সাক্ষাৎকার

‘সফলতার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার মনোবল’

ভ্যালী চাকমা। জন্ম রাঙ্গামাটিতে। বাবার অনুপ্রেরণায় আইন পড়তে উদ্ধুদ্ধ হন তিনি। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধীনে আইনে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে এখন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।শুধু তাই নয় চাকমা সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা উচ্চ আদালতের দ্বিতীয় নারী আইনজীবী তিনি। নিজ সম্প্রদায়ের অসহায় মানুষকে আইনগত সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি মানুষের জন্য করতে চান, আইন পেশায় অবদান রাখতে চান উদীয়মান এই আইনজীবী।  তার জীবনে নানা অজানা বিষয় রাইজিংবিডির কাছে তুলে ধরেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাইজিংবিডির সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদক মেহেদী হাসান ডালিম।

রাইজিংবিডি: আপনার নিজের সম্পর্কে জানতে চাই-

ভ্যালী চাকমা:  জন্ম  ১৯৯১ সালে রাঙ্গামাটি পাবর্ত্য জেলায়। বাবার নাম কল্যাণ মিত্র চাকমা। বাবা কাস্টমসের সহকারী কমিশনার হিসেবে বেনাপোল অফিসে আছেন। আমরা তিন ভাইবোন। আমি দ্বিতীয়। আমার বড় বোন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে এখন গৃহিণী। তার স্বামী ইনকাম ট্রাক্সের ডেপুটি কমিশনার।  ছোট ভাই নর্থ সাউথে ফার্মেসিতে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে বেক্সিমকোতে চাকরি করছেন। বাবার চাকরির বদলিজনিত কারণে এক বছর বয়স থেকে আমি খুলনায় ছিলাম।  খুলনা সরকারী করনেশন বালিকা বিদ্যালয়ে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়াশুনা করি। এরপর  চট্টগ্রাম চলে আসি। চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ২০০৬ সালে এসএসসি পাস করি।  চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ থেকে ২০০৮ সালে আমি এইচএসসি পাস করি। পরে ঢাকায় চলে আসি। ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধীনে ভূইয়া একাডেমিতে ভর্তি হই। ২০১৩ সালে আইনে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করি। ২০১৫ সালে এলএলএম কমপ্লিট করি ধানমন্ডির ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে। ২০১৬ সালে আামি ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হই। ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হই।

রাইজিংবিডি: কার অনুপ্রেরণায়,কেন আইন পড়লেন?

ভ্যালী চাকমা: আব্বু জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্টুডেন্ট ছিলেন। রাজনীতি পছন্দ করতেন। আমার দাদা, চাচা সবাই রাজনীতি করেন। বাবা চাইতেন আমি যেন ব্যারিস্টারি পড়ে রাজনীতি করি। যদিও কর্মাস ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্রী ছিলাম। মূলত বাবার অনুপ্রেরণায় তার স্বপ্ন পূরণে আইনে ভর্তি হই।

রাইজিংবিডি: সুপ্রিম কোর্টে কতজন চাকমা সম্প্রদায়ের আইনজীবী আছেন?

ভ্যালী চাকমা: বাংলাদেশে তো অনেক নৃ-গোষ্ঠী আছে। তার মধ্যে চাকমা হচ্ছেন বৃহত্তর নৃ-গোষ্ঠী। আমার জানামতে চাকমা সম্প্রদায় থেকে বেশকিছু আইনজীবী হয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টে একজন চাকমা ডিআইজি আছেন। আমি যতটুকু জানি চাকমা সম্প্রদায় থেকে আমি সুপ্রিম কোর্টের দ্বিতীয় নারী আইনজীবী। আমার আগে খাগড়াছড়ির একজন নারী আইনজীবী ছিলেন সুপ্রিম কোর্টে। তবে আমি চাকমা সম্প্রদায় থেকে রাঙ্গামাটির প্রথম সুপ্রিম কোর্টের নারী আইনজীবী।

রাইজিংবিডি: চাকমা সম্প্রদায় থেকে সুপ্রিম কোর্টে প্রতিনিধিত্ব করছেন,এটা কেমন লাগে?

ভ্যালী চাকমা: আমি মনে করি সুপ্রিম কোর্টের একজন অ্যাডভোকেট হওয়া অনেক গৌরবের বিষয়। আমার প্রাউডের বিষয় যে আমি আমার জাতিকে রিপ্রেজেন্ট করতে পারছি।  আমি এমন এক জায়গায় আছি যেটার মাধ্যমে আমার সম্প্রদায় এবং অন্যান্য সম্প্রদায়কে আইনি সহায়তা দিতে পারবো। আমি আরেকটা কথা বলতে চাই, দাদা এবং চাচা তারা সমাজসেবক। আমার দাদা লংগদু উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন।  বর্তমানে আমার আপন চাচা লংগদু ইউনিয়নের পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন। আমরা বংশগতভাবেই মানুষকে সহায়তা করে আসছি।

রাইজিংবিডি: পড়াশুনা বা পেশায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে কখনও কী অবহেলার শিকার হয়েছেন?

ভ্যালী চাকমা: সত্যি কথা বলতে গেলে ডিরেক্টলি না বাট ইনডিরেক্টলি অনেক সময়ে এরকম অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি।  যেমন আমি যদি পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেয়ে যেতাম বা ভালো রেজাল্ট করতাম তারা এমন কমেন্ট করতো যে আমি রাঙ্গামাটির চাকমা মেয়ে আমি কিভাবে এত ভালো রেজাল্ট করতে পারি। এরকম কিছু খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। সুপ্রিম কোর্টে এসেও এমন একটা বাজে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। আমাকে একজন ইনডিরেক্টলি থ্রেট দিয়েছে আমি তো চাকমা মেয়ে আমি কতদূর যেতে পারবো। উনি আমাকে দেখে নিবে। যিনি এ মন্তব্য করেছেন তিনি আমার সিনিয়র। সিনিয়রদের কাছ থেকে এটা অবশ্যই কাম্য নয়। আমরা যেমন বড়দের অনেক সম্মান করবো, ঠিক তেমনি বড়দের কাছ থেকে স্নেহ-সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।

ভ্যালী চাকমার সঙ্গে কথা বলছেন রাইজিংবিডির সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদক মেহেদী হাসান ডালিম

রাইজিংবিডি: সফলতার জন্য কোন গুণগুলো থাকা দরকার বলে মনে করেন?

ভ্যালী চাকমা: আমি মনে করি সফলতার জন্য যেটা সবচেয়ে বেশি দরকার মনোবল। আপনার ডেডিকেশন অবশ্যই থাকতে হবে এবং আপনার উইল পাওয়ার থাকতে হবে।  আপনি যদি মনে করেন আপনি এটা করতে পারেন তাহলে অবশ্যই পারবেন।

রাইজিংবিডি: চাকমা সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি বা উৎসব সম্পর্কে বলুন?

ভ্যালী চাকমা: মূলত আমরা চাকমাবৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। আমাদের মেইন ধর্মীয় অনুষ্ঠান হচ্ছে বৌদ্ধ পূর্নিমা। সাংস্কৃতিক দিক থেকে  আমাদের পাবর্ত্য এলাকার মানুষের আলাদা সংস্কৃতি রয়েছে। আমরা সবচেয়ে যেটা বেশি পালন করি সেটা হচ্ছে বিজু উৎসব। যেটা প্রতি বছর ১৩ এপ্রিল পালন করি। যেটাকে বৈশাবী উৎসব বলা হয়। এইদিন আমরা অনেক মজা করি। ১৩ এপ্রিলের পর দিন ১৪ এপ্রিল তো নববর্ষ। নববর্ষ আমরা অনেক ধুমধাম করে উদযাপন করি। এছাড়াও অনেক উৎসব পালন করি।

রাইজিংবিডি: চাকমা সম্প্রদায়ের রাজা সম্পর্কে বলুন?

ভ্যালী চাকমা: আমাদের রাজা ব্যারিস্টার দেবাশিষ রায়।  তিনি হলেন চাকমা সার্কেলের প্রধান। পার্বত্য অঞ্চলের নৃ-গোষ্ঠীদের মধ্যে তিনটি সার্কেল রয়েছে। এর মধ্যে একটা হচ্ছে চাকমা সার্কেল।  নিয়ম হচ্ছে, যদি কেউ ঝামেলায় বা আইনগত কোনো বিপদে পড়েন তাহলে প্রথমে তিনি রাজার কাছে যাবেন। তিনি সালিশের মাধ্যমে ওটা মিমাংসা করার চেষ্টা করবেন। যদি আপনি উনার বিচারে সংক্ষুব্ধ হন তাহলে আপনি কোর্টে আসতে পারবেন। এটাই হচ্ছে মূলত নিয়ম।

রাইজিংবিডি: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলুন?

ভ্যালী চাকমা: আমি অলরেডি সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। স্বপ্ন অনেক বড় আইনজীবী হওয়া। করোনাকাল গেলে ব্যারিস্টারি ডিগ্রি নিতে ইংল্যান্ডে যাব। আইনপেশায় প্রতিষ্ঠিত হলে রাজনীতি করার ইচ্ছে রয়েছে।