লুৎফর রহমান রিটন। এ সময়ের অন্যতম প্রধান ছড়াকার। কৈশোরে ওয়ারির আকাশে ভোঁকাট্টা ঘুড়ির পেছনে ছুটতে গিয়ে সুদর্শন মধ্যবয়স্ক একজন খপ করে হাত ধরে থামিয়েছিলেন। লোকটি রোকনুজ্জামান খান। সেদিন তিনিই জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে লুৎফর রহমান রিটনের প্রায় ৫০ বছরের ছড়াযাত্রা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাপস রায়
পুরনো ঢাকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে আপনার বেড়ে ওঠা। ছড়ায় এর প্রভাব পড়েছে কি না?
প্রভাব অবশ্যই পড়েছে। নানাভাবে পড়েছে। পুরনো ঢাকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অপরূপ সৌন্দর্য আমি ধারণ করি আমার প্রাত্যহিক যাপিত জীবনের প্রায় প্রতিটি অনুষঙ্গে। আমার চেতনায় প্রবহমান বাংলা ও বাঙালির চিরকালীন ভ্যালুজের সঙ্গে পুরনো ঢাকার সাংস্কৃতিক ভ্যালুজসমূহের অপরূপ মিথস্ক্রিয়া ঘটেছে। যে কারণে পুরনো ঢাকার নান্দনিক অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটি আমার ব্যক্তিজীবন ও লেখকসত্তায় জারিত। আমার ছড়ায় পুরনো ঢাকার ঈদ যেমন আছে, তেমনি আছে দুর্গাপূজাও। শারদীয়া ঢাকের বাদ্যির রিদমিক ছন্দের ধুঞ্চিনাচ বা আরতিনৃত্যের পাশাপাশি শবে বরাতের হালুয়া এবং তারাবাতি উৎসবের ঝিলিকও দৃশ্যমান আমার ছড়ায়। আমার লেখা ঢাকাইয়া ছড়াগুলোও পুরনো ঢাকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করেছে অকৃপণভাবে।
ছড়া এবং কিশোর কবিতার পার্থক্য তৈরি হয় কীভাবে?
এ কথাটি বলার আগে জানতে বা বুঝতে হবে- কবিতারই আরেকটি রূপ হচ্ছে ছড়া। তাছাড়া ‘কিশোর কবিতা’ বলে আলাদা কোনো কবিতা কি আছে? কবিতা আখেরে সে তো কবিতাই। ছোটোদের কবিতা বা বড়োদের কবিতা বলা যেতে পারে বড়জোর। তবে এ প্রশ্নের উত্তর মোটাদাগে দিতে চাইলে বলতে হয়, ছড়া এবং কবিতার পার্থক্য তার শারীরিক অবয়বে। ছন্দের ঝংকারে। চিত্রের চমৎকারিত্বে। সতঃস্ফূর্ততায় এবং উপস্থাপনার অভিনবত্বে। আপাতঃ অর্থহীনতার মোড়কে বা আড়ালে অর্থের প্রবল উপস্থিতি ঘটাতে ছড়ার পারঙ্গমতা বিস্ময়কর।
স্বাধীন বাংলাদেশে ছড়াসাহিত্যের সোনালি সময় কি আমরা অতিক্রম করে ফেলেছি? আপনার ভাবনা জানতে চাচ্ছি।
না। স্বাধীন বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যের সোনালি সময় এখনো অতিক্রান্ত নয়। বরং প্রবহমান প্রবলভাবে। ছড়াসাহিত্যের সোনালি সময়টাকে আরো বেশি স্বর্ণালি করতে প্রচুর মেধাবী তরুণের আবির্ভাব ঘটেছে। তারা এসেছেন ঝাঁকে ঝাঁকে। তাদের মেধার দীপ্তিতে আরো বেগবান হয়েছে ছড়াসাহিত্য। নিত্যনতুন সোনালি ফসলে ভরে উঠেছে, ভরে উঠছে আমাদের ছড়াসাহিত্যের মণিমানিক্যের ভা-ার। আমি খুব আশাবাদী মানুষ। আমার শিক্ষকবন্ধু আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের খুব বিখ্যাত একটি উক্তিÑ ‘মানুষ তার আশার সমান বড়ো’। আমাদের ছড়াসাহিত্য নিয়ে আমার ভাবনার উচ্চতাও আমার আশার সমান।
অনেকে মনে করেন ছড়া মানেই ছন্দ। বাংলা ছড়া সাহিত্যে ‘ছন্দ নিরীক্ষা’র পর্যায়ক্রমিক ইতিহাসটা কেমন বলে মনে হয়?
ছড়া মানেই ছন্দ নয়, আবার ছন্দ মানেও ছড়া নয়। ছন্দ একটি প্রধান ইনগ্রিডিয়েন্টস ছড়ার। ছন্দ ছাড়া ছড়া হবে না। মিল ছাড়া হতে পারে। কিন্তু ছন্দ ছাড়া? কক্ষণো নয়। দেখুন, নিরীক্ষা একটা চলমান প্রক্রিয়া। বাংলা ছড়াসাহিত্যে ‘ছন্দ নিরীক্ষা’ কালে-কালে, যুগে-যুগে হয়ে এসেছে। নিরীক্ষার এই পর্যায়ক্রমিক ধারাবাহিক ইতিহাস খুবই ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে আমার কাছে। বাংলা ছড়ার ছন্দ নিরীক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন বা আছেন এমন সব ছড়াকার যাঁরা এমনকি অক্ষরজ্ঞানসম্পন্নও ছিলেন না। প্রাচীন কালে ছড়া রচিত হতো মুখে-মুখে। তারপর তা ছড়িয়ে পড়তো মুখে-মুখেই। ওরাল সাহিত্য হিশেবে একেকটা ছড়া টিকে ছিল, টিকে থাকত। ছড়াগুলোর রচয়িতার নামটা যেত হারিয়ে। লিখতে পড়তে না-জানা, অক্ষরজ্ঞান না-থাকা সেইসব ছড়াশিল্পীদের অসামান্য কাজগুলোকে অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন ‘অশিক্ষিতের পটুত্ব’। পরবর্তীতে লিখতে পড়তে জানা শিক্ষিতরা এই শিল্পে যুক্ত হয়েছেন। এবং বাংলা ছড়ার ‘ছন্দ নিরীক্ষা’য় যুক্ত হয়েছে ‘শিক্ষিতের পটুত্ব’। এভাবেই ছন্দ নিরীক্ষার এই পর্যায়ক্রমিক ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন এমনকি সাম্প্রতিককালে ছড়া লিখতে আসা তরুণতম মেধাবী ছড়াকার বন্ধুটিও।
বিষয় বৈচিত্র ছড়ার একটি বড় উপাদান। লেখার সময় আপনি বিষয়টি আলাদা করে ভাবেন কি না?
অতি অবশ্যই। না-ভাবলে তো ‘ঝাঁকের কৈ’ হিশেবেই থাকতে হবে। বিষয় বৈচিত্র বা আলাদা কোনো দ্যুতি না-থাকাকে আমি ঝাঁকের কৈ বলছি। লেখার সময় প্রতি মুহূর্তে আমাকে ভাবতে হয় বিষয় বৈচিত্র নিয়ে। আলাদা করে না-ভাবলে ছড়াটাও আলাদা হবে না। নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে ইতোমধ্যে যে ছড়াটা আরো দশজনে লিখে ফেলেছে অলরেডি, সেই ছড়াটা আবার আমি লিখে এগারোতম হতে পারবো বড়জোর। এর বেশি না। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বিষয় বৈচিত্র নিয়ে আলাদা করে ভাবতেই হবে। ভাবতে হয়। আমিও ভাবি প্রতিনিয়ত।
ছড়াকে আমরা রাজপথে, রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেও দেখেছি। এখন তেমনটা দেখা যায় না কেন?
সেই প্রাচীনকাল থেকেই, ছড়াকাররা সময়ের সাহসী সন্তান ছিলেন। এখনও। লক্ষ্য করবেন, প্রাত্যহিক জীবনে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক দুর্যোগ-দুঃসময়ে প্রতিবাদী চরিত্রে ছড়াকে আমরা দেখেছি রাজপথে। দুঃসাহসী ছড়াকারের ছড়াটি অব্যর্থ রাজনৈতিক হাতিয়ার হতেও দেখেছি বহুবার। স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে দেখেছি সবচে বেশি। এখন তেমনটা দেখা যায় না কারণÑ অতীতে দেশের দুর্যোগে-দুঃসময়ে এক কথায় দেশের ক্রান্তিকালে প্রতিবাদের সবক’টা মঞ্চে বা মিছিলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক ও বিশাল। এখন মধ্যবিত্তের চরিত্র ও চারিত্র্য পালটে গেছে। মধ্যবিত্ত ছড়াকারের লেখা ছড়াও তাই শক্তিশালী রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠে না।