মোহাম্মদ শাহ আলম সিসেমি ওয়ার্কশপ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ‘সিসিমপুর’ এই প্রতিষ্ঠান থেকে নির্মিত একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি দেশের শিশুকিশোরদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত এবং জনপ্রিয়। প্রতিষ্ঠানটি সিসিমপুরের ব্যানারে শিশুকিশোরদের উপযোগী বই প্রকাশ করে। এবারের বইমেলার প্রস্তুতি, দেশে শিশুকিশোরদের উপযোগী বইয়ের সংকট এবং প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন মোহাম্মদ শাহ আলম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুজাহিদ বিল্লাহ।
একুশে গ্রন্থমেলা নিয়ে আপনাদের নানামুখী আয়োজন আমরা লক্ষ্য করেছি। এবারের বইমেলায় নতুন কী থাকছে?
শাহ আলম : বইমেলায় আমাদের দুটি জায়গা বরাদ্দ থাকে। একটা বুক স্টলের জন্য, আরেকটা ফ্রি স্টল। এবারও বইমেলায় সিসিমপুরের ব্যানারে আমাদের বই থাকবে। আরো অনেক নতুন বই এসেছে, সেগুলোও মেলায় পাওয়া যাবে। সিসিমপুরে সাধারণত ইকরির একটা বাড়ি আছে। আমরা বইমেলার স্টল ইকরির বাড়ির মতো করে ডিজাইন করি। যাতে ছেলেমেয়েরা সহজে বুঝতে পারে, এটা ইকরির বাড়ি। অর্থাৎ সিসিমপুর। দ্বিতীয় হলো, সিসিমপুরের একটা কর্নার আমরা তৈরি করি। সেখানে একটা স্টেজ থাকে সিসিমপুরের। এবারও আমরা সেটা করব। বাংলা একাডেমিকে আমরা অনুরোধ করেছি পরিসর একটু বড়ো করার জন্য। যেন অনেক শিশু এলে দাঁড়াতে পারে এবং জায়গা পায়।
আরেকটা বিষয় বলতে চাই, বইমেলায় আমাদের যে স্টল বা মঞ্চ থাকে, প্রতি শুক্রবার, শনিবার, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের ক্যারেক্টারগুলো সেখানে যাবে। প্রতিদিন তিনবার, সকাল ১২টায়, ৩টায় এবং ৬টায় তারা সেখানে পারফর্ম করবে এবং বাচ্চাদের আনন্দ দেবে। পারফর্মের উদ্দেশ্য হলো শিশুদের মেসেজ দেওয়াÑ বই পড়া আসলে কতটা জরুরি বিষয়। শুধু বই পড়া নয়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, হাত ধোয়া, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণসহ নানা বিষয় নিয়ে ক্যারেক্টারগুলো শিশুদের সঙ্গে কথা বলবে। এবার আমরা চিন্তা করেছি, যে জায়গাগুলো আছে সেখানে স্কুলগুলোকে একবার করে সুযোগ দেয়া যায় কিনা। আমরা অনেক স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা তাদের শিশুদের এনে এখানে পারফর্ম করাতে পারবে। শুক্র, শনিবার একটা সময় আমরা তাদের জায়গাগুলো দিতে চাই যেন তারা পারফর্ম করতে পারে।
অনেক লেখক আছেন যারা সিসিমপুর থেকে বই প্রকাশ করতে চান। তারা কীভাবে পাণ্ডুলিপি আপনাদের দিতে পারে বা পাণ্ডুলিপি বাছাই প্রক্রিয়াটাই-বা কী?
শাহ আলম : আমরা আসলে খুব লিমিটেড বই ছাপাই। বই ছাপার সঙ্গে আমাদের আসলে অনেক কিছু সম্পর্কিত। আমরা বই ছাপাই অনেক বিষয়কে উদ্দেশ্য করে। আমরা বই প্রকাশ করার আগে বইয়ের বিষয় ঠিক করে নেই। আমাদের সঙ্গে গত ১৫ বছর প্রচুর লেখক কাজ করেছেন। তাদের ডেটাবেজ আমাদের কাছে রয়েছে। আমরা বিষয়গুলো তাদের জানাই। তাদের বলি যে, আমরা এ বছর এ রকম বিষয় নিয়ে পাঁচটা বই ছাপাবো আপনারা লেখা জমা দেন। আমরা পাঁচজনের লেখা নেই এবং সম্পাদনা করি।
লেখক চাওয়ার যে বিষয়টা, এ জন্য আমরা বিজ্ঞাপন দেই। আমরা নতুন লেখকদের লেখার জন্য আহ্বান করি। তবে যারা লিখতে চান, আমরা যখন সার্কুলার দেব তখনই যোগাযোগ করতে হবে এমন নয়, এর আগেও যোগাযোগ করতে পারে। বইমেলাতেও প্রতিবছর আমাদের লোকজন থাকে, সেখানেও তারা কথা বলতে পারে। আমরা প্লে গ্রুপ থেকে ক্লাস ৩ পর্যন্ত- এই বয়সের বাচ্চাদের জন্য বই প্রকাশ করি।
অর্থাৎ আপনারা একটি লক্ষ্য নিয়ে বই প্রকাশ করেন। সেই লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যটা মূলত কী?
শাহ আলম: অনেক প্রকাশনারই লক্ষ্য থাকে প্রফিট করা। আমাদের সিসিমপুরে সেই লক্ষ্য নেই। আমাদের লক্ষ্য হলো, পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা। আমরা চাই শিশুরা আনন্দ নিয়ে বই পড়ুক। তারা জানতে জানতে বড় হোক। বই পড়া বিমুখ একটা প্রজন্ম বড় হচ্ছে এটা শঙ্কার বিষয়। সেই জায়গা থেকে আমাদের একটাই অবজেক্টিভ যে শিশুরা বই পড়ুক। তারা বই পড়ে বড় হোক। আমাদের স্লোগান হলো : ‘পড়ি বই জানতে জানতে বড় হই’।
আপনি বললেন, আপনারা একটি নির্দিষ্ট এজের শিশুদের জন্য বই প্রকাশ করেন। বিষয়টি যদি আরেকটু খোলাসা করে বলেন।
শাহ আলম: এটা একটা ইন্টারেস্টিং বিষয়। আমাদের সবসময় লক্ষ্য হলো তিন বছর থেকে আট বছর বয়সের শিশু। মানে প্লে গ্রুপ থেকে ক্লাস থ্রি। আমরা সাধারণত কনটেন্ট বানাই; সেটা স্টোরি হোক বা ভিডিও হোক। এবং সেগুলো অবশ্যই শিশুদেও উপযোগী করে। সেইসঙ্গে আরেকটা টার্গেট আপনাদের বলতে চাই যে, শিশুদের বাবা-মায়েরা। আমরা শিশুদের বাবা-মায়েদের কাছে এটা পৌঁছে দিতে চাই যে, তারা যেন ঘরে বসেই শিশুদের বিকাশে সহায়তা করতে পারে। আমাদের টেলিভিশনের বাইরেও স্কুল প্রোগ্রাম আছে। আমরা বিভিন্ন জেলায় কাজ করি। সেখানে যে স্কুল আছে স্কুলের টিচারদেও সঙ্গে কাজ করি, বাচ্চাদেও সঙ্গে কাজ করি, সেখানে অভিভাবকদের সঙ্গেও কাজ করি। বাবা-মায়েদের আমরা নানা সেশনে আহ্বান করি। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।
অন্যরকম একটা প্রশ্ন করতে চাই। আপনার বিবেচনায় দেশের শিশুসাহিত্যের বাজার কেমন?
শাহ আলম : যদি বাংলাদেশে শিশুসাহিত্যের বাজারের কথা বলি, দেশে প্রাইমারি স্কুলেই ছেলেমেয়ে আছে প্রায় ২ কোটি। সব প্রকাশক বই করে কিছু লক্ষ্য থেকে। তার অন্যতম হলো বইমেলায় বই বিক্রি। আমি অনেক লেখক চিনি যারা সত্যি খুব ভালো লেখেন। কিন্তু দেখা যায় যে তাদের বই ৩০-৪০ কপি বিক্রি হচ্ছে। এই যে ২ কোটি শিশু, এদের যদি বইমুখী করতে পারা যায়, তাহলে এটা বিশাল বাজার। এই বিশাল বাজারটা আমরা ধরতে পারছি না। আমি বলব এর দুটি কারণ। একটি হলো আমাদের অভিভাবকরা এখনো শিশুদের বই পড়ার গুরুত্ব বুঝতে চান না। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি গল্পের বই পড়া শিশুদের যে কল্পনা এবং শব্দের বিকাশসহ অনেক কিছু জানার ব্যাপারে কাজ করে তা তারা বুঝতে চান না। দ্বিতীয়ত আমরা শিশুদের কাছে বই পৌঁছে দিতে পারিনি।
আমি একটা বিষয় বলি, আমরা বিনামূল্যে ২৫০টি স্কুলে লাইব্রেরি করে দিয়েছি। সেখানে ৩০০ কপি করে বই দিয়েছি। লাইব্রেরি করে দেয়ার আগে আমরা স্কুলের বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম- তোমরা পাঠ্যবইয়ের বাইরে কখনো বই পড়েছ কিনা? অনেকেই ‘না’ বলেছে। এটা খুবই হতাশাজনক! ইউনিসেফ’র একটি গবেষণা আছে। সেখানে উঠে এসেছে পাঠ্যবইয়ের বাইরে তিনটি অন্য বই আছে এ রকম পরিবারের সংখ্যা খুবই নগণ্য। এটা একটা বড় সমস্যা।
আমরা এক বছর পর দেখলাম, যেখানে লাইব্রেরি করে দিয়েছিলাম সেখানে প্রায় গ্রেড টু’র শিশুরা ২৫ হাজার বার বই পড়েছে। এই রেকর্ডও কম। অনেক সময় রেকর্ড করাও হয় না। ফলে শিশুদের কাছে আগে বই নিয়ে যেতে হবে। আমরা মার্কেটিংটা করতে পারিনি। আমাদের শুধু বইমেলাতেই অনেক বড়ো করে স্টল হয়। এর বাইরে আমাদের কোনো মার্কেটিং নেই।
বিপরীতে এমন কথাও তো শোনা যায়, মার্কেটিং হচ্ছে না। কিন্তু ভালো সাহিত্যও তো খুব বেশি নেই।
শাহ আলম : বাংলাদেশে যারা প্রথম সারির লেখক আছেন, আই অ্যাম সরি টু সে- তারা ফাইভ সিক্স সেভেনের বাচ্চাদের জন্য বই লেখেন। তারা দাবি করেন যে, তারা শিশুদের জন্য বই লিখছেন। কিন্তু শিশুসাহিত্যের একটা সেকেন্ড পার্ট আছে। অর্থাৎ অল্পবয়সী বাচ্চাদের জন্য বই লেখা; যারা ক্লাস ওয়ানে পড়ে, প্লেতে পড়ে বা ক্লাস টুয়ে পড়ে। এখন প্রশ্ন হলো, সেইসব বড়ো বড়ো লেখক এই শিশুদের জন্য বই লিখছেন না কেন? এর পেছনে প্রথম ধারণা হলো- ওই শিশুরা তো বই পড়তে পারে না। যারা বই পড়তে পারে না তাদের জন্য কি বই বের করব? আমরা কিন্তু পিকটোরিয়াল বইয়ের ধারণাটা করতে পারিনি। আমরা বয়সকে প্রাধান্য দিয়েও বই লিখতে পারি। কিন্তু সেটা বৃহৎ পরিসরে হচ্ছে না।
দ্বিতীয়ত যেটা বলতে চাই, শিশুদের জন্য লিখতে গেলে যে মনস্তাত্ত্বিক ধারণাটা থাকা উচিত সেটা অনেক লেখকের ভেতরে অনুপস্থিত। ছোটদের জন্য লিখতে গেলে অনেকগুলো বিষয় মাথায় রাখতে হয়। শব্দভাণ্ডার, বই কতটা মোটা হবে, কত সংখ্যা হবে, শব্দ, বাক্য দৈর্ঘ্য কত হবে- এমন অনেক বিষয়ে আছে। আমি সত্যি কথা বলবো যে, আমাদের দেশে এখন অনেক লেখক তৈরি হয়েছে লেখার জন্য। কিন্তু অনেক লেখকই এটার জন্য তৈরি নয়।
এবার বুক প্রোডাকশনের দিকে আসি। আমি বলব যে, এটা সত্যিই আফসোসের বিষয়, আমাদের দেশের পাবলিশারদের মাথায় থাকে যে, আমাদের সস্তা বই বানাতে হবে। এ কারণে কাভার অনেক সময়ই সুন্দর হয় না। বইয়ের ভেতরের ইলাস্ট্রেশন সুন্দর হয় না। একটা পেজের তো ডিস্ট্রিবিউশন থাকে যে, লেখাটা কোথায় বসলে ভালো দেখাবে, ছবি পাতার কতটুকু জুড়ে থাকবে। এসব আসলে ভাবা হয় না। এ কারণে আমাদের বইগুলোর মধ্যে শিশুতোষ বিষয়টি অনুপস্থিত থাকে। আপনি দেখবেন যে, বইয়ের যে কর্নার এগুলো অনেক শার্প থাকে। শিশুদের জন্য বই করতে গেলে বইগুলো নিরাপদ করা দরকার। কোয়ালিটির মধ্যে আরেকটা জিনিস হলো বইয়ের বাঁধাই। পিন বাইন্ডিং হলে অনেক শিশুর নখ ঢুকে যায় বা আঙুলে ঢুকে যায়। এসব বিষয়েও সচেতন হতে হবে।
আমাদের নিরাপদ বই বের করতে হবে। এবং বইয়ের প্রচ্ছদ, অলঙ্করণ দুটোই সুন্দর হতে হবে। ছোটোদের সাহিত্যে লেখকের পাশাপাশি আঁকিয়ের সমান ভূমিকা রয়েছে। দুজনকেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে। এই জায়গাগুলোর কিন্তু অনুপস্থিতি রয়েছে। এই জায়গাগুলো আমরা সেভাবে তৈরি করতে পারিনি। আমরা দিন শেষে একটা বই তৈরি করতে চাই, বইগুলো মেলায় নিয়ে আসি। কিন্তু এই বইয়ের পিছনে অনেক ভাবনা দরকার সেই ভাবনাটা আমরা দিতে পারি না। আমি যেরকম করে চিন্তা করি আমার বই নিয়ে, বইটি সেরকম করে ছাপা হয় না। সেরকম প্রোডাকশন হয় না। এর পিছনে কারণ ওই একটাই- কম পয়সার বই ছাপাতে চাই আমরা। এবং এটাও সত্য আমাদের দেশের মানুষ কম পয়সায় বই কিনতে চায়।