শিশুকিশোরদের উপযোগী বিভিন্ন ধরনের বই প্রকাশ করে ইতোমধ্যেই পাঠক মহলে পরিচিতি পেয়েছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড। শিশুসাহিত্য প্রকাশে তাদের রয়েছে নিজস্ব ধরন এবং ভাবনা। বিভিন্ন ধরনের পাঠকের প্রত্যাশা পূরণে প্রতিষ্ঠানটি ফিকশন, নন-ফিকশন, ফ্যান্টাসি, সায়েন্স ফিকশন, হরর, কমিক্স, অটোবায়োগ্রাফি, অনুবাদ ইত্যাদি বই নিয়ে কাজ করছে। স্বরলিপির সঙ্গে পাঞ্জেরীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল হাসান শায়কের কথোপকথনে উঠে এসেছে সেসবের আদ্যোপান্ত।
স্বরলিপি : বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প অনেক দূর এগিয়ে গেছে। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স এই যাত্রার সহযাত্রী। বিশেষ করে শিশুসাহিত্য প্রকাশে আপনাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যায়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাচ্ছি।
কামরুল হাসান শায়ক : পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স ১৯৯৪ সাল থেকে এডুকেশনাল বই প্রকাশের মধ্যে দিয়ে প্রকাশনা জগতে প্রবেশ করে। ২০০০ সালে এটি লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়। সেই থেকে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প সামগ্রিকভাবে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন নিয়ে প্রকাশনার সবগুলো শাখা নিয়ে গবেষণা করে বই প্রকাশের উদ্যোগ আমরা গ্রহণ করি। সেই অর্থে ২০০০ সাল থেকে সৃজনশীল শাখায়ও আমরা বই প্রকাশ শুরু করি। সৃজনশীল বই প্রকাশের ক্ষেত্রে আমরা শিশুকিশোরদের জন্য বই প্রকাশকে গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ, আমাদের লক্ষ্য ছিল পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত বইয়ের দীর্ঘমেয়াদি পাঠকশ্রেণী তৈরি করা। ২০০০ সালের শিশুকিশোররা আজ যথেষ্ট বড় হয়েছে। ২৩ বছরের এই পাঠক তৈরির অভিযাত্রায় আমরা অনেকটাই সফল। এখন আমরা সব শ্রেণীর পাঠকের জন্য সব ধরনের বই প্রকাশ করার সাহস অর্জন করেছি। আমরা মোটামুটি জানি, আমাদের কোন বইয়ের পাঠক কে, কোন বইটির চাহিদা কতো কপি হতে পারে ইত্যাদি।
আমরা শিশুকিশোরদের জন্য বয়সভিত্তিক বই প্রকাশ করি। তাদের সৃজনশীল, মনস্তাত্ত্বিক বিকাশকে এ ক্ষেত্রে আমরা গুরুত্ব দেই। এ জন্য আমাদের গবেষণা রয়েছে। সে অনুযায়ী বইয়ের বিষয়, শব্দ চয়ন, বাক্যগঠন, অনুচ্ছেদ নির্মাণ, বইয়ের পৃষ্ঠায় ব্যবহৃত টেক্সট এবং ছবির অনুপাত, টেক্সটের ফন্ট ও সাইজ নির্বাচন, ছবিতে ব্যবহারের জন্য রং নির্বাচন, বইয়ের সাইজ, নান্দনিক উপস্থাপনা ইত্যাদি সব বিষয় পাঠকের বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমরা বই প্রকাশ করি। বয়সভিত্তিক বইগুলো আবার জনরা ভিত্তিক ভাগেও ভাগ করা হয়েছে। যেমন ফিকশন, কনটেম্পোরারি ফিকশন, মিস্ট্রি, হিসটোরিক্যাল ফিকশন, ফেইরিটেল, ফোকটেল, ফ্যান্টাসি, সায়েন্স ফিকশন, হরর, নন-ফিকশন, বায়োগ্রাফি বা অটোবায়োগ্রাফি।
স্বরলিপি : লেখা এবং অলঙ্করণ- এই দুইয়ের সামঞ্জস্য কীভাবে করেন?
কামরুল হাসান শায়ক : প্রকাশনার জন্য নির্বাচিত লেখাটি আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক নির্দেশনা অনুযায়ী সম্পাদকমণ্ডলী সম্পাদনা করেন। প্রধান সম্পাদক পুরো প্রক্রিয়াটি মনিটরিং করেন। সম্পাদনার মাধ্যমে বয়সভিত্তিক বই নির্মাণের প্রাতিষ্ঠানিক নির্দেশনা অনুসরণ করে পাণ্ডুলিপি প্রকাশের উপযোগী করা হয়। তবে স্বনামধন্য লেখক বিষয়গুলো বোঝেন এবং লেখার সময় সচেতন থাকেন বলে সেসব পাণ্ডুলিপি খুব একটা সম্পাদনার প্রয়োজন হয় না। পাণ্ডুলিপির পাশাপাশি অলঙ্কার পরিকল্পনা এমনভাবে গ্রহণ করা হয় যেন শিশুকিশোররা বই পাঠের সময় নিজের মতো একটা কল্পনার জগতে হারিয়ে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, লেখা ও অলঙ্করণ পৃষ্ঠাজুড়ে কোন বয়সের শিশুর জন্য কতো অনুপাতে, কি রঙের হবে সম্পাদকমণ্ডলী চিত্রশিল্পীদের সঙ্গে আলোচনা করে নিশ্চিত করেন।
স্বরলিপি : পাঞ্জেরী থেকে একটি বই প্রকাশের ধাপগুলো কী কী?
কামরুল হাসান শায়ক : এখানে প্রচুর লেখক বছরজুড়ে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে থাকেন। আবার আমাদের পাণ্ডুলিপি সংগ্রাহক টিমও ভালো পাণ্ডুলিপির সন্ধান পেলে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করে সংগ্রহ করে আনেন। আমাদের সম্পাদকমণ্ডলীর বিবেচনায় পাণ্ডুলিপি প্রকাশের জন্য নির্বাচিত হলে তা অনুমোদনের জন্য পরিচালনা পর্ষদের সভায় পাঠানো হয়। পাণ্ডুলিপি প্রকাশের সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখকের সঙ্গে লেখক-প্রকাশক চুক্তি সম্পাদন করা হয়। পাণ্ডুলিপি প্রি-প্রেসে কম্পোজের পরে সম্পাদনা, প্রুফ রিডিং শেষে চূড়ান্ত পাণ্ডুলিপি লেখক কর্তৃক চূড়ান্ত সম্পাদনা শেষে লেখকের অনুমোদন নেয়া হয়। যে সকল বইয়ের ভেতরে ছবি বা অলঙ্করণ ব্যবহার করতে হয়, সেসব পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত সম্পাদনার সময় লেখককে দেখিয়ে অনুমোদন করিয়ে নেয়া হয়। প্রচ্ছদ শিল্পী কর্তৃক প্রচ্ছদ আঁকার পর সেটাও লেখকের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রি-প্রডাকশনের কাজ শেষে সম্পূর্ণ উৎপাদন পরিকল্পনা পোস্ট প্রডাকশনকে জানিয়ে দেয়া হয়। বই প্রকাশিত হওয়ার পাশাপাশি বইটির স্টোর কিপিং, ডিস্ট্রিবিউশন, মার্কেটিং পরিকল্পনার কাজও চলতে থাকে।
স্বরলিপি : আপনাদের ২৩ বছরের পথচলা। শিশুসাহিত্যে এই সময়ে কী ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন?
কামরুল হাসান শায়ক: শিশুকিশোর সাহিত্যে বিশাল বহুমাত্রিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। বর্তমান ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রবল বিকাশের প্রভাব, সাহিত্য সংস্কৃতির উপরও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করবে এটাই স্বাভাবিক। সাহিত্যে উত্তর আধুনিকতার যুগের প্রভাব যেমন বইয়ের কনটেন্টে পড়ছে, তেমনি বইয়ের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পড়ছে প্রযুক্তির নানামুখী প্রয়োগ। থ্রি-ডি বই, ডিজিটাল বই, কিউআর কোড ব্যবহার করে কনটেন্টের সঙ্গে স্থির ছবি বা অলঙ্করণের জায়গায় চলমান ছবি বা অলঙ্করণের ব্যবহার শুরু হয়েছে। শিশুকিশোর একটি ফিকশন বা ননফিকশন পাঠ করার পর তার মাথায় যত রকম সম্ভাব্য প্রশ্নের উদয় হতে পারে, সেসব কিছুর উত্তর একটি প্রেস বাটন চাপ দিয়ে পেয়ে যাচ্ছে। এরকম অনেক পরিবর্তন বর্তমান শিশুকিশোর সাহিত্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
স্বরলিপি : এখানে নতুন আরো কী ধরনের লেখা আসা উচিত বলে মনে করছেন?
কামরুল হাসান শায়ক : আজকাল অনেকেই ভূত-প্রেত ইত্যাদি নিয়ে লিখে জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। সত্যিকার অর্থে আমি মনে করি ভূত-প্রেতের মিথের প্রথাগত চর্চার বাইরে এসে এই মিথগুলোকে উত্তর আধুনিক নির্মাণ কৌশল ব্যবহার করে সায়েন্স ফিকশনের ধারায় আজকের প্রজন্মের চিন্তার উপযোগী করে যারা লিখছেন তারা ভালো করছেন। একইভাবে বলবো প্রথাগত লেখালেখির ধারা ভাঙ্গতে হবে। নতুন প্রজন্ম নতুন স্বরের লেখা চায়। যুগোপযোগী বিষয়বস্তুর লেখা চায়। তার মন ও মননশীলতার চাহিদা উপযোগী লেখা চায়।
স্বরলিপি : প্রকাশকেরা প্রায়ই যে কথাটি বলেন, বইয়ের বিক্রি কমে গেছে। সেদিক থেকে এখন শিশুসাহিত্যের চাহিদা কেমন?
কামরুল হাসান শায়ক: গত কয়েক বছর ধরে বইয়ের বাজারে চাহিদার দিক দিয়ে বিভিন্ন জনরার অবস্থা মোটামুটি স্থিতিশীল হলেও শিশুকিশোর সাহিত্যের বইয়ের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। আইপিএ-এর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্যান্ডামিকের গত তিন বছরে ৩-৯ বছরের শিশুরা বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে বাসায় বসে যে সময় অতিক্রম করেছিল, সেখানে বইয়ের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাবা-মা তাদের শিশুদের এই সময় বই পড়ার চর্চায় অনেক সময় ব্যয় করেছেন। ফলশ্রুতিতে প্রায় প্রতিবছর ক্রমবর্ধমান চাহিদার হার ১০ শতাংশ বৃদ্ধির জায়গায় তা ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ এই বইয়ের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এই তথ্য থেকে সহজেই বোঝা যায় বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের চাহিদার বর্তমান অবস্থা।
স্বরলিপি : তার মানে অভিভাবকরা শিশুদের বইপাঠে যথাযথ উদ্বুদ্ধ করতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে?
কামরুল হাসান শায়ক: আজকের শিশুকিশোর পাঠক কিন্তু অনেক স্মার্ট। তারা এখন শুধু বাবা-মার দ্বারাই উদ্বুদ্ধ হয় না, উদ্বুদ্ধ হয় ভার্চুয়াল দুনিয়ার বিভিন্ন তথ্যপ্রবাহের মাধ্যমেও। আগের মতো অভিভাবকদের ইচ্ছায়ও সব বই তারা কেনে না। অনেক বই নিজেই পছন্দ করে কিনে নেয়। আজকের বাবা-মাও তাদের পছন্দের স্বাধীনতাকে সম্মান করছে। এসব কিছুই ইতিবাচক।
স্বরলিপি: সাহিত্যের এই সেক্টর আরো এগিয়ে নিতে পাঞ্জেরীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
কামরুল হাসান শায়ক: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.-এর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে ভালো লেখা অন্বেষণ, প্রকাশনা সেক্টরের জন্য দক্ষ সৃজনশীল জনশক্তি তৈরি করা, বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর ইংরেজি অনুবাদের ক্ষেত্র তৈরি করা, পেশাদারিত্বেও সঙ্গে মানসম্পন্ন বইয়ের প্রকাশ নিশ্চিত করতে সমন্বিতভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বইয়ের বাজার সম্প্রসারিত করা, লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের মাঝে শক্তিশালী মেলবন্ধনের প্লাটফর্ম তৈরি করা।
স্বরলিপি : শিশুসাহিত্যের পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
কামরুল হাসান শায়ক : আগামীর পৃথিবী বইয়ের পৃথিবী। মেধাবীরাই নেতৃত্ব দেবে আগামী পৃথিবীর। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে আমাদের কাক্সিক্ষত সোনালি প্রজন্ম আজকের শিশুকিশোর। তাদের আগামী দিনের জয় নিশ্চিত করতে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই।