বাবা আনিসুল করিমের মৃত্যুর সময় একমাত্র সন্তান মো. সাফরান করিমের বয়স ছিলো তিন বছর। এখন তার বয়স ছয় বছর। এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারে না বাবাকে। এখনও বাবার ছবি বুকে নিয়ে ঘুমাতে যায় সাফরান।
সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিম মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর দুপুর পৌনে ১২টার দিকে তাকে মাইন্ড এইড হাসপাতালে নেওয়া হয়। ভর্তির কিছুক্ষণ পর ওই হাসপাতালের কর্মচারীদের ধস্তাধস্তি ও মারধরে আনিসুল করিমের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় নিহতের বাবা ফাইজুদ্দীন আহম্মেদ বাদী হয়ে আদাবর থানায় হত্যা মামলা করেন।
মামলায় ১৫ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরু হয়েছে।
মামলাটি ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শেখ ছামিদুল ইসলামের আদালতে বিচারাধীন। আগামী ১৯ নভেম্বর মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য রয়েছে। এখন পর্যন্ত মামলাটিতে আনিসুল করিমের বাবা ফাইজুদ্দীন আহম্মেদ ও ভাই রেজাউল করিম সাক্ষ্য দিয়েছেন।
সম্প্রতি আনিসুল করিমের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয় রাইজিংবিডির এই প্রতিনিধির। মামলা সম্পর্কে আনিসুল করিমের বাবা ফাইজুদ্দীন আহম্মেদ রাইজিংবিডিকে বলেন, চার বছর হলো বিচার শেষ হলো না। বিচারের জন্য মামলা করেছিলাম। আমি তো আর বিচার করতে পারবো না। যা বিচার তা হবে। তবে আশা থাকবে, যেন মৃত্যুর আগে ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারি।
আনিসুল করিমের স্ত্রী শারমিন আক্তার বলেন, চার বছর হয়ে গেছে। এখনো বিচার শেষ হয়নি। সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। আগামী ১৯ নভেম্বর মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য রয়েছে।
তিনি বলেন, আনিস যখন মারা যায় তখন আমাদের সন্তানের বয়স ছিলো। তখন এতো বুঝতো না। তবে এখন বেশি বাবার কথা বলে, বাবাকে ফিল করে। আমি আসলে ওকে ওইভাবে বড় করেছি। ওকে ওর বাবার সবকিছুর মধ্যেই বড় করেছি। ওর বাবা নেই। কিন্তু ওর বাবার সবকিছু যা যেখানে ছিলো সেভাবেই আছে। ওই পরিবেশেই ওকে বড় করার চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করছি, ওর বাবাকে নিয়েই যেন বড় হয়। বাবার ছবি নিয়ে সে ঘুমাতে যায়। রেগুলার এটা করবে।
শারমিন আক্তার বলেন, সেফটির জন্য অনেক সময় অনেক জায়গায় সাফয়ানকে নিয়ে যেতে পারি না। তখন বলে, বাবা থাকলে এমনটা হতো না। আমি সব জায়গায় যেতে পারতাম। দিন দিন যত বড় হচ্ছে ওর মধ্যে বাবার প্রতি মিসিংটা আরও বেশি বেড়েছে। স্কুলের প্যারেন্টস ডে তে ওর বন্ধুদের বাবাকে দেখে। এটা দেখে ওর অনেক মন খারাপ থাকে। যাদের কারণে ছেলেটা বাবা হারা হয়েছে তাদের সবার শাস্তি চাই। আর এটা যেন দেখে যেতে পারি। সবাইকে ফাঁসি দিলেও তো ওকে ফেরত পাবো না। একটা মানুষকে কীভাবে তারা মেরে ফেললো। প্রোপারলি একটা বিচার চাই। এতে শান্তি পাবো। দোষীদের কঠিন বিচার চাই, মৃত্যুদণ্ড চাই।
তিনি বলেন, একটা মেয়ের এই বয়সে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করাটা কতটা কঠিন তা আসলে বোঝানো কষ্ট। কাউকে বোঝাতে পারবো না। ছেলে যখন বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে, তখন আমার কোনো উত্তর থাকে না। ফাস্ট টাইম ওকে ওর বাবার কবরটা দেখিয়েছিলাম। বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন আসে ওর মনে। আগে বলতো, চলো বাবাকে রকেটে করে আকাশ থেকে নিয়ে আসি। এখন বুঝতে পারে ওর বাবাকে আর আনা যাবে না। দিনশেষে ওর মুখের দিকে তাকালে কষ্ট পায়, আবার ভুলেও যাই। যতটুকু কষ্ট লাগে, ওকে দেখলে তা চলে যায়।
শারমিন আক্তার বলেন, বাবার কবর দেখানোর আগে সাফয়ান বলতো, বাবা কোথায়? বলতো বাবা তো আকাশের তারা হয়ে গেছে। বাবার কবরটা দেখে ও আগের চেয়ে অনেকটা চুপচাপ হয়ে গেছে। এ কারণে কবরটা দেখাতে চাচ্ছিলাম না। কবর দেখে বাসায় আসার পর জিজ্ঞাসা করে, ওখানে (কবরে) ছোট জায়গায় বাবা কীভাবে ঘুমাচ্ছে। বাবা কী করতেছে। বাবাকে দেখা যাবে। বাবার বাসা এতো ছোট কেন। আমি তো এসবের্ উত্তর দিতে পারি না।
সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জহিরুল ইসলাম (কাইয়ুম) বলেন, মামলাটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। কয়েকজনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। আমি কয়েকদিন হলো জয়েন্ট করেছি। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাক্ষীদের হাজির করে মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করবো। যেন ভূক্তভোগী পরিবার ন্যায়বিচার পায়।
২০২২ সালের ৮ মার্চ এ মামলায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুনসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা আদাবর থানার পুলিশ পরিদর্শক মো. ফারুক মোল্লা।
তবে এ মামলায় এজাহারে ডা. নুসরাত নামে একজনকে আসামি করা হয়নি। কিন্তু মামলা দায়েরের পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেন তিনি। তবে চার্জশিটে তার নাম আসেনি। এএসপি আনিসের পরিবারের ধারণা, নিশ্চয় ডা. নুসরাত ঘটনার সঙ্গে জড়িত। না হলে কেন তিনি আগেই জামিন নেবেন। এজন্য মামলাটি পুনরায় তদন্তের আবেদন করেন আনিসের বাবা ফাইজুদ্দীন আহম্মেদ। পরে আদালত তা মঞ্জুর করে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) এ কে এম নাসির উল্যাহ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুনসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। মাইন্ড এইড হাসপাতালের পরিচালক মুহাম্মদ নিয়াজ মোর্শেদ মৃত্যুবরণ করায় এবং আসামি ডা. নুশরাত ফারজানার বিরুদ্ধে অভিযোগের সতত্যা না পাওয়ায় মামলার দায় থেকে তাদের অব্যাহতির সুপারিশ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর ১৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন আদালত। আসামিরা হলেন-জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুন, মাইন্ড এইড হাসপাতালের পরিচালক আরিফ মাহামুদ, ফার্মাসিস্ট তানভীর হাসান, কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন, সাজ্জাদ আমিন ও ফাতেমা খাতুন, হাসপাতালের সমন্বয়ক রেদোয়ান সাব্বির, হাসপাতালের কর্মচারী মাসুদ খান, জোবায়ের হোসেন, তানিফ মোল্লা, সজীব চৌধুরী, অসীম কুমার পাল, লিটন আহম্মেদ, সাইফুল ইসলাম ও আবদুল্লাহ আল-আমিন।
আসামিদের মধ্যে অসীম কুমার পাল কারাগারে আছেন। শাখাওয়াত হোসেন পলাতক রয়েছেন। অপর ১৩ আসামি জামিনে আছেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য নয়। মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। আশা করছি, আসামিরা ন্যায়বিচার পাবেন।