আইন ও অপরাধ

৬ বছরেও শেষ হয়নি তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলার বিচার

পবিত্র আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর গভীর রাতে পুরনো ঢাকার হোসনি দালানে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচার শেষ হয়নি ৬ বছরেও ।   ওইদিন রাত দুইটার দিকে জেএমবির এই বোমা হামলায় দুজন নিহত ও শতাধিক আহত হন। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচার আইনি জটিলতার কারণে বিলম্বিত হয়। এরপর শুরু হয় আবার বিচার কাজ। কিন্তু করোনার কারণে আদালতে বন্ধ থাকায় তা আবার থেমে যায়। সম্প্রতি আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সাক্ষী হাজির করে মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার আশা রাষ্ট্রপক্ষের।

আসামিপক্ষও চাইছে, মামলাটির বিচার যেন দ্রুত শেষ হয়।

মামলাটিতে ২০১৭ সালের ৩১ মে ১০ জঙ্গির বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। চার্জগঠনের পর গত চার বছরের অধিক সময়ে ৪৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।

ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমানের আদালতে মামলাটি বিচারাধীন। সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে থাকা এ মামলায় সর্বশেষ গত ৪ এপ্রিল সাক্ষ্য গ্রহণ হয়। আগামি ১৪ সেপ্টেম্বর মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য রয়েছে।

মামলাটি সম্পর্কে সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গোলাম সারোয়ার জাকির বলেন, ‘মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে। দুই আসামি নাবালক হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশিট দেওয়া হয়। বিচারের জন্য সম্পূরক চার্জশিট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। এ কারণে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ ছিল। এর মাঝে আবার কারোনার কারণে দু‘দফা আদালত সাধারণ ছুটিতে থাকায় বিচার কার্যক্রম হয়নি।  বর্তমানে আদালতের কার্যক্রম আবার শুরু হয়েছে। এখন থেকে সাক্ষী নিয়মিত আদালতে হাজির করে যত দ্রুত সম্ভব মামলাটির বিচার শেষ করার চেষ্টা করবো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে আশা করছি এবছরই মামলাটির বিচার শেষ হবে। আর আসামিদের যেন সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত হয় সে লক্ষ্যে কাজ করে যাবো।’

আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মেদ বলেন, ‘এ পর্যন্ত যতজন  সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছে তারা কেউ আসামিদের নাম বলেননি। ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৬১ ধারায়ও সাক্ষীরা আসামিদের নাম বলেননি, এজন্য তাদের জেরাও করা লাগেনি। তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা হয়েছে এটা সত্য ঘটনা। তবে যাদের আসামি করা হয়েছে তারা এ ঘটনার সাথে জড়িত নয়।’

তিনি বলেন, ‘এ মামলার বিচার যত দ্রুত হবে আসামিদের জন্য ততই ভালো। কারণ বিচার হলে আসামিরা খালাস পাবো। কিন্তু সরকার পক্ষে ইচ্ছাকৃতভাবে মামলাটি বিলম্বিত করছে, আসামিদের জেল হাজতে আটকিয়ে রাখার জন্য। কয়েকজন আসামি মামলায় জামিন পেয়েছে। আর কয়েকজন কারাগারে আটকে আছে।’

প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর রাতে হোসনি দালান এলাকায় তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গিরা বোমা হামলা চালায়। এতে দুজন নিহত ও শতাধিক আহত হন। এ ঘটনায় রাজধানীর চকবাজার থানায় এসআই জালাল উদ্দিন বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। প্রথমে মামলাটি চকবাজার থানা পুলিশ তদন্ত করে।  পরে এর তদন্তভার ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়।

বাংলাদেশে এর আগে তাজিয়া মিছিলে কখনো বোমা হামলা হয়নি। হামলার পর আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) হামলার দায় স্বীকার করে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, ওই ঘটনায় আইএসের কোনো যোগসূত্র নেই। তদন্ত শেষে ডিবি দক্ষিণের পুলিশ পরিদর্শক মো. শফিউদ্দিন শেখ ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে ১০ জঙ্গিকে আসামি করে চার্জশিট অনুমোদনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠান। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর ওই বছরের অক্টোবরে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়।

২০১৭ সালের ৩১ মে ১০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এরপর মামলাটি ঢাকার অষ্টম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বদলি করা হয়। ওই আদালতে মামলার বাদী মো. জালাল উদ্দিন সাক্ষ্য দেন।

এরপর ২০১৮ সালের ১৪ মে মামলাটি সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বদলি হয়।  মামলাটি বদলি হওয়ার পর থেকে গতি পায়।  ট্রাইব্যুনালে আসার পর ১০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। এরই মাঝে চার্জশিটভূক্ত ১০ আসামির মধ্যে জাহিদ হাসানের পক্ষে তার আইনজীবী আদালতে দাবি করেন ওই আসামি নাবালক। এর স্বপক্ষে জন্মসনদ, পরীক্ষার সনদ জমা দেওয়া হয় ট্রাইব্যুনালে। আদালত সব কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ওই আসামিকে শিশু হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

আইন অনুযায়ী, ওই আসামিকে শিশু হিসেবে আখ্যায়িত করে সম্পূরক চার্জশিট দিতে বলেন। তদন্ত কর্মকর্তা সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন।  এরপর মাসুদ রানা নামে আরেক আসামিকে শিশু দাবি করেন তার আইনজীবী। পরে মাসুদ রানাকেও শিশু হিসেবে আখ্যায়িত করে আরেকটি সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

জানা গেছে, ওই হামলায় ১৩ জঙ্গি জড়িত ছিল। এদের মধ্যে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অভিযানের সময় তিন জঙ্গি ক্রসফায়ারে মারা যায়। চার্জশিটভূক্ত আসামিরা সবাই জেএমবির সদস্য। আসামিরা হলেন- ওমর ফারুক মানিক, হাফেজ আহসান উল্লাহ মাহমুদ, শাহজালাল মিয়া, চান মিয়া, কবির হোসাইন ওরফে রাশেদ ওরফে আশিক, আরমান ওরফে মাসুদ রানা মাসুদ ওরফে সুমন, রুবেল ইসলাম ওরফে সজীব, আবু সাঈদ রাসেল ওরফে সোলায়মান ওরফে সালমান ওরফে সায়মন, আরমান ওরফে মনির, জাহিদ হাসান ওরফে রানা ওরফে মুসায়াব ও রুবেল ইসলাম ওরফে সজীব ওরফে সুমন।

আসামিদের মধ্যে আরমান, রুবেল ও কবির আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী শাহাদাৎ ওরফে আলবানি ওরফে মাহফুজ ওরফে হোজ্জা ২০১৫ সালের ২৫ নভেম্বর রাজধানীর গাবতলীতে ‘বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয়। পরের বছর ২০১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি রাজধানীর হাজারীবাগে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় অপর দুই জেএমবি কমান্ডার আবদুল বাকি ওরফে আলাউদ্দিন ওরফে নোমান ও সাঈদ ওরফে হিরণ ওরফে কামাল।