন্তান সাইফুর রহমান সর্বোচ্চসংখ্যক বাজেট প্রণয়নের রেকর্ড ধরে রেখেছেন।
রাইজিংবিডি : কেমন আছেন?
অর্থমন্ত্রী : আল্লাহ তাআলার অশেষ কৃপায় এখন ভালো আছি। তবে বাজেট নিয়ে খুবই ব্যস্ত।
রাইজিংবিডি: সাইফুর রহমান ১২টি বাজেট দিয়ে সর্বোচ্চ রেকর্ডটি ধরে রেখেছেন। তার এ রেকর্ড ভাঙতে পারবেন কি না?
অর্থমন্ত্রী : এ প্রশ্নের জবাবে সহজাত এবং দিলখোলা হাসি দিয়ে উপরের দিকে (পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা) হাত তুলে বললেন ‘উনি জানেন! আমাকে যদি সুস্থ রাখেন তাহলেই সম্ভব।’
রাইজিংবিডি : আসন্ন বাজেটের আকার নিয়ে বিভিন্ন কথা বলা হচ্ছে। এ বিষয়ে কিছু বলুন।
অর্থমন্ত্রী : চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমে দুই লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসবে। আর আগামী বাজেটের আকার ৩ লাখ কোটি টাকা পেরিয়ে যাবে। এত দিন আমি বলেছিলাম, বাজেটের আকার ৩ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি হবে। কিন্তু বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা এবং রাজস্ব ব্যয়ও কিছুটা বাড়ায় বাজেটের আকার ৩ লাখ কোটি টাকার ওপরে চলে যাবে।
রাইজিংবিডি : করের আওতা বাড়াবেন কি না?
অর্থমন্ত্রী : এবার ব্যক্তি করের আওতা বাড়ানোর ইচ্ছা ছিল। তা হচ্ছে না, তবে বড় একটা অংশকে করের আওতায় নিয়ে আসব। ১৬ কোটি মানুষের দেশে কর দেয় মাত্র ১১ লাখ মানুষ, যা মোট জনসংখ্যার দশমিক ১ শতাংশেরও কম। এটা লজ্জার বিষয়! এটা হতে পারে না। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় এ হার অত্যন্ত কম। তবে দেশে করদাতার সংখ্যা যে করেই হোক বাড়াব। এনবিআর একটা জরিপ করেছে। কিছু নাম-টাম পেয়েছে। তাদের এবার করের আওতায় আনা হবে। আর এ সংখ্যাও কম নয়।
রাইজিংবিডি : নতুন কাদের করের আওতায় আনা হচ্ছে?
অর্থমন্ত্রী : (হেসে দিয়ে বলেন) সেটা তো এখন বলা যাবে না। এটা টপ সিক্রেট। আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। অপেক্ষা করেন, দেখতে পাবেন। এরা কর দেওয়ার উপযুক্ত হলেও এত দিন করের আওতার বাইরে ছিলেন। এনবিআর এদের খুঁজে বের করেছে।
রাইজিংবিডি : বছরের শুরুতেই বিএনপি-জামায়াত জোটের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দেশের অর্থনীতিকে অনেকটা স্থবির করে দেয়। এরপরও এত বড় বাজেটের অর্থের জোগান আসবে কোথা থেকে?
অর্থমন্ত্রী : দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার আভাস, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম অপেক্ষাকৃত কম এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ অব্যাহত থাকায় রিজার্ভও ভালো। এ ছাড়া দেশের আমদানি-রপ্তানির অবস্থা খুবই ভালো। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি একটি স্বস্তিদায়ক অবস্থানে রয়েছে, যা বাজেটের আকার বাড়াতে আমাকে সাহস জুগিয়েছে। বাজেটের আকার বড় হলেও তা নিয়ে আমি মোটেও বিচলিত নই। বরং এত বড় একটি বাজেট দিতে যাচ্ছি ভেবে বেশ খুশিই লাগছে আমার। আর এই বড় বাজেট দিতে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট আমাকে সাহস জুগিয়েছে। এবার আমি সত্যিই একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থার মধ্যে বাজেট দিতে যাচ্ছি। এমন ফুরফুরে মেজাজে আগে কখনো বাজেট দিইনি।
রাইজিংবিডি : স্বস্তিকর অবস্থা বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?
অর্থমন্ত্রী : আমাদের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আমরা এই স্থিতিশীলতা এনেছি। হরতাল-অবরোধ চিরবিদায় নিয়েছে। দেশে আর কোনো সহিংসতা হবে বলে মনে করি না। এখন দেশে শান্তি ফিরে এসেছে এবং সেটা অব্যাহত থাকবে। কোনো ধরনের অস্থিরতা-সংঘাত বরদাশত করা হবে না। আমাদের উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে। তারা এখন নির্ভয়ে বিনিয়োগ করবেন, ব্যবসা করবেন। দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবেন। সরকার তাদের পাশে থাকবে।
রাইজিংবিডি : হিজড়া ও দলিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ ছাড়াও এবারের বাজেটে নতুন আর কী কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে?
অর্থমন্ত্রী : এবারের বাজেটে ছিটমহলবাসীর উন্নয়নে ‘বিশেষ উদ্যোগ’ নেওয়া হবে। ভারতের কাছ থেকে ছিটমহলগুলো আমরা অনেক দিন পর পেয়েছি। তাদের জন্য কিছু করা কর্তব্য বলে মনে করছি। এবারের বাজেটে ছিটমহলবাসীদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। রাখা হবে বিশেষ বরাদ্দ।
অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি একটি চা-বাগানে গিয়েছিলেন চা শ্রমিকদের অবস্থা দেখার জন্য। সাক্ষাৎকারের এই পর্যায়ে তিনি তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন,‘আমি মনে করি আমাদের সমাজে চা-শ্রমিকরা সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন। তারা না পাচ্ছেন স্বাস্থ্যসেবা, না পাচ্ছেন সন্তানদের লেখাপড়ার সুযোগ। সবচেয়ে অমানবিক দিক হচ্ছে, তাদের ভাগ্যে সুপেয় পানিও জোটে না। ছড়ার পানি দিয়েই তারা তেষ্টা মেটায়, পয়ঃ কাজেও এই পানিই ব্যবহার করেন। এবারের বাজেটে তাদের জন্য কিছু করতে হবে।’
রাইজিংবিডি : দেশীয় শিল্প রক্ষায় কী কী উদ্যোগ থাকবে?
অর্থমন্ত্রী : আমরা তো সব সময় দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করে আসছি। এবারের বাজেটও দেশীয় শিল্পবান্ধব হবে।
রাইজিংবিডি : বড় বড় প্রকল্প নিয়ে আপনি বা আপনার সরকারের ভাবনা কী?
অর্থমন্ত্রী : অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বড় বড় প্রকল্প সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করা হবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হবে। ইতিমধ্যে প্রকল্পের প্রায় ২০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। জাপানি অর্থায়নে মেট্রোরেলের ভূ-তাত্ত্বিক জরিপের কাজও প্রায় শেষ হওয়ার দিকে। ২০১৯ সালের মধ্যে এর কাজ শেষ হবে বলে আশা করি। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন রাস্তার কাজ চলছে। এটাও খুব শিগগির শেষ হবে। তবে নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের আপাতত কোনো চিন্তা করছি না আমরা। রাইজিংবিডি : বাজেটে বরাদ্দ বেশি থাকছে কোন কোন খাতে?
অর্থমন্ত্রী : বাজেট বরাদ্দের দিক থেকে এবারও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতই অগ্রাধিকার পাবে। এ ছাড়া রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় বেশ গুরুত্ব দেওয়া হবে। আগামী বাজেটে তিনটি জেলায় নতুন রেললাইন স্থাপন করা হবে।
রাইজিংবিডি : সমুদ্রসম্পদ আহরণে কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
অর্থমন্ত্রী : সমুদ্রজয় আমাদের অনেক বড় বিজয়। কিন্তু আমরা আমাদের সমুদ্রসম্পদ সম্পর্কে ততটা সচেতন নই। সমুদ্রসম্পদকে সঠিকভাবে আহরণ করতে পারলে আমাদের অর্থনীতিতে তা অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। আমরা অবশ্যই এ দিকে নজর দেব।
রাইজিংবিডি: মানব পাচার দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে?
অর্থমন্ত্রী: মানব পাচার নিয়ে সাম্প্রতিক কালে যা চলছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং অমানবিক কাজ। মানুষ হয়ে মানুষকে কীভাবে এমন বিপদে ফেলতে পারে, তা আমি ভাবতেই পারি না। সরকার অত্যন্ত মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখছে। মানব পাচারকারী এবং তাদের দালালদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। এদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হবে।
রাইজিংবিডি: গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি করছেন অনেকেই। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
অর্থমন্ত্রী: যারা নতুন নির্বাচনের কথা তুলেছিলেন তারা এখন সে অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। তবে কে কী বলল তা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নাই। নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষেই নতুন নির্বাচন হবে।
রাইজিংবিডি : মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়টি ঝুলে গেল কেন?
অর্থমন্ত্রী : মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের আয়-ব্যয়ের প্রসঙ্গে আপনারা তো সবই জানেন। আমার ইচ্ছা থাকলেই হলো না। এটা সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণের বিষয়। তবে সংশ্লিষ্টরা যাতে তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব দেয়, সে বিষয়ে আমি চেষ্টা করব।
রাইজিংবিডিকে মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অর্থমন্ত্রী : এত কষ্ট করে ঢাকা থেকে সিলেট এসে আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে রাইজিংবিডি পরিবারকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ মে ২০১৫/হাসনাত/সন্তোষ/এএন