নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রধান নাথান বম। জঙ্গি সংগঠনটির বিরুদ্ধে যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান শুরু হয়, তখন এ প্রস্তাব দেওয়া হয়। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট পাহাড়ে ওই নতুন জঙ্গি সংগঠনটিকে আশ্রয় দিয়েছিল।
শনিবার (২৪ জুন) দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
তিনি বলেন, শুক্রবার (২৩ জুন) রাতে রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রধান শামিন মাহফুজ ও তার স্ত্রী নাজনীনকে গ্রেপ্তার করেছে সিটিটিসি। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি পিস্তল ও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য জব্দ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও মূল ব্যক্তি শামিন মাহফুজকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। এর মাধ্যমে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হবে।
সিটিটিসির প্রধান বলেন, শামিন মাহফুজ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এসএসসিতে রাজশাহী বোর্ডে পঞ্চম স্থান অর্জন করেন। রংপুর ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বিষয়টি কলেজ কর্তৃপক্ষের নজরে এলে তাকে ক্যাডেট কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। অন্য কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে রাজশাহী বোর্ডে সপ্তম স্থান অর্জন করেন শামিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বড় ভাইয়ের ছেলের মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সংগঠনটি পরে আনসার আল ইসলাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০০৭ সালে শামিন মাহফুজ সংগঠনটির আধ্যাত্মিক নেতা জসীম উদ্দিন রহমানীসহ শীর্ষ নেতৃত্বের সংস্পর্শে আসেন। সে সময় আরেক বিদেশি বাংলাদেশের জঙ্গিবাদে আভির্ভূত হন বলে জানা গিয়েছিল। কিন্তু, সে ব্যক্তির বিষয়ে আমরা স্পষ্ট নই। সেই ব্যক্তির বিষয়ে আমরা শামিন মাহফুজের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করব। ঢাবিতে পড়াকালে শামিন মাহফুজ পাহাড়ে ক্যাম্প করার পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী তিনি পাহাড়ে যান। ঢাবি থেকে পাস করে তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এর মধ্যেই তার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিতে এনরোলমেন্ট হয়। তার গবেষণার বিষয় ছিল পাহাড়ের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। ইচ্ছা করেই তিনি এই বিষয়টি বেছে নেন, যাতে তিনি পাহাড়ে যেতে পারেন এবং সেখানে নিরাপদ আস্তানা তৈরি করতে পারেন। শামিন মাহফুজকে ২০১১ সালে গ্রেপ্তার করেছিল বিজিবি। জেল থেকে বেরিয়ে একই কার্যক্রম অব্যহত রাখেন তিনি। ২০১৪ সালে গোয়েন্দা পুলিশ তাকে আবার গ্রেপ্তার করে। এরপর কাশিমপুর কারাগারে থাকাকালে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের পরিকল্পনা হয়। কারাগারে থাকা অবস্থায় আটক হুজি এবং জেএমবির শীর্ষ নেতা সাইদুর রহমান, মুফতি হান্নান, আবু সাঈদের সংস্পর্শে আসেন শামিন। তখন রক্সিও জেলখানায় ছিলেন।
সে সময় জঙ্গি নেতারা জানতেন, শামিন মাহফুজ এবং রক্সি আগেই জেল থেকে বের হবেন। তাই, তাদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয় নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরির। ২০১৭ সালে রক্সি এবং ২০১৮ সালে শামিন মাহফুজ জেল থেকে জামিনে ছাড়া পান। এরপর থেকে তারা সদস্য সংগ্রহ শুরু করেন। কিন্তু, তখন সংগঠনের নামকরণ হয়নি। তবে, তারা একটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করতে থাকেন। রক্সি দাওয়াতি কার্যক্রম এবং শামিন মাহফুজ পাহাড়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করেন। ২০১৯ সালে রক্সিকে সংগঠনের আমির হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
সিটিটিসির প্রধান আরও বলেন, ঢাবিতে পড়ার সময় থেকেই শামিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কুকি চিনের প্রধান নাথান বম। শামিন উদ্দেশ্যমূলকভাবেই নাথান বমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেন। তখনই নাথান বমের সঙ্গে পাহাড়ে বেড়াতে গেছেন শামিন। ২০১৯ সালে নাথান বমকে জঙ্গি সংগঠন তৈরির কথাটি জানান শামিন এবং সশস্ত্র জিহাদের প্রস্তুতির জন্য তাকে ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপনের প্রস্তাব দেন। ২০২০ সালে কক্সবাজারের একটি হোটেলে কুকি চিন ও নতুন জঙ্গি সংগঠন শারক্বীয়ার মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। আমরা শামিনের কাছ থেকে হাতে লেখা দুই পৃষ্ঠার সমঝোতা স্মারকটি উদ্ধার করতে পেরেছি। সেখানে কুকি চিন কর্তৃক জঙ্গি সংগঠনটিকে সহযোগিতার বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ ছিল। তখন থেকেই কুকি চিনের আওতায় তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়।
তিনি বলেন, ২০২১ সালে সিলেট থেকে ছয় তরুণ নিখোঁজ হন। এপ্রিলে প্রথম ১২ জন নিয়ে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। কুকি চিনের ক্যাম্পের পাশেই কেডিসি ক্যাম্প নামে ক্যাম্পটি পরিচালিত হয়। তখনই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে বসে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে সংগঠনটি। ২০২২ সালের শুরুর দিকে ৩০ জনের বেশি তরুণ নিখোঁজ হন। তখনই আমরা এ সংগঠনের তৎপরতার বিষয়ে অবগত হই।
রক্সি গ্রেপ্তার হওয়ার পর তমালকে আমির হিসেবে নিয়োগ দেন শামিন। ২০২২ সালে শুরা কমিটি গঠন করে বিভিন্ন জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমরা শামিনের মোবাইল ফোন থেকে একটি অডিও রেকর্ড উদ্ধার করেছি। সেখানে শুরা কমিটির সঙ্গে নাথান বমও কানেক্টেড ছিল। অভিযানের শুরুর দিকে শামিন মাহফুজকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেন নাথান বম। কিন্তু, শামিন আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নাকচ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। শামিন নির্দেশনা দিয়েছেন, ‘যুদ্ধ হবে আক্রমণাত্মক, রক্ষাণাত্মক নয়।' নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের উদ্দেশ্য সশস্ত্র জিহাদ করা। তাদের মতে, যারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য কাজ করে, তারা মুরতাদ। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিশ্চিত হতে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত থাকবে।
এক প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসির প্রধান বলেন, আমরা নাথান বমের সঙ্গে শামিনের সর্বশেষ যোগাযোগটা উদঘাটন করতে পারিনি। আমরা মনে করি, কোনো না কোনোভাবে তার যোগাযোগ থাকতে পারে। হিজরতে যাওয়া অধিকাংশকেই আমরা গ্রেপ্তার করতে পেরেছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বিস্তারিত জানা যাবে।
নাথান বমের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন শামিন। তার কথায় কেন নাথান বম আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন, এ প্রশ্নগুলো আমাদেরও। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বিস্তারিত জানা যাবে।