ফরিদ আহমেদ। সময় প্রকাশনের কর্ণধার। ভ্রমণ শখ হলেও, বইয়ের সঙ্গে তাঁর সখ্য পুরনো। একসময় নিজে লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এরপর প্রকাশনাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সৃজনশীল এবং মননশীল বই প্রকাশ করে সুনাম কুড়িয়েছে সময় প্রকাশন। একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে এবারও পঞ্চাশের অধিক বই প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ফরিদ আহমেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুজাহিদ বিল্লাহ
সময় প্রকাশনের শুরুর গল্পটা শুনতে চাই।
আমি নিজে লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিলাম এটা একটা ব্যাপার। দুই নম্বর হচ্ছে, আমি সাহিত্য পত্রিকা বের করতাম। পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন শামসুর রাহমান। পত্রিকার ব্যয় নির্বাহ করা ছিল খুব কঠিন ব্যাপার। সময়টা ১৯৮৭-১৯৮৮ এর দিকে। তখন আমি শামসুর রাহমানের পরামর্শে প্রকাশনা জগতে আসি। তিনি বললেন যে, পাবলিকেশন্স থেকে সাহিত্য পত্রিকার ব্যয়টা নির্বাহ করা যাবে। সেভাবেই আসা। তারপর এক সময় এটাকেই পেশা করে নেওয়া।
দীর্ঘ সময়ের পথচলার অভিজ্ঞতা। এই জার্নিতে কী ধরনের পরিবর্তন চোখে পড়েছে?
অনেক পরিবর্তন। আসলে পরিবর্তন নয়, বিবর্তন হয়েছে অনেক। প্রকাশনা বাংলাদেশে যখন শুরু হয়েছিল তখন কিন্তু এটা খুব ম্যানুয়ালি করা হতো। আমাদের প্রকাশনা চলছিল অনেক পুরনো পদ্ধতিতে। আমি যখন জয়েন করি তখনো এ রকমই ছিল। এখন তো প্রযুক্তির কারণে অনেক কিছু নতুন এসেছে। পরিবর্তন হতে হতে এমন একটা পর্যায়ে এসেছে যে, আমরা মোটামুটিভাবে পৃথিবীর আধুনিক প্রযুক্তিগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে শুরু করেছি। তো তারই ছোঁয়া এখানেও লেগেছে। প্রকাশনায় মুদ্রণ একটা বড়ো ব্যাপার। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মুদ্রণেও আমরা ভালো করছি। এটাকে আপনি মোটামুটি বিশ্বমানের বলতে পারেন।
মুদ্রণে বিশ্বমানের কথা বললেন। প্রকাশনার মানও কি একইতালে এগিয়েছে?
প্রকাশনার মান হচ্ছে দুই দিক দিয়ে। এখানে শিল্প সাহিত্যের ব্যাপার রয়েছে এবং প্রোডাকশনের ব্যাপার রয়েছে। প্রোডাকশনের দিক থেকে আমি যেটা বলবো যে, মান অনেক ভালো হয়েছে। মোটামুটিভাবে এটাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বলা যেতে পারে। কিন্তু সাহিত্য মান ডিপেন্ড করছে লেখকদের উপর। লেখক তাঁর লেখা যে মানে উন্নীত করতে পারবে, সাহিত্য আসলে সে মানটাতেই যাবে। আমাদের সাহিত্যে এখন যে মান রয়েছে তাকে যদি আন্তর্জাতিক মানের ধরা যায় তাহলে এটা আন্তর্জাতিক মান, যদি এটাকে আন্তর্জাতিক মান ধরা না হয় তাহলে এটা আন্তর্জাতিক মান নয়। সাহিত্যের মান উন্নত করার যে এক্সপার্টিজম সেটা আসলে প্রকাশকের নয়, এটা লেখকের ওপর নির্ভর করে।
এখানে প্রকাশক কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন কিনা?
প্রকাশকদের যে ভূমিকা হতে পারে সেটা আসলে খুব সুখকর হবে না। প্রকাশকরা যেটা করতে পারে, মানসম্পন্ন বই না হলে আমি প্রকাশ করব না। এই কাজটি খুব কঠিন এবং প্রায় অসম্ভব। এই কাজটি করেই যে মানসম্পন্ন না হওয়া বইগুলোকে আটকানো যাবে তা কিন্তু নয়। কারণ বাংলাদেশের প্রকাশনা এ পর্যায়ে চলে গেছে যে, একজন মানুষ যখনই মনে করে যে, আমি একটা লেখা লিখেছি ফলে আমি লেখক। সে তার লেখা প্রকাশ করতে পারে। একজন দুইজন লোক যদি বলে যে, আমি মানহীন বই বের করব না, তাতে কিন্তু প্রকাশনার উন্নতি খুব একটা হবে না। বাংলাদেশের প্রকাশনার মান উন্নত করার জন্য সচেতন লেখক দরকার। আরেকটা হচ্ছে, লেখকদের অনেক লেখাপড়া করা দরকার। না পড়ে, না জেনে বই লিখে ফেলবো এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর প্রকাশকদের বই প্রকাশের ব্যাপারে একটু লাগাম টানতে হবে।
বাংলা বই বিশ্বে কেন ছড়িয়ে পড়ছে না বলে আপনি মনে করেন? সেক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী?
আমাদের বই বিশ্বে না ছড়ানোর মূল বিষয়টাই হচ্ছে ভাষা। আমাদের বই হয় সব বাংলা ভাষায়। বাংলা ভাষা যে বিশ্বে খুব পরিচিত তা নয়। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশে বাঙালি রয়েছে প্রচুর। এখন আপনি যদি ভাষা না বোঝেন তাহলে বই কিনবেন কেন? আমাদের অনেক লেখক মনে করেন, একটা ইংরেজিতে বই বের করলেই তো হয়। ইংরেজিতে বই প্রকাশ করলেই যে ইংরেজি ভাষাভাষী বা অন্যরা বইটা পড়বে ধারণাটা ঠিক নয়। শুধু বিদেশি ভাষায় বই বের করলে হবে না, বিদেশি ভাষায় সেই জায়গা থেকে বইটা বের করা দরকার। তাহলেই স্থানীয় লোকজনের কাছে বইটি পরিচিত হবে। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, আপনার জন্য একটা পরিচিত গন্ডি লাগবে। পরিচিত গন্ডি ছাড়া একটা বই বের করেই খুব একটা তাদের কাছে যাওয়া যাবে না। আমি ইংরেজি ভাষায় বই বের করলাম, এরপর আমি চেষ্টা করলাম এখান থেকে বইটা বাইরে নিতে, কিন্তু ইংরেজি ভাষার পাঠক বা ব্রিটিশ পাঠক কি বইটি পড়বে? হয়তো বাঙালি যারা আছে তারা পড়তে পারে।
সময় প্রকাশন পাঠকের কাছে পরিচিত নাম। কোন ধরনের পাঠককে লক্ষ্য করে আপনারা বই প্রকাশ করেন?
আমাদের পাঠক বাংলাদেশের সবাই। তারপরও যদি আপনি বিশেষ বলেন, আমি বলব, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের যারা পাঠক তাদের জন্য বই বের করি বেশি। কিশোর পাঠকদের জন্যও বই বের করি। যদি আপনি আমাকে ভাগ করতে বলেন তাহলে আমি এটুকুই ভাগ করতে পারবো। মুক্তিযুদ্ধের উপরে আমাদেও প্রচুর বই রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ একটি ব্যাপক এবং বিস্তৃত বিষয়। আমি মনে করি এর উপর আরো অনেক বই দরকার। মুক্তিযুদ্ধের উপর যে বই আছে সেসব ভেবে আত্মতৃপ্তিতে ভোগা খুব একটা ভালো কাজ হবে না। এ ব্যাপারে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের উপর আরো অনেক বই প্রকাশ করতে হবে। শুধু ইতিহাসভিত্তিক বই নয়, আমাদের বের করতে হবে একদম ফিল্ড বা যুদ্ধক্ষেত্রভিত্তিক বই। এসব আমরা যে একেবারে করছি না তা নয়। এসব বইও আছে কিন্তু এর কোনো শেষ নেই। আরো করা প্রয়োজন।
কিশোরদের জন্যও আপনারা বই প্রকাশ করছেন। দেশে শিশুসাহিত্যের মান কেমন বলে আপনি মনে করেন?
শিশুসাহিত্য আলাদা কিছু নয়- শিশুদের উপযোগী করে লেখা। যে রকম আমরা কিশোর সাহিত্যকে ‘শিশুসাহিত্য’ বলছি। প্রায় গল্পতুল্য লেখাগুলোকে আমরা উপন্যাস বলছি। অর্থাৎ কমতিটা সব দিকেই আছে। এ জন্য লেখক, প্রকাশক সবাইকেই দায় নিতে হবে। শিশুসাহিত্যের সবচেয়ে বড়ো ক্রাইটেরিয়া যেটা- দৃষ্টিনন্দন বই করতে হবে। অলঙ্করণসমৃদ্ধ, কালারফুল। এতে শিশুরা বই পড়তে এবং বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হবে। এই বই করার জন্য যে মৌলিক চাহিদা, সেটার ক্ষেত্রে আমাদের কমতি আছে। আগে আমাদের আর্টিস্ট ছিলেন না, এখন আর্টিস্ট সংকট অনেকটা কমেছে। আমাদের আর্টিস্টরা বাণিজ্যিক কাজ করে যে অর্থ উপার্জন কওে, সেটা আসলে বুক ইলাস্ট্রেশন করে সম্ভব না। অথচ তাদের আশাটা এ রকমই থাকে। ফলে অনেক প্রকাশক সে রকম ইলাস্ট্রেশন করতে পারে না। আমাদের মানসিকতাতেও সমস্যা আছে। সেসব যদি আমরা ওভারকাম করতে পারি তাহলে আমরা ভালো শিশুসাহিত্য করতে পারব।
আপনি সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতির নেতৃত্বে ছিলেন। প্রকাশকরা কেমন বইমেলা প্রত্যাশা করে?
এক কথায় আমরা বইবান্ধব বইমেলা চাই। বর্তমানে যেটা চলছে, সেটা বাণিজ্যিক। এখানে বেশিরভাগ প্রকাশক যেহেতু বাণিজ্যিক ব্যক্তি, অনেকেই হয়তো বাণিজ্যসফল বইমেলা চাইবে। কিন্তু আমি মনে করি, মেলা হওয়া উচিত বইবান্ধব, প্রকাশকবান্ধব।
বইমেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি। প্রকাশকরা অনেকেই বইমেলা করতে চান। কিন্তু সেটা কেন সম্ভব হচ্ছে না বলে আপনি মনে করেন?
প্রকাশকরা বইমেলা করবে এটা তাদের ইচ্ছা। তারা অনেকবার প্রপোজাল বিভিন্ন পর্যায়ে দিয়েছে। কিন্তু এখানে একটা বেসিক প্রবলেম আছে। সরকার মনে করে কিনা আমি জানি না, কিন্তু বাংলা একাডেমি মনে করে একুশে বইমেলা তারা করবে। কারণ ভাষা আন্দোলনের সাথে তাদের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। তারা ভাষা আন্দোলন নিয়ে মাসব্যাপী অনুষ্ঠান করবে এবং এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে বইমেলা সংযুক্ত। এখন বাংলা একাডেমি যদি একটা বইমেলা করে, প্রকাশকরা যদি আরেকটা করে তাহলে বইমেলা দুটো হয়ে যাবে। একুশে বইমেলা একাধিক হোক এটা প্রকাশকরা চায় না। একুশে বইমেলা অনেক মর্যাদাপূর্ণ গম্ভীর এবং চেতনা থেকে সৃষ্টি। এ ক্ষেত্রে কোনো রকমের বিতর্ক আসুক, বিভাজন আসুক এটা আমিও চাই না। এবং এ বিষয়ে আমি সচেতন।