সাক্ষাৎকার

শেখ হাসিনা প্রতিটি জায়গায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন: স্বদেশ রায়

সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য একুশে পদক পাওয়া স্বদেশ রায় প্রাবন্ধিক হিসেবেও সমধিক পরিচিত। প্রায় চার দশকের সাংবাদিক জীবনে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করেছেন। প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় দুই বিভাগেই রয়েছে তার কাজের অভিজ্ঞতা। তার বিভিন্ন লেখা ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কর্মসূত্রে তিনি বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সান্নিধ্যে এসেছেন। খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষ্যে স্বদেশ রায়ের এই সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হলো।

রাইজিংবিডি: প্রায় চার দশক আগে শেখ হাসিনা দলীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সেই সময়, সেই বিধ্বস্ত সময়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে সংগঠনের হাল শক্ত করে ধরেন তিনি। সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগে কতটা পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন?

স্বদেশ রায়: বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর থেকে ১৯৮১ সালের আগে আওয়ামী লীগের যারা মূল নেতৃত্বে ছিলেন তাদের বড় একটা অংশ ছিল আপোষকামী। তারা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আপোষ করেই রাজনীতি করছিলেন। আরেকটা অংশ আপোষকামী ছিল না। কিন্তু তারা নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারছিলেন না। তবে সে সময় ছাত্রলীগ এবং গ্রাউন্ড লেভেলের কর্মীরা ছিল অসম্ভব আদর্শবাদী। তারা বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। এ সময়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করা যায় না তখন তারা কতটা সৎ এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করতেন। সে সময় এমন একটি নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল যে সামরিক শাসনের সঙ্গে কোনোরকম আপোষ না করে আওয়ামী লীগকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করবে। ওই সময়ে আওয়ামী লীগের আদর্শবাদী নেতাদের ভেতরে রাজনৈতিক মতভেদ ছিল, কিন্তু এটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। এটাকে রাজনৈতিক থিওরি বলা যেতে পারে।

আদর্শবাদী ছাত্র-যুব-তৃণমূলের নেতাদের একটা অংশ চাইতো সামরিক শাসকের পতন ঘটিয়ে সরকার গঠন করতে। সেটা কমিউনিস্ট বা যে কোনো কায়দায়ই হোক না কেন। আরেকটা অংশ মনে করতেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমাদের রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে। কারণ আমরা বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে পারিনি। সুতরাং এই সামরিক সরকারকে রাজনীতি দিয়েই রুখতে হবে। এই দুই আদর্শবাদীদের কেউ কিন্তু মূল নেতৃত্বে ছিল না। ঠিক এই সময়ে আওয়ামী লীগের ভেতর মূল নেতৃত্বে যারা আদর্শবাদী ছিলেন, তাদের চেষ্টায় শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট  হলেন।

এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার, অনেকে বলেন, কাউন্সিলের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে প্রেসিডেন্ট করা হলো; প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি রাজনীতিতে ঢুকেছেন। কথাটি সঠিক নয়। কারণ শেখ হাসিনা ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর পাওয়ার পর শোকাহত ছিলেন শেখ হাসিনা। ওই পরিস্থিতিতে তিনি রাজনীতির সিদ্ধান্ত নেন। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ওই সময় দেশের বাইরে ছিলেন। ড. কামালকে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আপনি বঙ্গবন্ধুর সরকার অর্থাৎ বৈধ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানান, অবৈধ, খুনি মোশতাক সরকারকে যেন স্বীকৃতি না দেয়া হয়।  কিন্তু ড. কামাল হোসেন এ বিষয়ে সাড়া দেননি বরং শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনি যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।

শেখ হাসিনা কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই রাজনীতিতে এসেছেন বিষয়টা তা নয়। ১৯৭৫ সালে থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি কিন্তু রাজনৈতিক প্রস্তুতি নিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের পর লন্ডনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে জনমত গড়ে তোলার কাজও তিনি করেছেন। শুধু তাই নয়, ইউরোপ-আমেরিকায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে জনমত গড়ে তোলার নেতৃত্বও নানাভাবে দিয়েছেন তিনি। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছা ও প্রস্তুতিতে হয়েছে।  দায়িত্ব নেয়ার পর আওয়ামী লীগের ভেতর ও বাইরে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করতেন, শেখ হাসিনার বয়স কম, হয়তো তিনি দায়িত্ব বয়ে নিতে পারবেন না। কিন্তু আমরা যারা কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি, তারা দেখেছি তিনি প্রতিটি জায়গায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। চল্লিশ বছর পর আজ বলতে পারি, শেখ হাসিনা দুটো দিক গুরুত্ব দিয়ে ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন— এক. আওয়ামী লীগ কখনো আপোষকামী দল হবে না। অর্থাৎ সামরিক শাসনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো আপোষ নেই। দুই. রাজনীতি দিয়েই সব মোকাবিলা করতে হবে।  

রাইজিংবিডি: বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন তারই সুযোগ্যা-কন্যা। শেখ হাসিনার হাত ধরে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই পথচলায় প্রতিবন্ধকতা মূলত কোথায়?    

স্বদেশ রায়: বঙ্গবন্ধুর সময়ের প্রেক্ষাপট ও শেখ হাসিনার সময়ের প্রেক্ষাপট ও বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে একক নেতা ছিলেন। তখন বাংলাদেশে বিরোধী কোনো শক্তি ছিল না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বিদেশি সাহায্য ও রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যবহার করে বাংলাদেশ-বিরোধী একটা শক্তিকে দাঁড় করানো হয়েছে। তারা কিন্তু শেখ হাসিনার বিরোধী শক্তি। এটা হলো মোটা দাগে রাজনৈতিক পার্থক্য। এখন অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে আসি— বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে যে অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন এর মধ্যে দুটি বিষয় ছিল। এক. অর্থনৈতিকভাবে দেশের মানুষকে সমানভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। যাতে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর হয়। দুই. স্থানীয় সরকার অর্থাৎ জেলায় জেলায় সরকার গঠন করতে চেয়েছিলেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে সরকারকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এটা যদি হতো তাহলে বাংলাদেশ একটা ভিন্ন বাংলাদেশ হতো।

বর্তমানে শেখ হাসিনা সরকার বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য যে কাজ করছে তা হলো— বঙ্গবন্ধুর বাকশালের যে ১২টি অর্থনৈতিক কর্মসূচি ছিল, তার সবগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে তারা। কিন্তু এটা করতে হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে। শেখ হাসিনা সরকারের যে উন্নয়ন, সেক্ষেত্রে বেসিক কিছু বিষয় মানা হয়। যেমন সাধারণ মানুষ যেন খাদ্য পায় তা নিশ্চিত করা। সাধারণ মানুষ যাতে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা পায় তা নিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে ধনী-গরিবের বৈষম্য থাকে কিন্তু একেবারে দারিদ্র্যসীমার নিচে যাতে কেউ না থাকে সেই চেষ্টা করা হয়। জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি দিয়ে সব সময় সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া হয়। 

অন্য সরকারের সময়ে ধনী-গরিবের বৈষম্য বেড়ে যায়, একটা বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়, খাদ্য আমদানি-নির্ভর হয়ে পড়ে। সামাজিক সুরক্ষাগুলো আস্তে আস্তে কমে যায়। ফলে পাকিস্তানের আমলের মতো কেবল একটি শ্রেণি বলি হতে থাকে। এই হলো গত ৫০ বছরে দুই ধরনের সরকারের চরিত্র ও পার্থক্য।  

রাইজিংবিডি: আপনার দৃষ্টিতে এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ কী?

স্বদেশ রায়: এখন আমরা একটা অনিশ্চিত সময়ে দাঁড়িয়ে আছি। শুধু আমরা না গোটা পৃথিবী। এ জন্য হুট করে কোনো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মন্তব্য করা যাবে না। মহামারি করোনার কারণে গত দুই বছরে বিশ্বে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বড় পরিবর্তন ঘটেছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক পরিবর্তন। এখন করোনা কেবল স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এই দুই বছরের ধাক্কায় পৃথিবী কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটা একটি বিষয়। এ পরিস্থিতিতে যে কোনো দেশের জন্য সেই নেতৃত্ব সবচেয়ে বেশি উপযোগী যে নেতৃত্বের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্যতাসম্পন্ন, শিক্ষিত অন্য কোনো নেতা নেই। এই করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে আগামী ১০ বছর সময় লাগবে পৃথিবীর। এই দশ বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বাংলাদেশের ভীষণ প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে বয়সের চিন্তা করলে চলবে না। কারণ মাহাথির মোহাম্মদ কিন্তু ৯০ বছর বয়সে দায়িত্ব নিয়েছেন।

রাইজিংবিডি: বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে শক্তির জায়গা ছিল গণমানুষের ভালোবাসা। দুর্বলতা ছিল তিনিও দেশের জনগণকে প্রাণাধিক ভালোবাসতেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সবচেয়ে শক্তির জায়গা কোথায় বলে আপনি মনে করেন? 

স্বদেশ রায়: মানুষের প্রতি ভালোবাসা শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা। তার আগে একটি ঘটনা বলি। কথায় কথায় একদিন আমি তাকে (শেখ হাসিনা) প্রশ্ন করেছি, আপা আপনি যেভাবে অতি সাধারণ মানুষকে বুকে জড়িয়ে ধরেন তা দেখলে উপলদ্ধি করতে পারি রাজনীতি করাটা কত কঠিন। এ কথা শুনে আপা হেসে বললেন, ‘বাংলাদেশের একজন অতি সাধারণ মানুষ অনেক ধনীর চেয়ে মূল্যবান। সাধারণ মানুষকে আমি ভালোবাসি। এটা আমার বাবারও আদর্শ ছিল।’ সাংবাদিক হিসেবে তার সঙ্গে যখন সারাদেশ ঘুরেছি, তখন দেখেছি সাধারণ মানুষকে কীভাবে কাছে টেনে নিতেন তিনি। মনে হতো তারা তার মা-বোন কিংবা অতি নিকটাত্মীয়। এই গুণ বঙ্গবন্ধুরও ছিল। সেই ছায়া তার মধ্যেও বিরাজমান। এখান থেকে বলা যায়, শেখ হাসিনার মূল শক্তি সাধারণ মানুষের ভালোবাসা।   

রাইজিংবিডি: গতকাল ৭৫-এ পা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।   

স্বদেশ রায়: আমি মনে করি, কিছু কিছু জন্মদিন হয় ব্যক্তি বা তার পরিবারের। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ জন্মায় তাদের জন্ম হয় কোনো জাতির জন্য বা গোটা পৃথিবীর মানুষের কল্যাণের জন্য। গতকাল ছিল শেখ হাসিনার জন্মদিন। তিনি আমাদেরই গর্ব। কারণ তার মতো একজন রাষ্ট্রনায়ক আমরা পেয়েছি।