একজন মানুষ যখন পশু হয়ে যান তখন তার জীবন কেড়ে নেওয়াই শ্রেয়। গণপিটুনির নামে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেওয়া হলে, তা এ সমাজের যেকোনো মানুষের জন্য আতঙ্ক ও অনিরাপত্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন আদালত।
বুধবার (৯ অক্টোবর) ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত-৬ এর বিচারক মোহাম্মদ মোরশেদ আলম রেনু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার আগে পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলেন।
এদিন সকাল ১১টা ১০মিনিটে আদালত চাঞ্চল্যকর এ হত্যার মামলার রায় পড়া শুরু করেন। শুরুতে বিচারক বলেন, ‘এটা একটা চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা। টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকায় দেখেছি। ভাগ্যক্রমে আমিই রায় পড়ছি। এ মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও ফুটেজ।এটা না থাকলে রায়ের দিকে যাওয়াটা কঠিন হতো। চারটি ভিডিও ক্লিপ। আমি দেখাতে চাই।’
পরে আদালত ৫ মিনিট করে দুটি ভিডিও ক্লিপ আদালতে দেখান। ভিডিও দেখে আদালতে কাঁদতে দেখা যায় রেনুর বোন নাজমুন নাহার নাজমাকে।
এর মাঝে বিচারক বলেন, ‘আবুল কালাম কে?’ তখন হাত তোলেন আবুল কালাম। বিচারক বলেন, ‘দেখছেন আপনাকে।’ আবুল কালাম বলেন, ‘দেখা যায়নি।’
কামালকে উদ্দেশ্য করে বিচারক বলেন, ‘আপনি দেখেন তো কি করছেন।’ কামাল বলেন, ‘আমি সবাইকে বলেছি থামো। দয়া করে থামো। শোনো সে কি বলতে চায়। আমরা শুনতে চাই। কিন্তু কেউ শোনে না।’
এরপর বিচারক বলেন, ‘তদন্তে কিছু দুর্বলতা আছে।’
হৃদয়তে উদ্দেশ্য করে বিচারক বলেন, ‘দেখবা তোমাকে চিনতে পারো কি না।’ ভিডিও দেখা শেষ হলে বিচারক বলেন, ‘বেশির ভাগই একজন মেরেছে। তাকে হত্যা করা হয়েছে সন্দেহ নেই।’
তিনি বলেন, ‘রিয়া ও হৃদয় ছেলে ধরার গুজব ছড়ায়। আজাদের নেতৃত্ব ও নির্দেশে ২য় তলা থেকে বোরখা পড়া মহিলাকে টেনে হিঁচড়ে নামায়। এ সময় রিয়া ডিজিস্টের চুল টানাটানি করে। স্কুলের মাঠে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে এলে কামাল মাথায় চাপ দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। আসাদ ঘুষি মারে। হৃদয় কাঠের লাঠি দিয়ে পেটায়। পেটাতে পেটাতে সে ক্লান্ত হয়ে ঘেমে যায়।বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় আবার পেটায়। হৃদয় নির্দয়, নির্মমভাবে পেটায় মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু তার মাঝে ছেলে ধরার কোনো আলামত বা পরিস্থিতি ছিলো না। তিনি ছিলেন নিরস্ত্র। আসামিরা নিষ্ঠুরভাবে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। নির্দোষ প্রমাণে তাকে কোনো সুযোগ দেয়নি। বাঁচার আকুতি উপেক্ষা করে। আঘাতের তীব্রতা এতো বেশি ছিলো, ঘটনার দিনই সে মারা যায়।’
বিচারক আরও বলেন, কেস ডায়েরি পর্যালোচনা করে দেখা যায় আসামিরা আইন-কানুনের পরোয়া করেননি। আসামি ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লা লাঠি দিয়ে নিহতের দুই হাতে, কাধে, বুকে, উরু ও পায়েসহ বিভিন্ন জায়গায় নির্দয় ও নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করেন এবং মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে আঘাত করতে থাকে। রেনুকে হত্যা বিভৎস, নারকীয় ও নৃশংস ছিল। যেভাবে গণপিটুনি দিয়ে রেনুকে হত্যা করা হয়েছে তা মধ্যযুগীয় বর্বরতা এবং সমাজের প্রত্যেক মানুষের জন্য আতঙ্ক ছড়িয়েছে।আসামি ইব্রাহিম কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া নিষ্ঠুর ও বর্বরভাবে আঘাত করে একজন স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাকে হত্যা করেছেন এবং দুই শিশুকে মাতৃহারা করেছে। নিজের পশু মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ করেছেন। তার পূর্ব অপরাধ ও শাস্তির রেকর্ড নাই কিন্তু নিহতকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করায় তাকে লঘু শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। অপরাধ সংগঠনের সময় তিনি যে নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, উন্মত্ততা ও পৈশাচিকতা প্রদর্শন করেছেন সেক্ষেত্রে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া সমীচীন হবে না। সংগঠিত আপরাধের মাধ্যমে তিনি নিজেকে সমাজে কলঙ্কিত করেছেন। একজন মানুষ যখন পশু হয়ে যান এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের কলঙ্কে পরিণত হয়ে যান তখন তার জীবন কেড়ে নেওয়াই শ্রেয়।
তিনি বলেন, গণপিটুনির নামে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেওয়া হলে তা এ সমাজের যেকোনো মানুষের জন্য আতঙ্ক ও অনিরাপত্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হলে এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে।