আইন ও অপরাধ

আবার খুন: মোহাম্মদপুরে কাটছে না আতঙ্ক

রাজনৈতিক পালাবদলে অবৈধ মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, বাজার-ফুটপাতসহ নানা খাত দখলে নিতে মরিয়া ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ। অস্ত্রের ঝনঝনানিতে অশান্ত এই আবাসিক এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক জেনেভা ক্যাম্প, যেখানে ঘিঞ্জি ঘরবাড়িতে বাস করেন বিহারিরা।  

সাম্প্রতিক অপরাধের ঘটনাগুলো নিয়ে কথা হলে জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দারা তাদের অনিরাপত্তার কথা তুলে ধরেন। এই ক্যাম্পের আশপাশের বাসিন্দারা ভয়ে থাকেন। কেউ কেউ বলছেন, এখন কুকুর ডাকলেও তারা আঁতকে ওঠেন; এই বুঝি গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল!

সব মিলে ঢাকার এই পুরোনো আবাসিক এলাকা মোহাম্মদপুরে সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য যেন থামছেই না। 

বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মোহাম্মদপুর এলাকার ‘পেশাদার’ ছিনতাইকারী চক্রও। অবশ্য জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এলাকায় পুলিশ, র‌্যাবের পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প।

এত কড়াকড়ির মধ্যেই বৃহস্পতিবার আবার জেনেভা ক্যাম্পে খুন হলেন একজন। মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান বলেন, জেনেভা ক্যাম্পে মাদক কারবারিদের দুপক্ষের সংঘর্ষে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে। নিহতের নাম রাজা।

এর আগে ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় জেনেভা ক্যাম্পে গোলাগুলিতে শিশুসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হন, যাদের মধ্যে একজন ২৮ অক্টোবর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলছেন, লোকবল ও টহল ভ্যান সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে, তবে চেষ্টা চলছে। লোকবল ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পেলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড দ্রুতই নিয়ন্ত্রণে নেওয়া যাবে।

৫ আগস্ট সরকার পতন ঘিরে থানায় থানায় হামলা ও সংঘর্ষের জেরে এখনও পুরোপুরি গুছিয়ে উঠতে পারেনি থানাগুলো, যার মধ্যে মোহাম্মদপুর থানাও রয়েছে। এই থানার ওসি বলেছেন, তাদের লোকবলের সংকট রয়েছে, সরঞ্জামের সংকট রয়েছে।

মোহাম্মদপুরে ১১ অক্টোবর গভীর রাতে সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের পোশাক পরে সংঘবদ্ধ ডাকাত দল এক ব্যবসায়ীর বাসায় ঢুকে সাড়ে ৭৫ লাখ টাকা ও ৬০ ভরি স্বর্ণালংকার লুটের ঘটনা সবার মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। 

তবে ঘটনার কিছুদিনের মধ্যে ডাকাতিতে জড়িত বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব ও ডিবি। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২০ অক্টোবর মোহাম্মদপুরেই দিনে-দুপুরে অস্ত্রের মুখে গাড়ি থামিয়ে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। সেদিন সকাল সোয়া ১০ টার দিকে মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেড ৩ নম্বর সড়কে নেসলে কোম্পানির পণ্য পরিবহনকারী একটি গাড়ি থামিয়ে ১২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় ডাকাত দলের সদস্যরা।

ঘটনাস্থলের আশপাশের ভবনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, ডাকাতির পর জনসমক্ষেই পালিয়ে যায় ডাকাতরা। মোটর সাইকেলযোগে বেড়িবাঁধ সড়ক ধরে ঢাকা উদ্যান এলাকার দিকে যেতে দেখা যায় তাদের। 

গত ১০ অক্টোবর রাত সাডে ৯টার দিকে ঢাকা উদ্যান এলাকায় ছিনতাইয়ে বাধা দেওযায় রবিউল ইসলাম (৩৫) নামে এক নিরাপত্তাকর্মীর বুকে, পিঠে ও হাতে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা। নিজেদের আধিপত্য জানান দিতে লিপ্ত হচ্ছে সংঘর্ষে। 

এসব সংঘর্ষে প্রদর্শন ও ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র, তাতেই হচ্ছে রক্তপাত, ঝরছে জীবনও। শুধু এসব ঘটনায়ই নয়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে মোহাম্মদপুরের অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এরই মধ্যে প্রাণ গেছে ১০ জনের বেশি। আহত হয়েছে প্রায় অর্ধশত। 

অস্ত্রের মুখে নারী শিক্ষার্থীর ব্যাগ কেড়ে নেওয়া, সাদেক খান আড়তের সামনে দুজনকে কুপিয়ে হত্যা, কিশোর গ্যাংয়ের দৌড়াত্ম্যে একের পর এক হত্যার ঘটনা ঘটছে। ঘটেছে জেনেভা ক্যাম্পে গোলাগুলির ঘটনা। 

এছাড়া গণছিনতাইয়ের ঘটনাও নিত্যদিনের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে। 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তীব্র ঝুকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে চাঁদ উদ্যান, সাত মসজিদ হাউজিং, লাউতলা, নবীনগর হাউজিং, ঢাকা উদ্যান, তুরাগ হাউজিং, বসিলা ৪০ ফিট, কাটাসুর, গ্রীণ হাউজিং,বসিলা গার্ডেন সিটি, একতা হাউজিং, চাঁন মিয়া হাউজিং, মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেড, মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটি, নবোদয় হাইজিং, বোটঘাট, সাদেকখান রোড, ক্যান্সার গলি, রায়েরবাজার, পুলপাড় বটতলা ও শেরে বাংলা রোড। এসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।

স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, সরকার পতনের পর মোহাম্মদপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। দীর্ঘদিন পুলিশের অনুপস্থিতি ছিল। পুলিশ থানায় দায়িত্ব গ্রহণের পরও সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। থানা জ্বালিয়ে দেওয়া, অস্ত্র লুট, বিট অফিস পুড়িয়ে দেওয়া, জনবল সংকটসহ নানা কারণে পুলিশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতার ঘাটতি এখনও কেটে ওঠেনি। 

মোহাম্মদপুরের অপরাধীদের আগে প্রবণতা ছিল, কার্যসিদ্ধি করে সটকে পড়া। এখন তারা ‘ওপেন’। প্রকাশ্যে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ভয়ে কেউ তাদের কিছুই বলতে পারে না। আবার পুলিশের জনবল কম এবং নতুন অফিসার দিয়ে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ঢাকার বাইরে থেকে বদলি হয়ে আসলেও তারা এলাকার অলিগলি এখনও চিনতে পারেনি। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই নড়বড়ে হয়ে গেছে। এখন ভরসা সেনাবাহিনী, তাদের নিয়মিত নজরদারি ও অভিযান।

ঢাকা উদ্যান এলাকার একজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয় রাইজিংবিডি ডটকমের। তবে পরিচয় প্রকাশ হলে তার ওপর বিপদ নেমে আসতে পারে, সেই ভয়ে তিনি নাম বলতে চাইলেন না। শুধু তিনি নন, সাধারণ বাসিন্দদের মধ্যে যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো, তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলে পরিচয় প্রকাশে কেউ রাজি হলেন না। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তেই আলাপ হলো ঢাকা উদ্যানের এক বাসিন্দার সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘যারা অপরাধ করে তাদের সবার হাতে অস্ত্র আছে। ধারালো অস্ত্র। তাই কেউ কিছু বলে না। আমরা এখানে বাস করি। কিছু বলতে গেলে আমাদের ওপরও আক্রমণ হবে। তাই আমরা চুপ থাকি। তবে এর থেকে মুক্তি চাই।’

আদাবর থানার পাশের বাসিন্দা ওমর ফারুক সোহাগ। তিনি বলেন, ‘আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকি। রাতে যখন গোলাগুলি শুরু হয় তখন ভয় আর আতঙ্কে থাকতে হয়।’ 

‘নিরাপত্তার কথা ভেবে ঘরের-দরজা জানালা বন্ধ করে দিই। তারপরও মনে হয় কখন না জানি সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবে নিজের বা পরিবারের জীবন বিপন্ন হয়। আমরা সাধারণ নাগরিক। আমাদের নিরাপত্তা দেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু তারা আমাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।’

২৭ অক্টোবর রাতে মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান বলেন, ‘অর্ধেক জনবল নিয়ে কাজ করছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। তবে পুলিশ জনতার সাথে মিলে কাজ করতে চায়। এ বিষয়ে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে পরামর্শ চাওয়া হয়েছে। 

‘আমি এসে এই এলাকার খুব খারাপ অবস্থা পেয়েছি। তবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এলাকায় আমাদের টহল বাড়ানো হয়েছে।’

মোহাম্মদপুরের ছিনতাইকারীরা

মোহাম্মদপুরে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ১২টি ছিনতাইকারী গ্রুপ সক্রিয় আছে। গ্রুপের নিয়মিত সদস্য নন- এমন অর্ধশত কিশোর ও যুবকও ছিনতাইয়ে নেমেছে অস্ত্র হাতে। 

মোহাম্মদপুর ঘুরে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এবং থানার দেওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, সরকার পতনের পর মোহাম্মদপুরে সবচেয়ে বেশি অপরাধমূলক কাজ করেছে আনোয়ার গ্রুপ। ‘কব্জিকাটা গ্রুপ’ হিসেবে পরিচিত এই গ্যাংয়ের প্রধান আনোয়ার, যার হাতে কিছুদিন আগেই আরেক কিশোর গ্যাং লিডার ফাইটার বিল্লাল খুন হন। এই আনোয়ারের নেতৃত্বে মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই করে থাকে ছোট ছোট কয়েকটি গ্রুপ। 

মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পশ্চিমে বিশাল আয়তনের এলাকা নবীনগর হাউজিং। ১৬টি সড়ক নিয়ে গড়ে ওঠা এলাকাটি ঘনবসতিপূর্ণ। ১৯৯০ সালে গড়ে ওঠা এই এলাকাকে ‘ছিনতাইকারীদের আতুড়ঘর’ হিসেবে জানেন স্থানীয়রা।

কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য

এই এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সবচেয়ে বড় গ্রুপ সাজ্জাদ গ্রুপ। এই গ্রুপের সব সদস্যের বিরুদ্ধেই একাধিক মামলা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাংশের সোর্স হিসেবে কাজ করার সুবাদে এই গ্রুপ প্রায়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। 

সাম্প্রতিক সময়ে ছিনতাইয়ের সক্রিয় হয়েছে এই গ্রুপের সদস্যরা। আরও প্রায় ২০টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে, এমন কোনো অপরাধ নেই, যা করছে না তারা। পুরো মোহাম্মদপুর এলাকা তারা চষে বেড়াচ্ছে।

‘বিষফোঁড়া’ জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবারিরা 

মোহাম্মদপুর এলাকার ‘বিষফোঁড়া’ হিসেবে দেখা দিয়েছে জেনেভা ক্যাম্পের মাদক করাবারিরা। ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিনে মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা লুট করে বিহারিদের মধ্যে যারা মাদক কারবারি, তারা। 

জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবারি ‘ভুইয়া সোহেল গ্রুপ’ এবং ‘পারমনু গ্রুপ’ ও ‘চুয়া সেলিম গ্রুপ’ এর মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজন নিহত হয়েছেন। 

এই গ্রুপগুলোর জন্য দিনরাত টটস্থ থাকেন তাজমহল রোডের বাসিন্দারা। নিরাপত্তাজনিত কারণে নাম প্রকাশ করতে না চাইলেও সেখানকার একজন বলেন, ‘এখন অবস্থা এমন যে রাতে কুকুর ডাকলেও ভয় হয়, আঁতকে উঠি; এই বুঝি গোলাগুলি শুরু হলো!’

‘আমদের দাবি, আবাসিক এলাকার মতো সড়ক ধরে ধরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হোক, তাহলে যদি কিছুটা স্বস্তি ফেরে।’

সক্রিয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

মোহাম্মদপুরে আগে থেকেই চুরি, ছিনতাই ও কিশোর গ্যাংয়ের হাতে ঘটা অপরাধ ছিল। এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যেসব ব্যবস্থা ছিল কমিউনিটি পর্যায়ে, সেগুলো ৫ আগস্টের পর নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। 

নিরাপত্তার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে মোহাম্মদপুর এলাকায় পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে একের পর এক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

২৬ অক্টোবর রাতে মোহাম্মদপুরে অভিযান পরিচালনা করে যৌথ বাহিনী। ঢাকা উদ্যান, চাঁদ উদ্যান ও নবোদয় হাউজিং এলাকায় যৌথ অভিযানে ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ ও কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে ৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

পর দিন ২৭ অক্টোবর বিভিন্নস্থানে অভিযান পরিচালনা করে আরও সাত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাদের কাছ থেকে ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। 

ঢাকা মেটোপলিটন পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) মাইনুল হাসান রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, ‘ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। আমরা যে কোনো ধরনের আইনশৃঙ্খলাজনিত অবনতির ঘটনা প্রতিহত করতে চাই। এ কারণে পুলিশের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে।’